মুম্বাই হামলার মূলহোতা সাজিদ মীরকে নিয়ে পাকিস্তানের কেন লুকোচুরি?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৬:১৮ পিএম, ৫ জুলাই ২০২২ মঙ্গলবার
আড়ালে থাকা বিষয়টি হুট করে চলে এসেছে সামনে। সম্প্রতি পাকিস্তানের গণমাধ্যমে চাউর হয়েছে চৌদ্দ বছর আগে ২০০৮ সালে ভয়াবহ মুম্বাই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী সাজিদ মীরকে অন্য একটি মামলায় সাজা দিয়েছে পাকিস্তানের একটি আদালত। যদিও গণমাধ্যমে খবরটি এসেছে দেরিতে।
কিন্তু যে ব্যক্তিকে কখনও গ্রেপ্তার, কখনও মৃত বলে দাবি করা হয়েছে, তার এমন আচমকা সাজা হওয়া আর বিষয়টি অনেক দেরিতে গণমাধ্যমে আসা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
ইউরোপিয়ান ফাউন্ডেশন ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে এমন লুকোচুরিতে আভাস মেলে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরাসরি নয়, বরং দ্বিমুখী নীতিতেই আছে পাকিস্তান।
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাইয়ে ভয়াবহ এক জঙ্গি হামলা কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকে।
পাকিস্তানের করাচি থেকে জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার ১০ জন জঙ্গির একটি দল একটি ভারতীয় মাছ ধরার একটি নৌকা জিম্মি করে ক্যাপ্টেনকে হত্যার পর ওই ডিঙ্গিতে করে মুম্বাই যায়। এরপর দলটি পরিকল্পিতভাবে মুম্বাইয়ের তাজ হোটেল, একটি রেল স্টেশন, হাসপাতাল এবং ইহুদি কমিউনিটি সেন্টারে হামলা করে। সশস্ত্র ওই হামলায় মোট ১৬৬ জনকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানের হ্যান্ডলাররা ফোনের মাধ্যমে এই সব হামলা পরিচালনা করেছিল, যাদের মধ্যে সাজদি মীরও ছিলেন।
মুম্বাই হামলার বিষয়ে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ছিল অবাক করার মতো। ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তান জড়িত রয়েছে- দিল্লির এমন অভিযোগ খারিজ করে ইসলামাবাদ।
পরে পাকিস্তানি দৈনিক ডন একটি নিবন্ধে সন্ত্রাসী হিসাবে সাজিদ মীরের জীবনী তুলে ধরেছিল। যেখানে লেখা হয়েছিল, জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি) এবং হাফিজ সাইদের সাথে তার সম্পর্ক ১৯৯৪ সাল থেকে, যখন মীরের বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। সেখান থেকে তিনি সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় উঠেছিলেন এবং যুক্ত হয়েছিলেন এর আন্তর্জাতিক অপারেশন শাখার সাথে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মীর এলইটির আন্তর্জাতিক অপারেশনের ডেপুটি চিফ ছিলেন এবং তিনি জাকি-উর-রহমান লাখভির কাছে সরাসরি যোগাযোগ করতেন। লাখভি সমস্ত নাশকতা অভিযানের প্রধান হোতা ছিলেন বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক অভিযান পরিচালনা করার সময় সাজিদ মীর আল-কায়েদার সাথেও যুক্ত হয়েছিলেন।
২০০২ সালের প্রথমদিকে ভার্জিনিয়াভিত্তিক সহযোগীদের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় সামরিক সরঞ্জাম কেনার চেষ্টা করেছিলেন মীর, যে কারণে তখন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের তালিকায় তার নামও এসেছিল। তবে সে সময় এফবিআই ১১ জনকে গ্রেপ্তার করার তাদের কর্মকাণ্ড স্তিমিত হয়ে পড়ে। এরপরেই মীর অস্ট্রেলিয়ার দিকে নজর দেন।
২০০৩ সালে মীর একজন ফরাসী নাগরিক উইলি ব্রিজিট এবং একজন অস্ট্রেলিয়ান ফাহিম খালিদ লোধির সহায়তায় অস্ট্রেলিয়ায় হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন।
এই হামলার পরিকল্পনার জন্য ২০০৬ সালের জুন মাসে একটি অস্ট্রেলিয়ান আদালত লোধিকে দোষী সাব্যস্ত এবং ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। একই অপরাধে ২০০৩ সালে ফরাসি আদালত নয় বছরের কারাদণ্ড দেয় ব্রিজিতকে। সে সময়ও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান সাজিদ মীর।
ডন এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাহোরে জন্মগ্রহণকারী মীর তখন থেকেই মুম্বাই হামলার পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন।
আইএসআইয়ের খাস লোক মীর আচমকা কেন গ্রেপ্তার?
এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় নাম রয়েছে সাজিদ মীরের, যাকে কয়েক দশক ধরে খোঁজা হচ্ছিল। এরপরেও বহু বছর ধরেই পাকিস্তানের মাটিতে তার অবস্থানের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছিল দেশটির সরকার। এক পর্যায়ে মীর মারা গেছেন বলেও প্রচার করা হয়েছিল।
বিশ্লিষকরা বলছেন, সন্ত্রাসে মদদ দেয়, সন্দেহভাজন এমন দেশগুলোর যে তালিকা ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের (এফএটিএফ) রয়েছে, মূলত তা থেকে বের হতেই পাকিস্তান সরকার মীরকে গ্রেপ্তার করেছে।
এই এফএটিএফ সংস্থাটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন ও মুদ্রাপাচার রোধে কাজ করে।
এই তালিকায় কোনো দেশের নাম ওঠার অর্থ হচ্ছে, এফএটিএফ জাতিসংঘসহ অন্যান্য বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোকে সংশ্লিষ্ট ওই দেশটির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরামর্শ দিচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই, বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে ধুঁকতে থাকা পাকিস্তান সেই তালিকা থেকে নিজেদের মুক্ত এবং এফএটিএফের কাছে ইতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি করতেই তড়িঘড়ি করে সাজিদ মীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।
পাকিস্তানের সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী হাম্মাদ আজহার গত তিন বছর ধরে বিভিন্ন সংস্থারর সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চিত করেছিলেন, তিনি সাজিদ মীরসহ অন্যান্য সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।
এই বিষয়টিই ইতিবাচক হিসেবে নেবে ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স। তাদের কাছে বিষয়টি সন্তোষজনক বলে মনেও হয়েছে।
বিষয়টি অবগত আছেন পাকিস্তান সরকারের এমন আরেক সাবেক কর্মকর্তা বলেছেন, পাকিস্তান ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নিশ্চিত করেছে, সাজিদ মীর নামে একজন ব্যক্তি, যিনি মুম্বাই হামলায় জড়িত ছিলেন এবং যাকে পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে মৃত বা শনাক্ত করা যাচ্ছে না বলে জানত, তাকে অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেছে।
সাজিদ মীরকে গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ্যে আসে গত এপ্রিলে। বলা হয় তারপর থেকেই তিনি ছিলেন পাঞ্জাবের কোট লখপত জেলে। সন্ত্রাসে অর্থ জোগান দেওয়ার একটি মামলায় তাকে ১৫ বছর সাজা দিয়েছে আদালত। যদিও মীরের গ্রেপ্তার নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি পাকিস্তান প্রশাসন। ফলে খবরটির সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে, আচমকা আইএসআইয়ের খাস লোক মীরকে কেন গ্রেপ্তারের কথা বলা হচ্ছে? জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে আর্থিক মদদ দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালেই পাকিস্তানকে তালিকাভুক্ত করে এফএটিএফ। এই বিষয়ে সংস্থার পক্ষ থেকে পাকিস্তান সরকারকে একাধিকবার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। সেই সময় বলা হয়েছিল, আগামী দিনে তাদের (পাকিস্তান) বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এদিকে ‘পুরনো পাকিস্তান’ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইমরান খানকে গদিচ্যুত করলেও সরকার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। এ পরিস্থিতিতে বিদেশ থেকে আর্থিক সহায়তা পেতে হলে ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের সবুজ সংকেত চাই। তাই মীরের গ্রেপ্তারের খবর প্রহসনও হতে পারে বলে মত বিশ্লেষকদের।
এএইচএস/এমএম