ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

পদ্মা সেতু: বাংলাদেশের অহংকারে আর একটি পালক 

তাপস দাস 

প্রকাশিত : ০৯:৩৮ এএম, ২৫ জুন ২০২২ শনিবার | আপডেট: ১১:৩৭ এএম, ২৫ জুন ২০২২ শনিবার

দেশীয় এবং বহিঃবিশ্বের চক্রান্তকে পরাস্ত করে উদ্বোধন হতে চলেছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম খরস্রোতা (প্রথম আমাজন) নদী পদ্মার ওপর নির্মিত পদ্মা সেতু। এই সেতু ইতিমধ্যে বাংলাদেশসহ বিদেশি গণমাধ্যমে একটি আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। তবে এই আলোচনার বিভিন্ন কারণ থাকলেও যে কারণটি সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, এটি বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে নির্মিত প্রথম সেতু। 

এই সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার ৭৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। ২০১২ সালে এই সেতুটি নির্মাণের জন্য বিশ্ব ব্যাংক আর্থিক সহায়তা দিতে অস্বীকার করলে বাংলাদেশের জনগণ সেতু নির্মাণের আশা ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহস এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বে নির্মিত এই সেতু শুধুমাত্র বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবতা প্রদান করেননি, পাশাপাশি অবাক করেছেন বিদেশের অনেক প্রতিনিধিদের। 

তবে ধারাবাহিক গতিপ্রকৃতির বিপরীতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা এই মাটির মানুষের প্রথম নয়। প্রাচীন কাল থেকে দেশভাগের আগে পর্যন্ত নানা বংশীয় রাজারা এই মাটিকে শাসন করলেও কখনই রাজার ধর্ম প্রজার ধর্ম হয়নি, এমনকি ইংরেজরাও এই মাটিকে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের দখলে আনতে পারেনি ফলত এখানকার জনগণ সবসময় নিজেদের মতো করে জীবনধারণ করেছেন। আর এই বিপরীতে বেঁচে থাকার শক্তিকে পাথেয় করে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ফানুস উড়িয়ে স্বাধীনভূমি বাংলাদেশ অর্জন করেছিল এদেশের মানুষ। স্বাধীনতার পরও সমস্ত লাঞ্ছনার উত্তর দিতে ভোলেনি এই দেশ।  উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই বৈঠকের পর প্রভাবশালী দৈনিক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এলেই ‘বাস্কেট কেস’ বলা শুরু করে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টটির শিরোনামেই ছিল ‘বাংলাদেশ, বাস্কেট কেস নো মোর’। শুধু তাই নয় স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের কোটায় নিজেদের নাম করে নিয়েছে। বিদেশিদের চোখে শুধুমাত্র ঋণ গ্রহণকারী দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপকে ঋণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান আজ কোথায়। আর এই ইতিহাসের পথ ধরেই খরস্রোতা নদীর গতিপথের প্রতিকূলকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে গড়ে উঠেছে ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘের পদ্মা সেতু। 

আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় পদ্মা সেতু নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে কোনো রকম বিরোধ রাখা উচিত নয়। আমি মনে করি ঢাকাকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব হবে অপরিসীম। আমরা জানি, পরিকাঠামোর ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বাংলাদেশের জাতীয় আয়ে বিশিরভাগ অবদান ঢাকার থাকে, তবে পদ্মা সেতুর মধ্যে দিয়ে ঢাকার সঙ্গে ২১টি জেলার যে সংযোগ গড়ে উঠলো নিঃসন্দেহে আগামী সময়ে এই জেলাগুলির স্থানীয় অর্থনীতির যে পরিবর্তন ঘটবে তাতে জাতীয় আয়ে এই জেলাগুলির অবদান বৃদ্ধি পাবে। মনে করা হচ্ছে এই সেতুর ফলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়বে এবং তার পাশাপাশি  দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের  অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প সম্প্রসারণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে এই প্রকল্প ।

তবে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি ,জাতীয় উন্নয়নের যে দিকটি সব থেকে বেশি বিকশিত হবে ঢাকার সঙ্গে মোংলা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এ বন্দর থেকে ঢাকায় পণ্য পরিবহণে সময় লাগবে মাত্র ৩ ঘণ্টা, যা আগে লাগত ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা। এখানে তাদের সময় বাঁচবে ৬ ঘণ্টা। আর মোংলা বন্দর থেকে সরাসরি চট্রগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহনে সময় লাগত ১৪ ঘণ্টা। সেতুর কারণে তা কমে এখন হবে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা। এখানেও সময় বাঁচবে ৬ ঘণ্টা। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের সময় সাশ্রয়ী হবে ১২ ঘণ্টা, যা তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পুঁজি তো বটেই অর্থনৈতিকভাবে লাভবানও হবেন তারা। 

এই যোগাযোগ ব্যবস্থা শুধু যে অর্থনৈতিক সংগতি ফিরিয়ে আনবে তা নয়, পরিবর্তন ঘটবে সামাজিক জীবন যাত্রায়। জলপথে ঢাকা থেকে আসা -যাওয়ার যে ভোগান্তি, তা থেকে মুক্তি দেবে জনসাধারণকে। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় মানুষের এতদিন ছিল তার থেকেও মুক্তিপাবে তারা। শুধু যে বাংলাদেশের বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ঢাকায় যাওয়ার সুবিধা পাবে তাই নয়, ঢাকার বসবাসকারী মানুষও এর সুবিধাভোগ করবে। তবে পদ্মা সেতু যে দেশের অভ্যন্তরের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ সেটি নয়। এই সেতু ঢাকা -কলকাতা যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে। 

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ চিকিৎসা এবং জামা-কাপড় কেনাকাটার জন্য আজ কলকাতামুখী। অন্যদিকে একথা বলার কোনো অপেক্ষা রাখেনা যে, আজ বাংলাদেশের উন্নয়ন কলকাতাসহ ভারতের বহুশ্রমিককে ঢাকামুখী করেছে। পদ্মা সেতু দুইদেশের মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে আরো দৃঢ়তা প্রদান করবে। পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে ঢাকা থেকে কলকাতা যেতে সময় লাগবে মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা। সুতরাং একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর বন্ধন আরো শক্ত করতে পদ্মা সেতুর ভূমিকা হবে অপরিসীম। আমি মনে করি, বাংলাদেশের পাশাপাশি কলকাতার অর্থনীতি পদ্মা সেতুর জন্য অনেক লাভবান হবে। দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক শুধু রাষ্ট্রীয় সম্পর্ককে সুদৃঢ় করেন, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনকেও আরো এগিয়ে নিয়ে যায়। তার জন্য আজ আমরা রাঁধুনি,কস্তুরী, দুই পাড়সহ আরো অনেক এরকম রেস্তোরাঁর মাধ্যমে কলকাতায় বসে বাংলাদেশি খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে পারি। এর পাশাপাশি দুদেশের মধ্যে পর্যটন শিল্পে বিরাট পরিবর্তন ঘটবে বলে আমার মনে হয়। 

তবে একজন সাধারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি বলতে চাই, পদ্মা সেতু অর্থনৈতিক , সামাজিক, শিক্ষা, চিকিৎসা ক্ষেত্রে সুবিধা এনে দেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক সহিংসতা কমাবে বলে আমার মনে হয়। সামাজিক সহিংসতার সঙ্গে অর্থনীতির একটি সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশের আজও যে ধর্মীয় হিংসা দেখতে পাই আর একটি কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য। বাংলাদেশের সমস্তকিছু ঢাকা কেন্দ্রিক হাওয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশের সাথে অর্থনৈতিক বৈষম্য গড়ে উঠেছে। ঢাকার বাইরে যুবকরা সেভাবে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে উঠতে পারেনি। আর এই বৈষম্যকে কাজে লাগিয়ে মৌলবাদীরা যুবকদের মনোজগতে জায়গা করে নিচ্ছে। এই ধারণা থেকে আমার মনে হয়, পদ্মা সেতুর ফলে পদ্মার এপারে মানুষের বিশেষ করে যদি যুবকদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরে আসে বা আনা যায় তাহলে দক্ষিণ অঞ্চলে ধর্মীয় বা সামাজিক হিংসা কম হবে বলে আমার মনে হয় এবং এটিই হবে পদ্মা সেতুর প্রধান তাৎপর্য। 

লেখক: বাংলাদেশ বিষয়ক গবেষক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা