জননী সাহসিকা, আলোকবর্তিকা
ফারজানা মাহমুদ
প্রকাশিত : ০৯:১২ এএম, ৮ আগস্ট ২০২২ সোমবার | আপডেট: ০৯:১৬ এএম, ৮ আগস্ট ২০২২ সোমবার
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব একজন সাহসী, দেশপ্রেমী, মানবিক, বিনয়ী, আত্মপ্রত্যয়ী এবং ত্যাগী নারীর প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগ্রামের প্রতিটি স্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে থেকে যিনি একনিষ্ঠভাবে কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই কাজ করে গেছেন, তিনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী কিংবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদাত্রী মা হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ নন, শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব তাঁর স্বীয় গুণে একজন আলোকিত মানুষ এবং অসংখ্য অনুপ্রেরণার উৎস।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন একটা না থাকলেও শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জীবনবোধ এবং অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞান ছিল অসামান্য। আর সে কারণেই শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপগুলোতেও সক্ষিয় অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন। কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন। যেমন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে কি ধরনের ভাষণ দেবেন তা নিয়ে যখন নানাজন বঙ্গবন্ধুকে নানারকম পরামর্শ দিচ্ছিলেন, বঙ্গমাতা তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন- “যা মনে আসে তাই” যেন বঙ্গবন্ধু বলেন। বঙ্গমাতার এই আশ্বস্ততা বঙ্গবন্ধুকে শুধু “রাজনীতির কবি” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেনি, বাঙ্গালী জাতিকে দিয়েছে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার মূলমন্ত্র।
বঙ্গমাতার দূরদর্শিতা, প্রখর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং অনমনীয়তা তাঁর অনেক সিদ্ধান্তে প্রমাণিত হয়। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হলে, বঙ্গবন্ধু আইনিভাবে সেটি মোকাবেলার প্রস্তুতি নেন। বঙ্গবন্ধুকে এই মামলায় গ্রেফতার করার পর বাঙ্গালীরা রাজপথে বিক্ষোভে নামে তাঁর মুক্তির দাবিতে। পরিস্থিতি অনুকূলে নয় বুঝে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে যখন প্যারোলে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লাহোরে যেতে নিষেধ করেন। বঙ্গমাতা তাঁর দূরদর্শিতা ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়ে ঠিকই অনুধাবন করেছিলেন যে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হবে, কারণ শেখ মুজিবের ব্যাপারে বাঙ্গালী অনঢ় ও ঐক্যবদ্ধ।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব সাহসী ছিলেন বটে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে শত ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে ৫টি সন্তানের দেখভাল করেছেন, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মামলাগুলো তদারকি করেছেন, গোপনে কর্মীদের কাছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্যে মাঠ পর্যায়ে আন্দোলন গড়তে শ্রম দিয়েছেন আবার নিজ হাতে বাড়ির দেয়ালে ইটও গেঁথেছেন।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্যে নিজের জীবনসঙ্গী এমনকি সন্তানদেরকেও বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন, এমনই ছিল তাঁর দেশপ্রেম। বঙ্গমাতার দুই সন্তান শেখ কামাল এবং শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। জননী সাহসিকা বলেই সন্তানদের দেশের স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধে যেতে নিরুৎসাহিত করেননি। জাতির জন্যে তাঁর অপরসীম ত্যাগ, সহমর্মিতা আর বিচক্ষণতা তাঁকে শুধু বঙ্গমাতা হিসেবেই নয় আমাদের ইতিহাসেরও এক অবিচ্ছেদ্য অংশে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
জীবনবোধ যখন গাঢ় হয় এবং মননে থাকে প্রজ্ঞা, মানুষ তখন পার্থিব চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে যায়। শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব তেমনি একজন মানবী যিনি অসাধারণ সব কাজ করেছেন কিন্তু থেকেছেন অতি সাধারণের মতো। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির স্ত্রী কিন্তু অনাড়ম্বর তাঁর জীবন। পরনে তাঁর অতি সাধারণ শাড়ী, সদা হাস্যময় মুখ আর সংসারের প্রতি মমত্ববোধ ও দায়িত্ব – এসবই বাংলার যেকোনো সাধারণ নারীর প্রতিচ্ছবি। বেশভূষায় বা চলনে সাধারণ এই নারী যে অসামান্য দেশপ্রেমী ও মানবিকগুণের অধিকারী তার প্রমাণ মেলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যুদ্ধে নির্যাতিতা বীরঙ্গনাদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি দেখে। বীরঙ্গনাদের পুনঃবাসনে বঙ্গমাতা অগ্রণী ভূমিকাই শুধু রাখেননি, তিনি নিজেকে বীরঙ্গনাদের মা বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব নির্যাতিতা নারীদের আত্মমর্যাদাবোধ বৃদ্ধি এবং তাঁদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্যে কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন- “এই বীরঙ্গনা রমনীদের জন্যে জাতি গর্বিত”। (দৈনিক বাংলার বাণী, ১৭ ফাল্গুন, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ)। বঙ্গমাতা জাপান, রাশিয়া, ভারত ও জার্মানিসহ অনেক দেশ থেকে চিকিৎসক এনে মর্যাদার সাথে যুদ্ধে নির্যাতিতা নারীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করেছেন ও সামাজিক পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছেন। অসংখ্য শহীদ পরিবারের সদস্যদের লেখাপড়ার দায়িত্বও তিনি নিয়েছিলেন।
শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে থাকেননি বরং সাহসী পদক্ষেপে বাঙ্গালীর মুক্তির সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নে কাজ করেছেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী ৬ দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে ৬ দফা না ৮ দফা তা নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত হন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী ৬ দফাতেই অটল থেকে তা বাস্তবায়নে বঙ্গমাতা নিরলস চেষ্টা চালান। এমনকি ৬ দফার বাস্তবায়নে বোরখা পরে তিনি জনসংযোগও করেন। আবার দুর্দিনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জন্যে নিজের অর্থ বিলিয়ে দিয়েছেন, দিয়েছেন চিকিৎসা সহায়তা। নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণকেও তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মহিলা আওয়ামী লীগ গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একজন দক্ষ সংগঠকের মতো, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতে, আওয়ামীলীগের কর্মীদের তিনি ঐক্যবদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছেন।
বঙ্গমাতা শুধু বঙ্গবন্ধুর আদর্শই অনুসরণ করেননি, তিনি নিজে একজন আধুনিক মানুষ ছিলেন। একজন আধুনিক, আত্মপ্রত্যয়ী, প্রগতিশীল মানুষই নিজের চাহিদা কিংবা ইচ্ছার বাইরে গিয়ে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকে সম্মান করতে পারে, অন্যের স্বাধীন সত্তাকে স্বীকৃতি দিতে পারে। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের একটি চিঠি থেকে তাঁর আধুনিক মনের প্রমাণ মেলে, যেখানে তিনি নিজের অসুস্থতাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও রাজনৈতিক দায়িত্বের পথে বাঁধা হতে দেননি। দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় কাজ করতে উৎসাহ দিয়ে বলেছেন- “আপনি শুধু আমার স্বামী হবার জন্যে জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যে জন্ম নিয়েছেন।.........আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজ করে যান”। (আমার রেণু, পৃঃ ৯৫)। একজন কিশোরীর এই জীবনবোধ, আধুনিক মনন এবং সুদূরপ্রসারী ভাবনা অনন্যসাধারণ নয় কি?
বঙ্গবন্ধুকে তাঁর আত্মজীবনী লেখার জন্যে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন বঙ্গমাতা। জেলগেটে বঙ্গবন্ধুকে খাতা দিয়ে বলেছিলেন- “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী”। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃঃ ১)। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অনুপ্রেরণা আর দূরদর্শিতায় জাতীর জন্যে অমূল্য সম্পদ, মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস, লিপিবদ্ধ করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব যেমন বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ভালোবাসতেন তেমনি ভালোবাসতেন বাংলার মাটি ও মানুষ। বঙ্গমাতার দেশপ্রেম তাঁকে ত্যাগ স্বীকার করতে বাঁধা দেয়নি। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে নিজেই বলেছেন তাঁর জীবনে বঙ্গমাতার কত ত্যাগ আর অবদান। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- “রেণু (বঙ্গমাতার আরেকটি নাম) খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্যে টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়”। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃঃ ১২৬)। তাঁর ত্যাগ, শর্তহীন ভালবাসা আর দূরদর্শিতায় শেখ মুজিবুর রহমান “খোকা” থেকে “বঙ্গবন্ধুতে” পরিণত হবার দীর্ঘ যাত্রায় হতাশ বা ক্লান্ত হননি। আজ, ৮ আগস্ট অনন্য সাধারণ নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক: আইনজীবী ও গবেষক।