ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

ইউক্রেন যুদ্ধ: খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতে গমের বিকল্প

একুশে টেলিভিশন  

প্রকাশিত : ০৯:০৬ পিএম, ১৩ জুলাই ২০২২ বুধবার | আপডেট: ০৯:৩০ পিএম, ১৩ জুলাই ২০২২ বুধবার

ইউক্রেনের রুশ হামলার পর থেকে বিশ্বব্যাপী গমের সরবরাহে টান পড়েছে। প্রতিকূল আবহাওয়ায় ফসল তোলাও মুশকিল। সেক্ষেত্রে যে কোনো জলবায়ুতে ফলন সম্ভব প্রাচীন এমন সব শস্যগুলি আরো বেশি খাদ্য নিরাপত্তা দিতে পারে।

ইউক্রেনের যুদ্ধ পারস্পরিক নির্ভরতা বুঝিয়েছে আমাদের। শুধুমাত্র রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি নয়, ওই এলাকার বিশাল ফলনের উপরেও যে সারা বিশ্ব নির্ভর ছিল তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে।

বিশ্বের প্রথম এবং পঞ্চম শীর্ষ গম রপ্তানিকারক দেশ হলো রাশিয়া এবং ইউক্রেন । দুটি দেশ একসঙ্গে সারা বিশ্বের ২০ শতাংশেরও বেশি শস্য সরবরাহ করে।

বিশ্বের শীর্ষ গম আমদানিকারক মিশরসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ। তাদের ৮০ শতাংশ শস্য রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু যুদ্ধের ফলে খরচ আকাশছোঁয়া। সরবরাহ কমে গিয়েছে, তাই সেখানে রুটির দামে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি অনুসারে, যুদ্ধের কারণে শস্য ঘাটতি হয়েছে। ফলে চলতি বছরে সাহেল এবং পশ্চিম আফ্রিকায় "খাদ্যের জন্য নজিরবিহীন জরুরি অবস্থা" তৈরি হয়েছে। কেনিয়া, সোমালিয়া এবং ইথিওপিয়ার বেশিরভাগ এলাকা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন, এছাড়াও খরার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে পশ্চিম আফ্রিকা তীব্র সংকটে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে খাদ্য ঘাটতি আরো অসহনীয় হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াসের জন্য গমের ফলন সাত শতাংশ কমে যেতে পারে। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়াও একটা বড় কারণ, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা গত সপ্তাহেই সতর্ক করেছিলেন।

খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে রুখতে মিশরের মতো দেশগুলি দেশীয় উৎপাদনে জোর দিচ্ছে। এখন মিশরের মরুভূমিতেও গম রোপণ করা হচ্ছে, যদিও তাতে সার এবং জলের অভাব রয়েছে।

সাধারণ গম গাছের শিকড়গুলি অগভীর। তাই খরার জন্য গম বেশি সংবেদনশীল। কিন্তু মানুষের খাবারের প্রায় ২০ শতাংশ ক্যালোরি আসে এই গম থেকেই। এদিকে, গম অত্যন্ত জনপ্রিয় কারণ এটি উচ্চ ফলনশীল। গম থেকে সাদা আটা তৈরি হয়, যেগুলি প্রক্রিয়াজাত খাবার তৈরিতে কাজে লাগে।

যুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গমের সরবরাহ কমেছে। ফলে স্থানীয় এলাকায় জন্মাতে পারে এমন টেকসই শস্যের বিপুল বৈচিত্র্য তৈরির চেষ্টা বেড়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে একাধিক প্রাচীন প্রজাতি যেগুলি চরম আবহাওয়ায় মানিয়ে নিতে পারে। এখানে চারটি বিকল্প শস্যের কথা বলা হলো যেগুলি গমের উপর আমাদের নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করতে পারে।

আইনকর্ন

তথাকথিত সাধারণ গম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার আগে আইনকর্নের মতো কিছু "ঐতিহ্যবাহী" শস্য নানা ধরনের মাটি এবং আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছিল। সারা বিশ্বের সুপারমার্কেটে এটি পাওয়া যায়।

আইনকর্ন একটি টেকসই শস্য যা নানারকম রুটি বেক করতে সারা বিশ্বেই গমের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

নিওলিথিক যুগে, আইনকর্নকে "আসল গম" বলা হতো। আধুনিক গমের তুলনায় এটি আরো বেশি রোগ প্রতিরোধী। সাধারণ বাণিজ্যিক গমের তুলনায় এতে ৩০ শতাংশ বেশি প্রোটিন, ১৫ শতাংশ কম স্টার্চ এবং কম গ্লুটেন রয়েছে। এটির স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো।

দক্ষিণ জার্মানির হোহেনহেইম বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিজ্ঞানী ফ্রেডরিখ লঙ্গিন বলেন, "আইনকর্ন অনন্য কারণ এতে গমের দ্বিগুণ খনিজ রয়েছে, যা পুষ্টির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।" কিন্তু আধুনিক গমের তুলনায় দ্বিগুণ পুষ্টিকর হলেও এর ফলন প্রায় অর্ধেক।

অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ইটালি, হাঙ্গেরি এবং ফ্রান্সের অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে কম পরিমাণে জন্মায় এই শস্য। খানিক অনুর্বর এবং প্রান্তিক এলাকার মাটিতে এর মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা দারুণ। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, সাধারণ গমের তুলনায় প্রাচীন শস্যটির "রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্দান্ত"।

বুনো এমার

প্রাচীন "এমার" গম হল আরেকটি ঐতিহ্যবাহী শস্য যা বর্তমান শস্য সংকটে আবার ফিরে আসতে পারে। আইনকর্নের চেয়ে বেশি ফলন হয় এটির। কেউ কেউ বলেন, রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার শস্যটি ভালবাসতেন তাই এটিকে রোমান সাম্রাজ্য জুড়ে রোপণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। চরম জলবায়ুতে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা এবং এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুটিই রয়েছে এমারের।

ইসরায়েলে ২৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা চলছে এই নিয়ে। তাতে দেখা গিয়েছে বুনো এমারের প্রজাতি পরিবর্তিত জলবায়ুকে প্রতিরোধ করতে করতে পাল্টে গিয়েছে। এই সময়সীমায় তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি বাড়লেও তারা মানিয়ে নিয়েছে।

গবেষকরা বলছেন, উচ্চ ফাইবারবিশিষ্ট বুনো এমার "জেনেটিক্সের সেরা আশাপ্রদ বিষয়"। আধুনিক গমের প্রজাতির উন্নতির জন্য এটি কাজে লাগতে পারে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনে মানিয়ে নেয়া এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা এমারের অনেক বেশি।

প্রাচীন রোমে রুটি তৈরির অবিচ্ছেদ্য উপাদান ছিল এটি। অথচ, এমারের বীজ তুলনামূলকভাবে দুষ্প্রাপ্য। ইউরোপজুড়ে পার্বত্য অঞ্চলে জন্মানো শস্য থেকে ময়দা ব্যবহার করা হয়। তবে, বেকিংয়ের জন্য সুইজারল্যান্ড এবং ইটালি এটি ব্যবহার করে। পাস্তাও তৈরি করা হয়।

কার্নজা

এটি মৌসুমী ফসল। অর্থ ফসল কাটার পরে গাছটি মরে যায় এবং প্রতি বছর রোপণ করতে হয়। এটির শিকড়বাকড় অগভীর। তাই এটি ভূগর্ভস্থ কার্বনকে আলাদা করতে খুব একটা কার্যকর নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসে অবস্থিত টেকসই কৃষি এনজিও দ্য ল্যান্ড ইনস্টিটিউট প্রতিষেধক হিসাবে কার্নজা নামে নতুন একটি বহুবর্ষজীবী শস্য তৈরি করেছে।

গমগাছের অন্য রূপ (ডেরিভেটিভ) এই কার্নজার শিকড় ১০ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। উদ্ভিদটি বাতাস থেকে অনেক বেশি পরিমাণ কার্বন বিচ্ছিন্ন করতে পারে। এর দীর্ঘ শিকড় ক্ষয় প্রতিরোধ করে মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখে।

এই শস্য বহুবর্ষজীবী হওয়ায় আরো বেশি জীববৈচিত্র্য আসে মাটিতে। খরা-প্রতিরোধী মাটি তৈরি করতে সাহায্য করে এটি।

কয়েক দশক ধরে তৈরি করা এই হাইব্রিড শস্য ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডাতে ব্যবহার হচ্ছে। বেকিং কোম্পানি, শেফ এবং পানীয় প্রস্তুতকারকরা ব্যবহার করছেন।

ল্যান্ড ইনস্টিটিউট কার্নজাকে "সহজাতভাবে পুনরুৎপাদনশীল" বলে উল্লেখ করেছে।

২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডাজুড়ে চার হাজার একর গম চাষ হয়েছিল, যা ২০১৯ সালে তুলনায় বেড়েছে (৫০০ একর) বিশ্বব্যাপী শস্য সংকটের মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে।

বাজরা

নাইজেরিয়ার অ্যালেক্স একউয়েমে ফেডারেল ইউনিভার্সিটির কৃষি অর্থনীতিবিদ রবার্ট ওনিয়েনেকের মতে, এশিয়া এবং আফ্রিকার কয়েক লাখ মানুষের প্রধান খাদ্য বাজরা। এটি চরম প্রতিকূল জলবায়ুতেও বেঁচে থাকতে পারে। এই ফসল পাকতে কম সময় লাগে এবং কার্বন নিঃসরণও কম।

শস্যটির অনেকগুলি প্রজাতি রয়েছে। তাপ এবং খরার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এটি। গম, চাল বা ভুট্টার তুলনায় চাষের সময় অনেক কম জল লাগে। সারা বিশ্বে এটির ফলন সম্ভব।

২০২৩ সালকে আন্তর্জাতিক বাজরা বছর ঘোষণা করেছিল জাতিসংঘ। তখন তা পশ্চিমা বিশ্বের নজরে আসে। অনেক দেশে চাষাবাদ কমে গিয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে "জলবায়ু পরিবর্তন এবং খাদ্য নিরাপত্তা মোকাবেলায় বাজরার সম্ভাবনা তাই পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে না।"

এসবি/