আমার সুস্থতার রহস্য মেডিটেশন
সুকুমার চক্রবর্তী
প্রকাশিত : ১১:৩৫ পিএম, ১৯ জুন ২০২২ রবিবার | আপডেট: ০৯:৪৯ পিএম, ২১ জুন ২০২২ মঙ্গলবার
২৮ বছর আগের কথা। তখন আমি বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রজেক্টে ন্যাশনাল ট্রেনিং কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছি। সে-সময় হঠাৎ একদিন আমার হার্ট অ্যাটাক হলো। দেশে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা করানো হলো। একপর্যায়ে আরো উন্নত চিকিৎসার জন্যে কলকাতায় গেলাম। সেখানে বিএম বিড়লা হার্ট রিসার্চ সেন্টারে ডা. দেবী শেঠী আমার বাইপাস অপারেশন করলেন। কিন্তু সুস্থ হলাম না, বরং দিন দিন আমার স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছিল। সবসময় দুশ্চিন্তা আর মৃত্যুভয় কাজ করত। ৭১ কেজি থেকে আমার ওজন কমে হলো ৬০ কেজি।
আবার গেলাম ফলো-আপের জন্যে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, ‘আপনার হার্ট তো ঠিক আছে। কিন্তু অসুখটা আপনার মনে গেঁথে গেছে। তাই শুধু ওষুধে কাজ হবে না। এক কাজ করুন। আপনি মেডিটেশন করুন।’
নিরাময়ের ক্ষেত্রে মেডিটেশনের কার্যকারিতা তখনও আমার জানা ছিল না। ডাক্তারের পরামর্শ শুনে কলকাতার সেই হাসপাতালের মেডিটেশন সেন্টারে নিয়মিত যেতে শুরু করলাম। ধ্যান করে কিছুটা ভালো বোধ করছিলাম। মেডিটেশন সেন্টারের একজন দায়িত্বশীল আমাকে বলললেন, ‘এভাবে আপনি আর কতদিন এখানে এসে চর্চা করবেন? বিদেশে এভাবে দীর্ঘসময় থাকাটা তো বেশ ব্যয়বহুল। তার চেয়ে আপনার দেশে ফিরে কোনো মেডিটেশন সেন্টারের সাথে যুক্ত হোন।’
আমি জিজেজ্ঞস করলাম, ‘কিন্তু দেশে ফিরে মেডিটেশন শিখবই-বা কোথায়? মেডিটেশন শেখানোর কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে আছে কিনা, তা-ও আমি জানি না।’ তিনি আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘চিন্তার কোনো কারণ নেই। ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে মেডিটেশন শিখতে পারেন।’ তাদের কাছ থেকেই ঠিকানা নিলাম এবং দেশে ফিরে এলাম। পরের মাসেই আমি মেডিটেশন কোর্সে অংশ নিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, ‘দিনে ১০ ঘণ্টা করে কোর্স, আমি তো এতক্ষণ বসতে পারব না! কারণ দুঘণ্টার বেশি কোথাও বসার মতো শারীরিক অবস্থা আমার নেই। খুব অস্থির লাগে। মনে হয় এখনই মারা যাব।’
কিন্তু কোর্সে এসে মনে সাহস পেলাম। চার দিন বসেই ক্লাস করেছিলাম, একবারের জন্যেও শুতে হয়নি। শুধু তা-ই নয়, মেডিটেশন করে আমার এনার্জি লেভেলও অনেক বেড়ে গেছে। বাইপাস অপারেশনের পর থেকেই আমার ভেতরে সবসময় একধরনের ভীতি কাজ করত। মনে হতো, আর সুস্থ হবো না। কিন্তু মেডিটেশন চর্চার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি সুস্থ আছি। রোগ-শোক নিয়ে আর ভয় পাই না।
মেডিটেশন শেখার ২৬ বছর হলো। এখনও আমি প্রতিদিন মেডিটেশন চর্চা করি। এই বয়সে এসে দেখি আমার বন্ধুদের অনেকেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, আর যারা আছেন তারা মনের দিক থেকে একদম বুড়ো হয়ে গেছেন। কিন্তু স্রষ্টার কৃপায় আমি প্রাণবন্ত আছি। যাপন করছি কর্মব্যস্ত সুখী জীবন। এর অন্যতম কারণ নিয়মিত মেডিটেশন চর্চা এবং আমার সুস্থ জীবনাচার।
আমি শুনেছি, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে মেডিটেশন সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমি কিছুটা উদ্বিগ্নই বলা যায়। কারণ মেডিটেশন সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ করা হলে তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। এতে জনগণ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি রাষ্ট্রের জন্যেও সুস্থ জনশক্তি গড়ে তোলার কাজটি ব্যাহত হবে। একথা এখন সচেতন মানুষ সকলেই জানেন, অগণিত রোগের নিরাময়ে মেডিটেশন অত্যন্ত কার্যকরী। ফলে উন্নত বিশ্বে জনগণকে মেডিটেশন চর্চা করতে উৎসাহিত করা হয়। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, ধ্যানের মধ্য দিয়ে রোগমুক্তির পাশাপাশি আমি লাভ করেছি দীর্ঘ কর্মজীবন। এ শুধু ব্যক্তির উপকার নয়, একজন সুস্থ ও কর্মব্যস্ত মানুষ অবদান রাখতে পারেন তার সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতিতে। এ বিষয়গুলো আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তাই জাতিগত সমৃদ্ধিকে তরান্বিত করার লক্ষ্যে মেডিটেশন সেবার ওপর থেকে স্থায়ীভাবে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: প্রাক্তন ব্যাংকার ও সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজের অধ্যক্ষ।