ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার অমর কীর্তি

তাপস হালদার

প্রকাশিত : ০৪:০৯ পিএম, ২৫ জুন ২০২২ শনিবার

বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।আর স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এ যাবৎকালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থাপনা হলো পদ্মা সেতু। এই সেতু বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে যেভাবে দেশি-বিদেশি শত্রুদের মোকাবেলা করতে হয়েছিল, ঠিক তেমনিই পদ্মা সেতু তৈরি করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের মোকাবেলা করতে হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই অশুভ শক্তির পরাজয় হয়েছে। সত্য, সুন্দর ও ন্যায় শক্তির বিজয় হয়েছে।

দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ হাতে নেন, তারমধ্যে অন্যতম ছিল পদ্মা নদীতে একটি সেতু নির্মাণ। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে তিনি ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর পদ্মা সেতুর নির্মাণের বাস্তব ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় থমকে যায় কাজের গতি। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর দাতা গোষ্ঠীর সহায়তায় সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সে মোতাবেক ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সাথে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি সই হয়। পর্যায়ক্রমে জাইকা, এডিবি ও আইডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগে বলা হয়, কানাডার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এসএনসি লাভালিন কাজ পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের সেতুমন্ত্রী, সেতু সচিব, সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ অস্বীকার করে জোর প্রতিবাদ জানানো হয় এবং আরো বলা হয়, যেখানে কোনো অর্থ ছাড়ই হয়নি, সেখানে দুর্নীতির কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। তারপরও বিশ্বব্যাংকের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টাকে বাধ্যতামূলক ছুটি, যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রীকে অপসারণ ও সেতু সচিবসহ কয়েকজনকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সরকার শুধুমাত্র বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে এত সব ব্যবস্থা নিলেও তারা সন্তুষ্ট না হয়ে বরং একবছর পর ২০১২ সালের অক্টোবরে ঋণ চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয়। বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করে জাইকা, এডিবি ও আইডিবিও ঋণচুক্তি বাতিল করে।

বিশ্বব্যাংকের শত আবদার রক্ষা করেও যখন তাদের ফেরানো যাচ্ছিল না তখনই যড়যন্ত্রের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। বয়সসীমা পার হয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ড. ইউনূসকে সরিয়ে দেওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে তিনি তার বন্ধু তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটনকে দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করেন।ষড়যন্ত্রে যোগ হয় বিএনপি, জামায়াত ও তাদের সুশীল প্রতিনিধিরা।

বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি স্থগিত করলে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করেন,‘নিজস্ব অর্থায়নেই হবে পদ্মা সেতু। মাথা নত করে কারো কাছ থেকে হাত পেতে টাকা এনে পদ্মা সেতু করব না। আমাদের জনগণের টাকায়ই নির্মিত হবে পদ্মা সেতু’। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় সেদিন দাতাগোষ্ঠী, অর্থনীতিবিদগণ, বুদ্ধিজীবীসহ তথাকথিত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা হতবাক হয়ে পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। তারা সকলেই সমস্বরে বলেছিল, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা অসম্ভব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সর্বস্তরের জনগণ সেদিন যেভাবে এগিয়ে এসেছিল, তা দেখে প্রধানমন্ত্রী আরো প্রচণ্ড রকম আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যেভাবে জনগণের মনের কথা বুঝতেন, ঠিক তার কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাও সেভাবে জনগণের অনুভূতি বুঝতে পারেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা জানতেন, এইসব তথাকথিত  বুদ্ধিজীবীদের পূর্বপুরুষেরাও একাত্তর সালে তত্ত্ব কথা বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। সাধারণ মানুষই মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে। জনগণের শক্তি নিয়েই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পদ্মাসেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন এবং তিনি সফল হয়েছেন।

ষড়যন্ত্রকারীরা চেয়েছিল দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ও শেখ হাসিনাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিপদে ফেলতে। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টোটাই হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ চুক্তি বাতিল করা সরকারের জন্য আশীর্বাদই হয়েছে। এতবড় বৃহৎ প্রকল্প যে বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে করতে পারে, তার সক্ষমতা প্রমাণ হয়েছে। যারা মনে করত বিদেশি সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশ চলতে পারবে না, পদ্মা সেতু তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশে বিশ্ব মোড়লদের মোড়লগিরিও কমে এসেছে।

কানাডার আদালতে এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ আনা হয়েছিল তা  ২০১৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আদালত বাতিল করে দেন। রায়ে আদালত বলেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা গালগপ্প ছাড়া কিছুই নয়। অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস পান। বাংলাদেশেও দুদকের তদন্তে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় আদালত আসামিদের খালাস দেন। সর্বোপরি বিশ্বব্যাংক তদন্ত করেও দুর্নীতির পক্ষে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পায়নি। এতে করে শেখ হাসিনা সরকারের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ আজ গর্ব করে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে।

সেতুর নামকরণের ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত রাজনৈতিক মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের জনগণের মধ্য থেকে সেতুর নাম ‘শেখ হাসিনা সেতু' নামকরণের জন্য প্রচণ্ডরকমের চাপ ছিল। জনগণের দাবিকে সমর্থন করে সেতু মন্ত্রণালয়ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে সে প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবটি সরাসরি নাকচ করে দেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এতবড় মহৎ অর্জনকে নিয়ে বিরোধীদের কোনো প্রকার অপরাজনীতি করার সুযোগ দিতে চাননি। পদ্মা তো শুধুমাত্র একটা নদীই নয়। এই নদীর আছে অনেক সমৃদ্ধ ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে পদ্মা নদীর নামটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন। কারণ এই পদ্মার সাথে বাঙালির আবেগ, অস্তিত্ব জড়িত। স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা স্লোগান দিয়েছে,‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা, মেঘনা যমুনা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পদ্মা নদীর সাথে তুলনা করে অন্নদা শংকর রায় লিখেছেন, ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।'

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদ্মা নদীকে ভালোবেসে লিখেছেন, ‘বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড়ো ভালোবাসি। ইন্দ্রের যেমন ঐরাবত তেমনি পদ্মা আমার যথার্থ বাহন- খুব বেশি পোষমানা নয় কিছুটা বুনোরকম,তার পরেও পরম যতনে হাত বুলিয়ে ওকে আদর করতে ইচ্ছে করে।’ কিছুটা আক্ষেপ করে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,‘পদ্মার ঢেউ রে/মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যা রে......।’ শিল্পী আবদুল আলীম গেয়েছেন,'সর্বনাশা পদ্মা নদী/তোর কাছে শুধাই/বল আমারে তোর কিরে আর/কূলকিনারা নাই।' কন্ঠশিল্পী ভুপেন হাজারিকা তো পদ্মাকে মা সম্বোধন করে গেয়েছেন, ‘গঙ্গা আমার মা/পদ্মা আমার মা/ও আমার দুই চোখের দুই জলের ধারা মেঘনা যমুনা।'

এছাড়াও পদ্মা নদীকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে অনেক গান, কবিতা, উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। পদ্মা নদী বাংলাদেশের অহংকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ‘পদ্মা সেতু’ নামকরণ করে পদ্মা নদীকেই সারা বিশ্বে আরেক বার নতুনভাবে তুলে ধরেছেন।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সগৌরবে যাত্রা শুরু করলো পদ্মা সেতু। এই সেতু বাংলাদেশের আত্মমর্যাদার ও সততার প্রতীক। সক্ষমতা, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সততা, অদম্য সাহস, স্বাধীনচেতা মনোভাব, দূরদর্শী পরিকল্পনা ও সর্বোপরি দেশের প্রতি ভালোবাসা এই সেতু তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে একমাত্র কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। যতদিন পদ্মা সেতু থাকবে, ততদিন এই সেতুর সাথে মিশে থাকবে শেখ হাসিনার নাম। পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার অমর কীর্তি হিসেবে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এসি