ঢাকা, শনিবার   ০২ নভেম্বর ২০২৪,   কার্তিক ১৮ ১৪৩১

পদ্মা সেতু থেকে বিশ্ব ব্যাংকের পিঠটান

একুশে টেলিভিশন  

প্রকাশিত : ১০:৫৭ এএম, ২৫ জুন ২০২২ শনিবার | আপডেট: ১১:০৯ এএম, ২৫ জুন ২০২২ শনিবার

স্বপ্ন সংযোগের পদ্মা সেতু। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ বাস্তব এই সেতু। 

সেতুর কাজ শুরুতে প্রথমেই সবচেয়ে বড় ধাক্কা হয়ে এসেছিল প্রকল্পে দুর্নীতির কাল্পনিক অভিযোগ। বিশ্ব ব্যাংক প্রথমে এই প্রকল্পে অর্থায়নের প্রস্তাব নিয়ে এলেও ঋণচুক্তির পরও দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে সরে যাওয়ার পর সরকারের সঙ্গে তৈরি তাদের দুরত্ব।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হার না মানা অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত তাদের বাদ দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নেই বাস্তব রূপ পেয়েছে বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু।

আর তাই তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের ‘সামর্থ্য আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক’।

শুরুটা হয়েছিল অনেক আগে; ২০০১ সালে পদ্মার মাওয়া প্রান্তে সেতুর ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন শেখ হাসিনা। তখনও তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।

এরপর এই সেতু নিয়ে তেমন অগ্রগতি হয়নি। ২০০৪ সালে সমীক্ষা করে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয় জাইকা একটি। 
২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে এই সেতু নির্মাণের আলোচনা নতুন করে শুরু হয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায়। তখন একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্ব নিয়ে নতুন আঙ্গিকে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করে। কয়েক দফায় নির্মাণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৯১ কোটি ডলার। সিদ্ধান্ত হয়, সেতুতে থাকবে সড়ক ও রেলপথ; উপরে চলবে গাড়ি, নিচে ট্রেন।

কয়েক দফায় ব্যয় বাড়ানোর পর ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকায় পদ্মা বহুমুখী সেতু সংশোধিত নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এর আগেই নিশ্চিত করা হয় ঋণদাতাদের প্রতিশ্রুতি।

এডিবি প্রধান উদ্যোক্তা হলেও সবচেয়ে বেশি ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে যুক্ত হয় বিশ্ব ব্যাংক।

মোট নির্মাণ ব্যয় ২৯১ কোটি ডলারের মধ্যে ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় বিশ্ব ব্যাংক। এডিবি ৬১ কোটি ৫০ লাখ, জাইকা ৪১ কোটি ৫০ লাখ, আইডিবি ১৪ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। বাকি অর্থ সরকার দেবে বলে ঠিক হয়েছিল।

২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল পদ্মার বুকে ভাষাশহীদ বরকত ফেরিতে হয় বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। কিন্তু তারপরও অর্থায়ন ছাড় না হওয়ায় কাজও শুরু করা যায়নি। 

এরইমধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার খবর আসে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় কানাডা পুলিশ এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ঘুষ সাধার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।বিশ্ব ব্যাংক নিজেরাও বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা জানায়।

পদ্মা প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে প্রাকযোগ্য তালিকায় থাকা পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের একটি ছিল কানাডাভিত্তিক লাভালিন। মূল্যায়ন কমিটির মনোনীত এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান থেকে একটিকে নির্বাচিত করার কথা ছিল বিশ্ব ব্যাংকের।

বিশ্ব ব্যাংকের মুখপাত্র লেসলি কুইন্টনের উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্স ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে এ তদন্ত শুরু করেছে কানাডীয় কর্তৃপক্ষ।

রয়্যাল কানাডীয় পুলিশ লাভালিনের আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেপ্তার করে। মামলাও হয় তাদের বিরুদ্ধে। পরে বাংলাদেশের মামলায়ও আসামি করা হয়েছিল এই দুজনকে।

ওই বছরের ১০ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বিশ্ব ব্যাংক।

ঢাকায় বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন জানান, ‘দুর্নীতির’ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত তারা নেবে না।

বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর সরকারের পক্ষ থেকে তা বারবারই নাকচ করা হচ্ছিল। তবে প্রকল্পের কাজ বন্ধই থেকেছে।

এই নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে ২০১২ সালের ২৯ জুন পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক। বিশ্ব ব্যাংক যুক্তি দেখায়, এই প্রকল্পে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রমাণ মিলেছে।

ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত বদলানোর বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে তদন্তের শর্ত দিয়েছিল বিশ্ব ব্যাংক। তখন তদন্ত এবং প্রকল্পের কাজ একসঙ্গে চালাতে সরকার চাইলেও ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর বিশ্ব ব্যাংক সাফ জানিয়ে দেয়, মামলা না হলে ঋণ মিলবে না।

এর মধ্যেই মন্ত্রীর পদ ছাড়েন সৈয়দ আবুল হোসেন। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর ছুটিতে যান সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান।

প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুদক জানায়, মূল সেতু নির্মাণে প্রাকযোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে কোনো রকম দুর্নীতি হয়নি।

তবে বিশ্ব ব্যাংকের তাগিদে ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে দুদক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল জাহিদ ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় একটি মামলা করেন, যাতে সেতু বিভাগের তখনকার সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান করে সাতজনকে আসামি করা হয়েছিল।

অন্য আসামিরা হলেন- সেতু কর্তৃপক্ষের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদী শাসন) কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালটেন্ট লিমিটেডের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশে কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল, এই সংস্থার আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস।

মামলার আগে অভিযোগ অনুসন্ধানে মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, জাতীয় সংসদের হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর ভাই নিক্সন চৌধুরী, সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, এসএনসি-লাভালিনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি জিয়াউল হকসহ ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক কর্মকর্তারা।

কানাডার আদালতে এসএনসি-লাভালিনের বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ, কোম্পানির তিন কর্মকর্তা ও দুদকের মামলার আসামি কেভিন ওয়ালেস, রমেশ শাহ ও ইসমাইলের জবানবন্দি সংগ্রহ এবং রমেশের ডায়েরি সংগ্রহ করতে ২০১৩ সালের মে মাসে দুদকের তৎকালীন প্রধান কৌঁসুলি আনিসুল হক এবং দুদকের উপ-পরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম কানাডা গিয়েছিলেন। তবে জবানবন্দি কিংবা ডায়েরি পাননি তারা।

এর মধ্যে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব ব্যাংককে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এই বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা সরকার দিলে পরের বছরের সেপ্টেম্বরে দুদক ওই মামলায় আসামিদের অব্যাহতি দেয়। দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি’।

এরপর একই বছরের অক্টোবর দুদকের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতির আদেশ দেয় আদালত।

এ মামলায় মোশাররফ হোসেন গ্রেপ্তার হওয়ার পাশাপাশি সরকারি চাকরি থেকেও সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি মুক্তি পান। ২০১৩ সালের জুনে বরখাস্তের আদেশও প্রত্যাহার করে তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর অবসরে গিয়ে বর্তমানে জার্মানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত আছেন।

ছয় বছর ধরে বিচারিক কাজের পর পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ বিশ্ব ব্যাংক তুলেছিল, তার প্রমাণ না পাওয়ার কথা জানায় কানাডার আদালত। ২০১৭ সালে এই মামলার তিন আসামিকে কানাডার আদালত খালাস করে দেয়।

বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের ঘোষণা এলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় সরকার। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুজাতিক এই সংস্থার সমালোচনা আসে।

তখনই ২০১২ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, “পদ্মা সেতু করার জন্য দেশে আমাদের ১৬ কোটি মানুষ আছে, ৮০ লাখ প্রবাসী আছে। বাংলার মানুষ সারা জীবন কি অন্যের সাহায্যে চলবে? নিজের পায়ে দাঁড়াবে না? আত্মনির্ভরশীল হবে না? পদ্মা সেতু আমরা করবই।”

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর ঘোষণা সারাদেশে যে সাড়া ফেলেছিল, তাতে অভিভূত হন প্রধানমন্ত্রী নিজেও।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে নিতে বাজেট থেকে বরাদ্দ দিতে শুরু করে সরকার। অর্থ বরাদ্দ প্রথম আসে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছর থেকে। এর আগে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ব ব্যাংককে জানিয়ে দেয়া হয় যে, এই প্রকল্পের জন্য তাদের ঋণ নেওয়া হবে না।

পদ্মা সেতুর নকশা ঠিক রেখেই এরপর শুরু হয় সেতু নির্মাণের বাকি কাজগুলো। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ দেয় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। পরের বছরগুলোতেও প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ দিয়ে গেছে সরকার।

২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মূল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

এএইচএস