ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

কেন প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করতে চায় কোন কোন মানুষ?

একুশে টেলিভিশন  

প্রকাশিত : ০৯:১৪ এএম, ৭ জুলাই ২০২২ বৃহস্পতিবার

রাজধানীতে সম্প্রতি এক ব্যক্তি প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন, এর একদিন পর তিনি মারা যান। এর আগে নায়ক রিয়াজের শ্বশুর ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান ফেসবুক লাইভে এসে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করার এসব ঘটনা মানুষের মনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।

ফেসবুক লাইভে গুছিয়ে শান্ত গলায় ১৬ মিনিটের বেশি সময় কথা বলেছেন আবু মহসিন খান। কথা বলার সময় তিনি সুস্থির ছিলেন।

তার চোখের চশমার কাঁচ ঝাপসা দেখাচ্ছিল। নিজের পরিচয় দিয়ে কথা শুরু করেন। পরিবারের কয়েকজন সদস্যের প্রতি তিনি সংক্ষুব্ধ সেটি তার কথায় প্রকাশিত হয়েছে।

ব্যবসায় কীভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন সেটি তিনি বিস্তারিত তুলে ধরেন। কথার মাঝে তিনি অনেকবার ছোট বড় বিরতি নেন।

তার গলার স্বর বুজে আসছিল মাঝে মাঝে। দুইবার কলেমা পড়েছেন, বিড়বিড় করে সুরা পাঠ করেছেন।

যে পিস্তলটি ব্যাবহার করে তিনি নিজের প্রাণ শেষ করে দেবেন সেটি যে বৈধ তাও তিনি নিশ্চিত করেন ফেসবুক লাইভে সেটির লাইসেন্স প্রদর্শন করে।

প্রেসক্লাবে আগুনে আত্মাহুতি

৪ই জুলাই প্রেসক্লাবের সামনের খোলা চত্বরে এক ব্যক্তি হঠাৎ করেই নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি হাত পা ছড়িয়ে নিথর পড়ে আছেন।

তার সারা শরীরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। এসময় আশেপাশে লোকজন ছুটে গিয়ে তার গায়ে পানি ঢেলে আগুন নেভান।

যদিও ততক্ষণে তার শরীরের অনেকটা অংশ পুড়ে যায়।

একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তার গায়ে পানি ঢালা হচ্ছে, পরিধেয় কাপড় পুড়ে গিয়ে উলঙ্গপ্রায় হয়ে আছেন তিনি।

পঞ্চাশ বছর বয়সী ঐ ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আনিসুর রহমান ওরফে গাজী আনিস। পেশায় তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন।

আনিসুর রহমানের ভাই নজরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, তার ভাই প্রথমে গাড়ির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। পরে সেটা ছেড়ে হেনোলাক্সের মালিকের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন।

সেখানে প্রতারণার শিকার হওয়ার পর সোমবার নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন।

এরপর তাকে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার ভোরে সেখানেই মৃত্যু হয় তার।

গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় এক যুবক ফেসবুক লাইভে এসে গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

মাধবপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক গোলাম কিবরিয়া ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, অন্তর দাস নামে ঐ যুবক তার শয়ন কক্ষে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন সুবিধাজনক স্থানে রেখে ফেসবুকে ভিডিও লাইভ ছেড়ে দড়ি দিয়ে নিজেই নিজের গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন।

পুলিশ বলছে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথোপকথন দেখে ধারণা করা হচ্ছে- প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অন্তর দাস লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছেন।

ক্ষোভ প্রকাশ এবং মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড.মেহজাবীন হক বলেন, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করতে চাচ্ছেন সেই ব্যক্তি যে মরে যেতে চাচ্ছেন সেটা শতভাগ নিশ্চিত।

প্রকাশ্যে আত্মহত্যাকারী মানুষদের সম্পর্কে তিনি বলেন "তিনি সমাজের উপর ক্ষিপ্ত থাকতে পারেন, রাষ্ট্রের উপর ক্ষিপ্ত থাকেন পারেন। যেটার তিনি মোকাবেলা করতে পারেননি। মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক যে প্রবণতা থাকে যে মানুষ আমার কথা শুনবে, আমাকে মূল্য দিবে, আমার দিকে তাকাবে এই ব্যাপার গুলোর ঘাটতি- যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করেন তিনি অনুভব করেন।"

"তখন তিনি এমন একটা কাজ করে যেতে চান, যাতে করে সবার মনোযোগ পেতে পারেন। সবাই যাতে তাকে মূল্য দিতে বাধ্য হয়। ঘরের ভিতর আত্মহত্যা করলে সেটা হয়ত কেউ জানলো, কেউ জানলো না, তারপর মানুষ ভুলে গেল।"

"কিন্তু প্রকাশ্যে যখন ঘটনা ঘটছে তখন কিন্তু বুঝতে হবে তিনি শুধু মরেই যেতে চাচ্ছেন না, মরে যাওয়ার সাথে সাথে অন্য কারো উপর রাগ, আক্রোশ প্রকাশ করে যাচ্ছেন। কারণ তিনি জানেন এভাবে কাজটা করলে তিনি পত্রিকার শিরোনাম হবেন, টিভিতে খবর হবে। অনেক সময় অন্যকে শিক্ষা দেয়ার জন্য এই পদ্ধতি এরা বেছে নেন।"

উপার্জনের চাপ
'কান পেতে রই' বাংলাদেশে মানসিক সহায়তা বিষয়ক একটি হেল্পলাইন। বেসরকারি এই সংস্থাটি বলছে, ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে এবছরের ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত তাদের হেল্পলাইনে ফোন করে কাউন্সেলিং চেয়েছেন প্রায় ১৩ হাজার মানুষ।

তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। এই পুরুষদের মধ্যে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি কল করেছেন।

সংস্থাটির সমন্বয়ক অরুণ দাস বলছেন, বেশিরভাগই তাদের মানসিক কষ্টের উৎস হিসেবে উপার্জনের চাপের কথা উল্লেখ করেন।

"তাদের একটা বড় অংশ সম্পর্ক নিয়ে সমস্যার কথা বলেন এবং মূলত মেয়েরাই এবিষয় নিয়ে বেশি কথা বলেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে কাজ বিষয়ক ইস্যু বেশি পাওয়া যায়- কারো হয়ত চাকরি চলে গেছে, অর্থনৈতিক অসুবিধার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, যে কারণে মানসিক চাপ- এসব বিষয় নিয়ে পুরুষরা কল বলেন বেশি। আর একটা বিষয়ে পুরুষদের কাছ থেকে আমরা কল পাই সেটা হচ্ছে অ্যাডিকশন।"

অধ্যাপক ড.মেহজাবীন হক বলছেন প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করার একটা ঘটনা সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়।

তিনি বলেন "আরো ভয়াবহ ব্যাপার হল যারা হতাশায় ভুগছেন তাদের কাছে এটা একটা অনুসরনীয় 'ওয়ে আউট' হিসেবে কাজ করে।"

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসবি/