ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

প্রসঙ্গ: বঙ্গমাতার জন্মদিন 

আনিস মুহম্মদ 

প্রকাশিত : ০৯:২২ এএম, ৮ আগস্ট ২০২২ সোমবার | আপডেট: ০৯:৩১ এএম, ৮ আগস্ট ২০২২ সোমবার

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুনিরা হত্যা করে। জাতির পিতাকে হত্যার পর হত্যাকারীরা বঙ্গমাতাকেও হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী মরণকালেও সঙ্গী হয়ে রইলেন।

ঘাতকের আঘাতে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, একজন মুসলিম নারী হিসেবে যা তাঁর প্রাপ্য তাও তো তিনি পাননি। কাফন-দাফনটুকুও তাঁকে দেয়া হয়নি। সকল শহীদ স্বজনদের মতো রক্তাক্ত পরনের কাপড় নিয়ে শহীদি মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন দেশের স্বাধীনতাসহ বঙ্গবন্ধুর সব লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলনের নেপথ্যের প্রেরণাদানকারী ছিলেন ফজিলাতুননেছা মুজিব। তিনি বঙ্গবন্ধুর সমগ্র রাজনৈতিক জীবন ছায়ার মতো অনুসরণ করে তার প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অফুরান প্রেরণার উৎস হয়ে ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু যখন বারবার পাকিস্তানি শাসকদের হাতে বন্দি জীবনযাপন করছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ফজিলাতুননেছা মুজিবের কাছে ছুটে আসতেন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা জানতে। তিনি তাদের বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিকনির্দেশনা পৌঁছে দিতেন এবং লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগাতেন। 

বিশেষ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তি নিয়ে কিছু কুচক্রী স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল, তখন প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে বেগম মুজিবের দৃঢ়চেতা অবস্থান বাংলার মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছিল, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

জাতির পিতার আমৃত্যু সঙ্গী, বাংলার মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামেম জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম ছিল রেণু। বঙ্গবন্ধু তাকে এ নামেই ডাকতেন। তাঁর পিতার নাম শেখ জহুরুল হক এবং মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। এক ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। তিনি ৫ বছর বয়সেই পিতামাতা হারান। ৮ বছর বয়সে চাচাত ভাই শেখ মুজিবের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর থেকেই তিনি ছিলেন জাতির পিতার আমরণ সঙ্গী। 

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব মৌলভীর নিকট ধর্মীয় এবং গৃহশিক্ষকের নিকট বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি প্রবল আগ্রহী পরবর্তী জীবনের প্রচুর বই পড়তেন। অত্যন্ত শান্ত স্বভাব, বিচক্ষণতা, অসীম ধৈর্য্য ও সাহস নিয়ে সারাজীবন তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর পাশে ছিলেন। প্রখর স্মরণশক্তি, দানশীলতা ও পরোপকারিতা ধর্মভীরু বঙ্গমাতার অনন্য গুণাবলী। বঙ্গবন্ধু স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসা পর্যন্ত হাতে তসবীহ ও জায়নামাজেই সময় কাটিয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তিনি আত্মনিয়োগ করেন।  

বঙ্গমাতার অনুপ্রেরণাতে, একরকম তাঁর চাপাচাপিতেই আমরা পাই ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, যা পড়ে আমরা আরও গভীরভাবে উপলদ্ধি করি- “বঙ্গবন্ধু আছেন বাঙালি জাতির হৃদয়জুড়ে; এ দেশের মাটি আর আকাশ, নদি আর শস্যেও মাঠ, আমাদের দিনগুলো আর রাতগুলো সব জুড়ে আছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে কত আত্মত্যাগের ইতিহাস পর্দার অন্তরালে ঢেকে আছে, এর কতটুকুই আমরা জানি! জাতি হিসেবে আত্মপরিচয়ের জন্য, স্বাধীনতার জন্য কত রক্ত ঝরেছে, কত অশ্রু বিসর্জন হয়েছে, এর কতটুকুই বা আমরা উন্মোচন করতে পেরেছি! বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিবের সারাজীবনের ইতিহাস কেবলই আত্মত্যাগের ইতিহাস। স্বামী, পুত্র, পুত্রবধূদের সঙ্গে একই সাথে চলে গেলেন। নিরবে তিনি কত বড় আত্মত্যাগ করে গেছেন তার কি আমরা সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছি? 

শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই ইতিহাস যে, প্রয়োজনে নিজের গহনা-অলংকার, পৈত্রিক জমির ফসল বিক্রি করে, এমনকি জমি-জমা বন্ধক রেখেও অর্থ সংগ্রহ করে বঙ্গমাতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এমনকি, রক্তাক্ত পরনের কাপড় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে বঙ্গমাতা শহীদি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। বঙ্গন্ধুর আমৃত্যু সহচর বঙ্গমাতার জন্য কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি লাইন শ্রদ্ধার সাথে এখানে উল্লেখ করা হলো: “The roots below the earth claim no rewards for making the branches fruitful (Stray Birds).” ফলভারে অবনত বৃক্ষ দেখে আমরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠি, কিন্তু আমরা কি কখনো ভাবি, একটি বৃক্ষকে ফুল-ফল-লতা-পাতায় সুশোভিত করতে শিকড়ের কি ভূমিকা!! মাটির গভীরে প্রোথিত শিকড় অদৃশ্যে থেকে খনিজ-পুষ্টি সরবরাহ করে বৃক্ষকে ফলবান করে তোলে, কিন্তু কখনো এর জন্য প্রতিদান দাবি করে কি? করে না। বঙ্গমাতাও আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন। 

বঙ্গবন্ধু ক্রমান্বয়ে খোকা থেকে মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে উঠেন। বঙ্গবন্ধুর জাতির পিতা হয়ে উঠার প্রতিটি ধাপে বঙ্গমাতার অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু, সারাজীবন তিনি নিরবে-নিভৃতে থেকেছেন; পাদ-প্রদীপের আলো তিনি সযত্নে এড়িয়ে চলেছেন; কোনো প্রতিদান দাবি করেননি কোনোদিন। 

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে যদি বেগম মুজিবের উৎসাহ না থাকত তাহলে এত বড় মাপের নেতা হয়ে উঠা সত্যিই কঠিন ছিল। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি পৃথিবীতে সর্বদিক থেকে মনে মতো ও নেককার স্ত্রী পেয়েছে সে এই পৃথিবীতে উত্তম সম্পদ পেয়েছে”। সেই অর্থে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও অনেক বড় ভাগ্যবান; ভাগ্যবান বাঙালি জাতি। কেননা, বঙ্গবন্ধুর সুমহান নেতৃত্বে হাজার বছরের পরাধীনতার অর্গল ভেঙ্গে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবের প্রাজ্ঞতায় মুগ্ধ হয়ে একদিন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে বলেন, `Mujib, she is a very precious gift to you from God. Don’t neglect her, please.’

সত্যিই বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু সহচর ও বাংলাদেশের অনন্য এক সম্পদ। রত্নগর্ভা জননী বঙ্গমাতার কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা আমাদের অতি আপনজন আর আদরের হাসুমনি শেখ হাসিনা আজ বিশ্বরত্ন; মানবতার জননী। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ুক সারাবিশ্বে। আজ আট আগস্ট; এ মহিয়সী নারীর জন্মদিন। অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তাঁর স্মৃতির প্রতি।  

লেখক: কবি, গবেষক ও সংগঠক

এএইচএস