এশিয়ার সবচেয়ে ধনী নারী এক বছরে খুইয়েছেন অর্ধেক সম্পদ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:৩৫ পিএম, ১১ আগস্ট ২০২২ বৃহস্পতিবার
ইয়াং হুইয়ান (মাঝখানে বসা), এশিয়ার সবচেয়ে ধনী নারী।
তিনি কী পরিমাণ সম্পদের মালিক তা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে চীন এবং চীনের বাইরে খবরের শিরোনাম হয়েছে এবং নানা রকম জল্পনা কল্পনা হয়েছে। তিনি হলেন ৪১-বছর বয়সী ইয়াং হুইয়ান। তিনি শুধু চীনেই না, পুরো এশিয়ার মধ্যে তিনি সবচেয়ে ধনী।
এক দশকেরও বেশি সময় আগে তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে একটি রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্যের মালিক হওয়ার পর থেকে তার সম্পদ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কিন্তু তার অবস্থা বদলে যায় ২০২২।
গত বছর তিনি সত্যিকারের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। ব্লুমবার্গ বিলিয়নেয়ার্স ইনডেক্সের হিসেব অনুযায়ী, মিজ ইয়াংয়ের গত বছর সম্পদের নেট মূল্য ৫২ শতাংশেরও বেশি কমে যায়।
ব্লুমবার্গ গত বছর এই নারী ব্যবসায়ীর সম্পদের হিসেব করেছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছর জুলাই মাসে তার পরিমাণ ১৬.১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা একে শুধু কেবল চীনের রিয়েল এস্টেট বাজারের মন্দার চিহ্ন হিসেবেই দেখেননি, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি বড় সতর্কবার্তা হিসেবেও দেখেছেন। এবং এটি হলো চীনের রিয়েল এস্টেট সেক্টরে আবাসিক বাড়িঘরের মূল্য পতন, ক্রেতার চাহিদা হ্রাস এবং ঋণ খেলাপি সংকট।
এসব সমস্যা ২০২০ সাল থেকে কিছু বড় রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব বিস্তার করেছে।
এখন পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এমনকি কিছু ব্যাঙ্কে নগদ অর্থ ফুরিয়ে গেছে, এবং চীনের কয়েকটি শহরে এনিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে।
এবং ইয়াং হুইয়ান এশিয়ার সবচেয়ে ধনী মহিলা হিসেবে এখনও রয়ে গেলেও তার অবস্থান এখন নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে।
ব্লুমবার্গের হিসেব মতে, মিজ ইয়াংয়ের পরের অবস্থানে রয়েছেন রাসায়নিক ফাইবার কোম্পানির উদ্যোক্তা ফ্যান হংওয়েই, যার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার।
কিন্তু ইয়াং হুইয়ান আসলে কে এবং কীভাবে তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা ধনী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করছিলেন?
বিশাল আর্থিক সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার
ইয়াং হুইয়ানের জন্ম ১৯৮১ সালে দক্ষিণ চীনের ক্যান্টন প্রদেশের ফোশান শহরের শুন্টাক জেলায়। তারা বাবা চীনের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ইয়াং গুওচিয়াং। চীনের অন্যতম প্রভাবশালী পরিবারে বেড়ে ওঠা ইয়াং হুইয়ানের শিক্ষা জীবন ছিল দুর্দান্ত।
তরুণ বয়সে তাকে পাঠানো হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০০৩ সালে তিনি ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কলা ও বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
চীনে ফিরে আসার পর তিনি ২০০৭ সালে বাবা কাছ থেকে কান্ট্রি গার্ডেন হোল্ডিংস-এর শেয়ারের অধিকাংশ উত্তরাধিকার সূত্রে পান। জমি বিক্রির দিকে থেকে এই কোম্পানি ছিল চীনের বৃহত্তম রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার।
১৯৯২ সালে গুয়াংঝৌতে প্রতিষ্ঠার পর কান্ট্রি গার্ডেন হোল্ডিংস হংকং-এর বাজারে শেয়ার ছেড়ে খুবই সফল হয় এবং ১.৬ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করে।
এটা ছিল ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজারে গুগলের আইপিওতে অর্জিত অর্থের সমান।
যদিও ইয়াং হুইয়ান তার নিভৃত ও সাদামাটা জীবনযাপনের জন্য পরিচিত, কিন্তু তাকে ঘিরে চীনের ভিতরে এবং বাইরে অসংখ্য সংবাদ শিরোনামে তিনি ছিলেন কেন্দ্রবিন্দুতে।
২০১৮ সালে তাকে ঘিরে খুব বড় একটা কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছিল।
সেসময় "সাইপ্রাস পেপারস" নামে পরিচিত ফাঁস হওয়া দলিলপত্র থেকে জানা যায়, ইয়াং হুইয়ান ২০১৮ সালে সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন, যদিও চীনের আইন অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকত্ব বৈধ না।
সমস্যা যেভাবে শুরু
চীনা বাজার সম্পর্কে অভিজ্ঞরা ইয়াং হুইয়ানকে টনটনে ব্যবসায়িক জ্ঞানসম্পন্ন একজন সৃজনশীল নারী হিসাবে বর্ণনা করেছেন। গত বছর জুন মাসে ইন্টারন্যাশনাল হসপিটালিটি ইন্সটিটিউট তাকে বিশ্বব্যাপী হসপিটালিটি শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় স্থান দিয়েছে।
কিন্তু ততদিনে তার ব্যবসায় দুর্বলতার লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
২০২০ সাল থেকে চীনের রিয়েল এস্টেট বাজারের পরিস্থিতি আরও জটিল হতে শুরু করে।
এটা শুধুমাত্র করোনাভাইরাস মহামারির কারণে নয়, রিয়েল এস্টেট খাতে যে অতিরিক্ত ঋণের বোঝা তৈরি হয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ তাকে সামলানোর চেষ্টা শুরু করে।
এর ফলে বৃহৎ নির্মাণ কোম্পানিগুলিকে সরকার আর্থিক সাহায্য দিয়ে তাদের ঋণদাতা ব্যংকগুলোর সাথে নতুন করে দরকষাকষি করতে বাধ্য করে।
এই সঙ্কট আরও তীব্র হয় চীনের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এভারগ্রান্ডেকে ঘিরে। মাসের পর মাস তারল্য সঙ্কটের পর ২০২১ সালের শেষের দিকে এই কোম্পানি তার ডলার বন্ডেও খেলাপি হয়ে যায়।
ঐ ঘটনার পর চলতি বছর কাইসা এবং শিমাও গ্রুপসহ আরও বেশ কয়েকটি বড় ডেভেলপার দেউলিয়া হয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে সঙ্কট আরও খারাপ হয় যখন "ক্রেতা ধর্মঘট"-এর খবর পাওয়া যায়। বাড়ি নির্মাণে দেরী হওয়ার অভিযোগে হাজার হাজার মানুষ বন্ধকীর অগ্রিম অর্থ প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানান।
এসব ঘটনার মধ্যেও কান্ট্রি গার্ডেন করোনা মহামারির প্রথম দিনগুলিতেও চালু ছিল। কিন্তু এরপর কোম্পানিটি নগদ অর্থ সঙ্কটে পড়ে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে কোম্পানিটি অতিরিক্ত তহবিল সংগ্রহ করার লক্ষ্যে গত জুলাই মাসে প্রায় ১৩% ডিসকাউন্ট দিয়ে শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এরপরও ইয়াং হুইয়ান এবং তার কোম্পানির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নয় বলেই মনে করা হচ্ছে।
গত জুলাইয়ের এক প্রতিবেদনে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি এসঅ্যান্ডপি অনুমান করেছে যে মর্টগেজ ক্রেতাদের ধর্মঘটের কারণে চীনে রিয়েল এস্টেট বিক্রি এবছর এক তৃতীয়াংশ হ্রাস পেতে পারে।
এদিকে, ক্যাপিটাল ইকোনমিক্স নামে লন্ডনের একটি স্বাধীন অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থাও ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে "বিক্রি কমে গেলে আরও অনেক ডেভেলপার মুখ থুবড়ে পড়বে, এবং সেটা হবে চীনের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক হুমকি।" সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসি