ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের এগিয়ে চলা এবং বাংলাদেশের উন্নতি

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী

প্রকাশিত : ১০:২৩ এএম, ২৩ জুন ২০২২ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১০:২৯ এএম, ২৩ জুন ২০২২ বৃহস্পতিবার

আওয়ামী লীগের এগিয়ে চলা ও বাংলাদেশের উন্নতি ধারণা দু’টি ইতিবাচকভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ বছরের (২০২২ সালের) ডিসেম্বরে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল বংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের অতীতের দিকে তাকালে অনেক আত্মত্যাগ, সংগ্রাম আর অর্জনের অনেক গৌরবোজ্জ্বল কাহিনী আমাদের সামনে চলে আসে।

 ভাষা আন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এমনকি বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ এর বিধ্বংসী সংক্রমণের মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতি সমগ্র বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে।

আজকের বাংলাদেশ জননেত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে।  সংক্ষেপে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হচ্ছে। 

পলাশীর যুদ্ধের ১৯২ বছর পর ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার’ সাথে ‘বাঙালিদের’ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেন প্যালেসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি রাজনৈতিক দল, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১২০ পৃষ্টায় বঙ্গবন্ধু তৎকালীন শাসক “মুসলিম লীগের গণবিচ্ছিন্নতা”, ক্ষমতাকে “কোটারি করে ফেলা” এবং শাসন ক্ষমতা পরিচালনার জন্য “কোনো কর্মপন্থা” না থাকার প্রেক্ষিতে “নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করার” প্রয়োজনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা বলেছেন।

বঙ্গবন্ধুর লেখনীর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে তৎকালীন পাকিস্তানের ‘ক্ষমতাসীন শাসক গোষ্ঠী’ রাষ্ট্র পরচিালনার নীতি নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত প্রণয়ন, কর্মপন্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রভৃতি সব পর্যায় থেকে পূর্ব বাংলার ‘জনগণ’ এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল ‘রাজনীতিকদের’ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। ফলে, “ক্ষমতা সম্পর্ক” হয়ে উঠেছিল ‘শত্রুতামূলক’।

‘শত্রুতামূলক’ এই ‘ক্ষমতা সম্পর্কই’ বিভিন্ন ঘটনাবহুল ও বিয়োগান্তক আবর্তনের মাধ্যমে চূড়ান্ত পর্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ ও ত্রিশ লক্ষাধিক প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অনিবার্য করে তোলে।  অপরদিকে, আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ১৯২ বছর আগে, অন্যান্য অনেকের পাশাপাশি প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের সাথে ‘ক্ষমতাসীন’ নবাবের নেতিবাচক ‘ক্ষমতা সম্পর্ক’ এবং বাণিজ্যিক সুবিধার্থে ‘ক্ষমতা সম্পর্ক’ নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য ইংরেজ বেনিয়াদের সর্বব্যাপী ষড়যন্ত্র, মাত্র তিন হাজার পঞ্চাশ জন সৈন্য নিয়ে গঠিত লর্ড ক্লাইভের বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে সংঘটিত মাত্র প্রায় আট ঘন্টার সম্মুখ সমরে, তৎকালীন মুঘল সম্রাটের অপছন্দনীয় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর পরাজয় অনিবার্য করে তুলেছিল।  

এভাবে, বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ‘ক্ষমতা সম্পর্কে’ পলাবদলের লক্ষ্যে পলাশীর যুদ্ধ এবং রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার দিন হিসেবে ২৩ জুন তারিখটি উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাগ্যনির্ধারণী ক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।  বলা বাহুল্য, গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সম্পদ বা সুযোগ সুবিধার বন্টনকে কেন্দ্র করে যে ‘ক্ষমতার সম্পর্ক’ গড়ে উঠে তাই হচ্ছে রাজনীতি। পলাশীর যুদ্ধ এবং রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ফলে উপমহাদেশের এবং বাংলাদেশের ‘রাজনীতির’ ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়েছে। এই আখ্যায়িকার দ্বারা এটিও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, এই পরিবর্তন ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের বিভিন্নগোষ্ঠী বা ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সম্পদ ও সুযোগ সুবিধা বন্টনভিত্তিক ‘ক্ষমতা সম্পর্কের’ ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। 

পলাশী ও রোজ গার্ডেন দু’টি স্থান এবং ২৩ জুন একটি তারিখ, ‘সময় বা কাল এবং স্থান’  উভয়েই ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির কালনির্ধারণী হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। আর এই একটি তারিখ এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনা আমরা যখন ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে স্মরণ করছি তখন আমরা তথা সমগ্র মানব সভ্যতা বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ প্যানডেমিক’র কাল অতিক্রম করছি। মহামারীর সংক্রমণ এখন হ্রাস পেয়েছে কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। মহাকাল এই দু’টি স্থান ও ১৯২ বছরের ব্যবধানের একটি তারিখকে এক অদৃশ্য সূত্রে গ্রোথিত করে রেখেছে। আসলে মানব জীবনে সবকিছুই নির্ধারণ করে দেয় ‘কাল’ ‘মহাকাল’ বা ‘সময়’। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে একজন প্রজ্ঞাবাণ লেখক শাহ্যাদ ফিরদাউস মহাভারত-এর রচনা সম্পর্কিত তাঁর ধ্রুপদী উপন্যাস ‘ব্যাস’ এর শুরুতেই একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন,  “কাল সর্বজীবে দান করে দাহ এবং কালই তাদের শান্তি প্রদান করে। এ বিশ্ব সংসারে যা কিছু শুভাশুভ উপস্থিত হয়, সবই কালমূলক। মানুষের সৃজন ও বিনাশ সবই কাল দ্বারা সংঘটিত হয়। এই বিশ্বচরাচরে সকলই নিদ্রামগ্ন, একমাত্র কাল জাগরিত।” 

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন এবং ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন, মাঝখানে ১৯২ বছরের মহাকাল। আবার ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন থেকে ২০২২ সালের ২৩ জুন মঝখানে অনেক সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লাখেরও বেশী বাঙালি এবং কয়েক হাজার ভারতীয় সৈন্যোর প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ। এখানেই শেষ নয়, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রথম বিপ্লব সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু মুক্তি অর্জিত না হওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লব। কিন্তু দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা লগ্নেই বিশ্বাসঘাতকের দল সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তারপর আবার বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ত্যাগ, সংগ্রামবহুল এবং গৌরবোজ্জ্বল আর একটি অধ্যায়ের সূচনা। 

বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়নে আওয়ামী লীগ কী ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে? এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের শুরুতেই উল্লেখ করা সমীচিন যে, স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এরপরে এসেছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক দিক দিয়ে শোষিত ও বঞ্চিত হবার ক্ষোভ এবং শাসনতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার প্রশ্নগুলো।তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতির ক্রিড়া-পরিবর্তণের অনুঘটক যার মহাকাব্যিক যাত্রা শুরু হয়েছিল মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে, তার হাল এখন ধরেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা, শেখ মুজিবের কন্যা। 

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ত্রুটিপূর্ণ দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের বিভক্তির পরে বর্তমানের ভারত এবং কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। ধর্মভিত্তিক এই বিভক্তির ফলে সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান, হাজার মাইল ব্যবধানে ছিল যার দুটি অংশ। এই দুই অংশ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভূ-প্রকৃতি, ভাষা এবং সংস্কৃতির সমন্বয়ে গঠিত ছিল। এছাড়া বিভিন্ন জাতি সত্তার জনগণের উপর পাকিস্তানী শাসক এলিটদের নির্যাতনমূলক নীতি বাঙালির স্বতন্ত্র জাতীয়তার প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে আসে। এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র চার মাস ২০ দিনের মধ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালীন তরুণ এবং প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠিত হয়েছিল। পরের বছর (১৯৪৯ সালের) ২৩ জুন বেঙ্গল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম-এর  সমর্থক নেতা ও কর্মীগণ পূর্ব বাংলা (পরবর্তী কালে পূর্ব পাকিস্তান) আওয়ামী মুসলিম লীগ নামের একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে। এতে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি; আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াৎ হোসেন এবং আলী আহমদ খান সহ-সভাপতি; শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক; শেখ মুজিবুর রহমান (তখন কারান্তরীণ) যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। কোষাধ্যক্ষ হয়েছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এটি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা সমগ্র পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল। 

এ ব্যাপারে একটি পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ‘এসময় পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বৃহৎ আকারে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পরিবার (পীর, জমিদার, খান এবং নবাবগণ), পূর্ব পাকিস্তান একটি ভিন্ন চিত্র উপস্থাপন করেছিল। এখানে দলীয় রাজনীতি প্রথমে স্পষ্ট হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে, যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে একটি নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা  পালন করেছিল এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে কয়েকটি ছোট দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে এই ভূমিকা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।’
প্রথমেই ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে, পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পরে ১৯৪৮ সালে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে তরুণ মুসলিম লীগ কর্মী শামসুল হকের কাছে মুসলিম লীগের নেতা পরাজিত হবার পর থেকে শাসক মুসলিম লীগ একে একে ৩৫টি উপ-নির্বাচন স্থগিত রেখেছিল। এই পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম-এর সমর্থক নেতা ও কর্মীগণ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরাতন ঢাকার কে এম দাস লেনস্থ “রোজ গার্ডেনে” এক অধিবেশনে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” নামে পৃথক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে দেখা যাচ্ছে, দলটি প্রতিষ্ঠাই হয়েছে গণতন্ত্রহীন অবস্থা থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের সংগ্রামী চেতনা ধারণ করে। 

১৯৫৪ সালের নির্বাচন যা সে বছর মার্চ মাসের ৮ ও ১০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এতে ৩০৪টি আসনের জন্য ১২৮৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিল, ৫টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হয়েছিল। এর মধ্যে ২২৮টি আসনের জন্য ৯৮৬ জন মুসলিম প্রার্থী ছিল, ৩০টি হিন্দু আসনের জন্য ১০১ জন প্রার্থী ছিল, এবং ৩৬টি সিডিউল কাস্ট আসনের জন্য ১৫১ জন প্রার্থী ছিল। অমুসলিম আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিল মূলত পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস, ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি এবং সিডিউলড কাস্ট ফেডারেশন। এই নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ১,৯৭,৪৮,৫৬৮ জন, এর মধ্যে ভোট দিয়েছিল ৭৩,৪৪,২১৬ (৩৭.১৯%) জন। প্রদত্ত ভোটের হার খুব কম হবার কারণ ছিল খারাপ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং রক্ষণশীল মুসলিম মহিলাদের ঘরের বাইরে এসে ভোট দিতে অনিচ্ছুক হবার কারণে।  

পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস তখনো ক্রিয়াশীল একটি দল ছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পাকিস্তানের গণ পরিষদে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবির প্রথম উত্থাপক শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত কংগ্রেস দলের নেতা ছিলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ের পরে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জি. ডাব্লিউ. চৌধুরি ‘দ্য ইস্ট পাকিস্তান পরিটিক্যাল সিন ১৯৫৫-১৯৫৭’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধে বলছেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের এই সম্মেলনে বাইরের শুধু একটি দলকে আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল সেটি হচ্ছে পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস। এই সম্মেলনেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ দলটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। আর একই সাথে এটিও লক্ষণীয় যে, এই অধিবেশনের পর থেকে পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা ও কর্মী সবাই আওয়ামী লীগের সাথে একীভূত হয়ে যায়। পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস নামে কোনো দল এরপর থেকে আর ক্রিয়াশীল থাকতে দেখা যায় না। পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস দলটি এরপর থেকে আর পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্রীয়াশীল না থাকার কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেস দলটির মধ্যে “একান্ত সমঝোতার” কথা উল্লেখ করেন। আর সেই “একান্ত সমঝোতা” অনুযায়ীই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ২১-২৩ অক্টোবরের অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এটিও জানা যায় যে, এই সমঝোতার অন্যতম দিকগুলো ছিল, আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িকভাবে গড়ে তোলা, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করা, বিভিন্ন নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে অমুসলিমদের মনোনয়ন দেয়া প্রভৃতি। এভাবে আওয়ামী লীগ একটি প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে পূর্ণাঙ্গরূপে আত্মপ্রকাশ করে। 

১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, এই সংবিধানে দেশটিকে “ইসলামী প্রজাতন্ত্র” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। গণতন্ত্রের শৈশবেই দেশটি ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের কবলে পড়ে। সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করে দিয়ে ১৯৬২ সালে আর একটি সংবিধান উপস্থাপন করেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ আন্দোলন সংগঠন করে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন। ছয় দফা দাবির ইতিহাস হচ্ছে পাকিস্তানী ধর্মীয় ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সমাপনী পর্বের সূচনা।  ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি  লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মিলিত বিরোধী দলের এক কনভেনশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। তবে কনভেনশনের সভাপতি চৌধুরি মোহাম্মদ আলী ছয় দফা নিয়ে সেখানে বিস্তারিত আলোচনা করতে দেননি।

লাহোর কনভেনশনে উত্থাপিত হলেও সেখানে ছয় দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে না দেয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু ১১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিমান বন্দরে সংবাদ সম্মেলন করে ছয় দফা সম্পর্কে বিস্তারিত জনসমক্ষে তুলে ধরেন। এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা দলীয় কর্মসূচী হিসেবে গৃহীত হয়। ছয় দফা প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্য বিশিষ্ট উপকমিটি গঠন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ১৮ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই কাউন্সিলে ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দিন আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক এবং মিজানুর রহমান চৌধুরিকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করেন। 

ছয় দফা কর্মসূচীভিত্তিক আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থন করতে যেয়ে বঙ্গবন্ধুর একান্ত ঘনিষ্ঠ অনুসারী, তোফায়েল আহমেদ বলেন, “ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ বস্তুত ছয় দফা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র তথা অঙ্কুর।” 
ছয় দফা আন্দোলনের পথ ধরে এরপরে আসে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০-এর নির্বাচন। ১৯৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের প্রতি এদেশের জনগণ তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। পাকিস্তানী ধর্মীয় ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয় পরিচিতি উদ্ভব এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ছয় দফা অন্যতম একটি মাইল ফলক। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পরে আসে ‘জাতীয় পরিচিতি’ ও ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত পর্যায় ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। ত্রিশ লাখ বাঙালির আত্মদান, প্রায় তিন লাখ বাঙালি মা-বোনের ইজ্জত এবং প্রায় ১৮ হাজার ভারতীয় সৈন্যেও আত্মাহুতি এবং সমগ্র বাংলাদেশকে একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার মধ্য দিয়ে বিশ্বেও রাজনৈতিক মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তণের পর থেকে  বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার এক বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। বঙ্গবন্ধুর সরকার যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মোকাবেলার মত করে এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার কাজে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ ব্যাপৃত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠিত করার এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকার যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মোকাবেলার মত করে এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেল করার কাজে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ ব্যাপৃত হয়। দেশ গড়ার কঠিন কাজে যখন বঙ্গবন্ধু ব্যাপৃত ছিলেন তখন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি আওয়ামী লীগের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কুচক্রী মহলের সহযোগিতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। তবে বঙ্গবন্ধুর তিন বছরের সরকারের সাফল্যও বিস্ময়কর ছিল। 

দেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় সভাপতির পদ ছেড়ে দিলে সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারান্তরালে নিহত জাতীয় নেতাদেও অন্যতম এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে। সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন মো. জিল্লুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে কলঙ্কতম এবং শোকাবহ ঘটনার মাধ্যমে রাজনৈতিক পট পরিবর্তিত হলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি স্থগিত করা হয়। 

পঁচাত্তর পরবর্তীকালে বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া পুরোপুরি থেমে যায়। এসময় সঠিক নেতৃত্বের অভাবে আওয়ামী লীগের অন্যসব নেতা-কর্মী ও সমর্থকগণ দিশেহারা অবস্থায় ছিল। এই পর্যায়ে ১৯৮১ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় । সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন আব্দুর রাজ্জাক। এবছর অক্টোবর মাসে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। আবারও আঘাত আসে দলটির ওপর। ১৯৮৩ সালে আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ বেরিয়ে বাকশাল গঠন করে। এসময় সৈয়দ সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক-এর দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৮৭ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ  নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে।  অন্যান্য দল ও জোটের সাথে এসময় আওয়ামী লীগ ব্যাপক গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। ফলে দীর্ঘ নয় বছর ক্ষমতায় থাকার পরে জেনারেল এইচ এম এরশাদের সামরিক সরকারের পতন হয় । একই সাথে ১৯৭৫-পরবর্তী কালের বাংলাদেশে দীর্ঘকাল যাবৎ অবরুদ্ধ থাকার পরে গণতন্ত্রায়নের শুভ সূচনা হয়। ১৯৯১ এর ৫ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যে দলটি ক্ষমতায় আসে তাদের দলীয় মেনিফেস্টোতে সংসদীয় পদ্ধতির কথা উল্লেখ ছিল না।একারণে তারা সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যাবার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিল। এসময় মূলত আওয়ামী লীগের প্রচেষ্টায় সরকারি এবং বিরোধী দল সমবেতভাবে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পুনরায় প্রবর্তিত করার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছায়। এসময় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন বলবৎ ছিল। এ আইনটি নব্বই পরবর্তী প্রথম নির্বাচিত সরকার বাতিল করতে সম্মত হয়নি। 

১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট জয় লাভ করে সরকার গঠন করার পরে এই ইনডেমনিটি আইন সংসদে বাতিল হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার এর রায় বাস্তবায়নের আগেই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০১-এ চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। এসময় সারা বাংলাদেশ অত্যাচার-নির্যাতন চলতে থাকে।  ১৭ আগস্ট সারা বাংলাদেশে এবং ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা ও গ্রেনেড হামলা করা হয়। ২১ আগস্টে হামলা করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ ও এর সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য। 

২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ  নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয় লাভ করে। মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬২টি আসন এবং প্রদত্ত ভোটের ৫৫.৮৫% ভোট লাভ করে মহাজোট। তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয় লাভ করার পরে ২০০৯ সালেরর জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করে মহাজোট সরকার গঠিত হয়।  এইবার ক্ষমতায় আসার পরে জাতীয় সংসদের কমিটি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। অতীতে পার্লামেন্টারি কমিটিগুলোর সভাপতি হতেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। কিন্তু নবম জাতীয় সংসদে মন্ত্রী ব্যতীত অন্য সংসদ সদস্য মন্ত্রণালয়ের পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি করার বিধান করা হয়। এত পার্লামেন্টারি জবাবদিহিতার পথ আরো সুসংবদ্ধ করা সম্ভব হয়। 

গণতন্ত্রায়নের অন্যতম একটি উপাদান হচ্ছে আইনের শাসন কার্যকর করা। ২০০৯-২০১৪ মেয়াদে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার পরে দীর্ঘ প্রতিক্ষিত বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকর করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও এসময় গঠিত হয়। বিচারের রায় এবং একটি বিচারের রায় কার্যকর করে কাদের মোল্লার ফাঁসি দেয়া হয়। এই রায়ের প্রেক্ষিতে সারা বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রবিরোধী ও জনবিরোধী হামলা চালানো হয় সেগুলো ছিল প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রায়নের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক ক্ষয়ক্ষতির পরে সেইসব হামলা পেরিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আওয়ামী লীগ পুনরায় জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে। পর পর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থকার কারণে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য যত কাজ করেছে দেশ স্বাধীন হবার পরে গত চল্লিশ বছরেও এমন কাজ অতীতে কখনো হয়নি। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যেও সমন্বয়ে উন্নয়ন রচনার যে মডেল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার তৈরি করেছেন তা পরিপূর্ণতা পেলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে ‘ইমার্জিং টাইগার’। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নয়নের সাথে সাথে গণতন্ত্র সংহতকরণের প্রক্রিয়াও এগিয়ে চলেছে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়নের পথ পরিক্রমায় শোক ও কলঙ্কের দিন বঙ্গবন্ধুর হত্যার দিন ১৫ আগস্ট প্রায় সমাগত।  ১৫ আগস্ট শোক দিবসকে সামনে রেখে এ লেখার উপসংহারে বলা যায়, আওয়ামী লীগের সব কাজকে যেহেতু ক্রিয়া, অতএব স্বাভাবিকভাবেই এর ‘প্রতিক্রিয়া’ থাকবে। ‘প্রতিক্রিয়া’ ব্যক্ত করা প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রধান কাজ। পাশাপাশি লক্ষ্য করা যায়, “প্রতিক্রিয়ার” অন্যতম বৈশিষ্ট্য বা গুণ হচ্ছে, যারা “ক্রিয়ার” সুফল ভোগ করে তারাও “প্রতিক্রিয়া” ব্যক্ত করতে দ্বিধাবোধ করে না। “প্রতিক্রিয়া” কখনো বদনামের রূপ ধারণ করে আবার কখনো ‘আত্মঘাতী’ হয়ে দেখা দেয়।

বাঙালিদের ক্ষেত্রে “প্রতিক্রিয়া” প্রকাশিত হতে পারে  “আত্মঘাতী” আকারে। গণতন্ত্রায়নের লক্ষ্যে সংগ্রামরত থেকে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাঙালির আচরণ কখনো কখনো ‘আত্মঘাতী’ হতে দেখা যায়!  বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ এর করিম খাঁ’র উদাহরণ দিয়ে নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তার “আত্মঘাতী বাঙালী” গ্রন্থে বলছেন, “বাঙালী সমাজ ও জীবনের ক্ষুধিত পঙ্কেও যাহারা জন্মিয়াছে তাহাদেরও কেহ উহার করাল গ্রাস হইতে নিজেকে রক্ষা বা উদ্ধার করিতে পারে নাই, একটি ব্যতক্রিম ছাড়া।” (পৃ.৪) রবীন্দ্রনাথ “বাঙালীকে চিনিয়াছিলেন; ঘোর নিমিত্তের মত, তাঁহার বিরোধী বাঙালীদের মুখে গর্দভ-গৃধ্র-গোমায়ু-বায়সের ডাকও শুনিয়াছিলেন; তবু তিনি তাঁহার অন্ধ বাঙালী-¯কেহ ছাড়িতে পারেন নাই।” (পৃ.৬)  বঙ্গবন্ধুও তাঁর বাঙালি প্রেম থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেন নাই। বাঙালিদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার ঐতিহ্য ধারণ করে আওয়ামী লীগ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আওয়ামী লীগ যে কাজ করেছে বা করছে সেসব কাজের ফলাফল দীর্ঘস্থায়ী, আর অন্তত একটি নয় দুটি ক্ষেত্রে তা চিরস্থায়ী, সেটি হলো স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং দেশকে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। পদ্মা সেতু তার মাত্র একটি অন্যতম উদাহরণ। এমন উদাহরণ আরো অনেক আছে। গণতন্ত্র বিকাশের জন্য এবং অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার সংগ্রাম করার লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর ২০২২ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সম্মেলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ উন্নত সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ও শপথে আরও বলীয়ান হয়ে আওয়ামী লীগ এগিয়ে যাক এই প্রত্যাশা দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করছি।   

লেখক: ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এসবি/