ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১৩ ১৪৩১

যে রাতে পিতা খুন হলেন

শেখ সাদী

প্রকাশিত : ০৮:৫৮ এএম, ১৫ আগস্ট ২০২২ সোমবার

ফজরের সময়, ভোরের আজান শোনা যাচ্ছে। মুখোশ পরা একদল সেনা অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসছে। কেউ জিপে। কেউ ট্রাকে। গন্তব্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি।

‘বিছানায় উঠে বসলেন ফজিলাতুন্নেছা। চোখ গেল জানালার বাইরে। দেখলেন, রাতের শেষ অন্ধকার চলে যাচ্ছে দিনের পেটে। প্রতিদিন এই সময় নামাজ পড়ে আবার একটু শুয়ে থাকেন। 

ঘরে সেগুনকাঠের একটা বড় খাট। এতে বাবার বুকের ওপর ডান হাত তুলে ছোট ছেলে রাসেল ঘুমাচ্ছে। খাট ছাড়া ঘরে একটা মাঝারি আকারের আলমারি। কাপড়চোপড়, দরকারি কাগজপত্র, টাকাপয়সা, গয়নার বাক্স, সবই এর ভেতরে। একটা সাইড টেবিল। এর ওপরে চারটা পাইপ, দুইটা এরিনমোর তামাকের হলুদ কৌটা, আর তিনটা ফোন। মাঝেরটা লাল ফোন। একটা কালো। একটা ক্রিম কালারের। কালো ফোনটা বেজে উঠল।

নিশ্চয়ই কোনো খারাপ খবর। বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠে। চোখের দুই পাশের চামড়া ভাঁজ হয়ে যায়। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনের রিসিভার তুলে কানের কাছে ধরলেন। সেরনিয়াবাতের জড়ানো কথা কানে এলো, ‘কারা যেন বাড়িতে আক্রমণ করেছে, গুলি করছে, কিছু একটা...কথা শেষ না হতেই গুলির শব্দ কানে আসে। আর কোনো কথা শুনতে পেলেন না। ফজিলাতুন্নেছা হ্যালো হ্যালো বলেই যাচ্ছেন।

কথার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় বঙ্গবন্ধুর।

বললেন, কী হয়েছে হাসুর মা?

হাসনাতের আব্বা ফোন করেছিল, কারা যেন ওনার বাসায় আক্রমণ করেছে।

বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন।

বাবা উঠে যাওয়ায় ঘুমের মধ্যেই পাশবালিশটা টেনে বুকের কাছে নিল রাসেল।’

উদ্বিগ্ন বঙ্গবন্ধু
‘ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ঘুমিয়ে আছেন।
বাড়ির নিচের এক ঘরে মহিতুলের সঙ্গে আরও দুজন শুয়ে আছে। পিএবিএক্সে ফোন করলেন বঙ্গবন্ধু।                
ফোন ধরলেন টেলিফোন মিস্ত্রি মতিন।  ‘মহিতুলকে দে।’

মহিতুলকে ধাক্কা দিলেন মতিন, ‘প্রেসিডেন্ট সাহেব ডাকছেন।’
লাফিয়ে উঠে ফোন ধরলেন মহিতুল, ‘সেরনিয়াবাতের বাড়িতে কারা যেন আক্রমণ করেছে। পুলিশ কন্ট্রোল রুমে জলদি ফোন লাগা।’

রিসেপশন রুমে তিনটা ফোন। একটা ফোন সেটের নম্বর ঘুরিয়েই যাচ্ছেন মহিতুল। কেউ ফোন ধরছে না। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু রিসেপশন রুমে চলে আসেন। চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠেন মহিতুল। এখন দাঁড়িয়ে নম্বর ঘোরাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, কী হলো? এখনো লাগাতে পারলি না?

চেষ্টা করছি, কেউ ফোন ধরছে না। এ কথা বলে মহিতুল গণভবন এক্সচেঞ্জে ফোন করেন। একজন ফোন রিসিভ করলেন। মহিতুল হ্যালো, হ্যালো বলেই যাচ্ছেন। কারো গলা শোনা যাচ্ছে না। এবার ফোনের রিসিভার বঙ্গবন্ধু হাতে নিয়ে বললেন, হ্যালো, হ্যালো।

পতাকা তোলার সময় 
‘এমন সময় বাড়ির প্রাঙ্গণে বিউগলে সুর বেজে ওঠে। রাষ্ট্রপতির বাসভবনে জাতীয় পতাকা তোলা হচ্ছে। পুব আকাশে লাল আভা দেখার সময় পতাকা তোলা হয়। নামানো হয় সন্ধ্যায়। মিলিটারি ভাষায় এই সময়টাকে বলে ফার্স্ট লাইট। বিউগলে সুর বাজানো শেষ। হাবিলদার কুদ্দুসের দল ফলইন করে জাতীয় পতাকা তুলতে থাকে। পতাকা তোলার পর স্যালুট দেয়ার নিয়ম। ছয় জন সেনা স্যালুট দেয়ার জন্য ডান পা তুলেছে, তখনই বাড়ির দক্ষিণ দিক থেকে গুলি শুরু হয়।

প্রথম গুলি
চারটা ২৫ মিনিট। বৃষ্টির মতো গুলি এসে লাগল দেয়ালে, জানালায়, কার্নিশে এবং বাড়ির পেছনের গাছে। মহিতুল ভয়ে টেবিলের নিচে বসেন। কিছুক্ষণ পর গুলি বন্ধ হয়। দোতলা থেকে পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে এসেছে গৃহভৃত্য সেলিম। এতক্ষণ স্যান্ডো গেঞ্জি পরা ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বারান্দায় এসে বললেন, আর্মি, সেন্ট্রি থাকতে এতক্ষণ গুলি হলো কেন? কী করো তোমরা? কারা এরা?
এসব বলতে বলতে দোতলায় উঠে গেলেন।

গুলি নেই!          
বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীর কাছে এখন কোনো গুলি নেই। দেড় ঘণ্টা আগে সব গুলি নিয়ে গেছে সুবেদার মেজর ওয়াহাব জোয়ার্দার। 

সেনারা ভেতরে  
একদল সেনা ‘হ্যান্ডস আপ’ বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে চলে আসে। দলের সামনে নূর, হুদা ও মহিউদ্দিন।
গেট পার হয়ে দেখা হয় হাবিলদার গনির সঙ্গে। শেষ রাতে হাবিলদার কুদ্দুস আসার আগে গার্ড কমান্ডারের দায়িত্বে ছিল গনি। কুদ্দুস দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর তার ঘুমাতে যাওয়ার কথা, আজ যায়নি। মধ্যরাত থেকে বাড়ির আঙিনায় অস্থির পায়চারি করছিল।

প্রথম খুন শেখ কামাল
নিচতলার রিসেপশন ঘরে চলে এসেছেন শেখ কামাল। 
সেনাদের দেখে চমকে যান। 
এরা কারা?
কেন এসেছে এখানে?

মুখোশ পরা কয়েকজন সেনা স্টেনগান তাক করে। হুদার হাতে লোড করা পিস্তল।
ভয়ে চিৎকার করে বললেন, আমি শেখ মুজিবের বড় ছেলে কামাল, আপনারা...
কথা শেষ হলো না।
হুদা পিস্তল দিয়ে গুলি করে।

প্রথম গুলি লাগে পায়ে। কামাল মেঝেতে পড়ে যান। এরপর কাছে থেকে একজন সেনা স্টেনগান দিয়ে বুকে গুলি করে। গোঙানির সাথে একবার ‘মা’ বলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।

দোতলায় ওঠার সময় গোঙানি শুনতে পান বঙ্গবন্ধু। ছেলের গোঙানির শব্দে বুক কেঁপে ওঠে। দোতলায় শোবার ঘরে যেতেই ফজিলাতুন্নেছা জাপটে ধরে বললেন, ‘আমার কামালের কী হলো, হাসুর বাবা?’

ফোন করলেন 
শোবার ঘরে এসে রেড ফোনের রিসিভার তুললেন বঙ্গবন্ধু।
ফোন করলেন সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে, ‘তোমার বাহিনী আমার বাসায় আক্রমণ করেছে। মনে হয়, তারা কামালকে খুন করেছে। এক্ষুনি বাহিনী পাঠাও।’

এ কথা শুনে ভয়ার্ত গলায় সেনাপ্রধান বললেন, স্যার, আই এম ডুইং সামথিং।

হতবাক সফিউল্লাহ         
‘সকালের আলো ফোটেনি। এই সময় বাড়ির ডোরবেল বেজে ওঠে। পর পর তিনবার। দরজা খুলে দেখেন মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টর সালাহউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন। সেনাপ্রধানকে স্যালুট দিয়ে সালাহউদ্দিন বললেন, আপনি কি আর্মড এবং আর্টিলারি ডিভিশনকে শহরের দিকে পাঠিয়েছেন?

-কই না তো! হতবাক সেনাপ্রধান।
বুঝতে অসুবিধা হলো না, এখন কোনো একটা অঘটন ঘটতে চলেছে। শেষরাতের ঠাণ্ডা বাতাসেও ঘেমে যাচ্ছেন সফিউল্লাহ। বললেন, ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল কি জানে?

-জানি না। প্রথমে আপনার কাছে এসেছি।

-তুমি যাও। শাফায়াতকে বলো, দুই আর চার নম্বর ব্যাটালিয়ন পাঠিয়ে ওদের এগিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে। স্যালুট জানিয়ে বিদায় নিলেন সালাহউদ্দিন।

রওনা দিলেন জামিল      
বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে লাল রঙের প্রিন্স গাড়ি নিয়ে রওনা দেন কর্নেল জামিল।
পরনে সেনা পোশাক। কোমরে ঝুলছে চামড়ার খাপে ভরা পিস্তল। ৩২ নম্বর বাড়ির কাছাকাছি সোবহানবাগ মসজিদের কাছে আসতেই ফারুকের দলের সঙ্গে দেখা হয়।

কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা রাইফেল তাক করে পাহারা দিচ্ছিল। তারা চিৎকার করে বলতে থাকে ‘হল্ট’, ‘হল্ট’।
জামিল গাড়ি দাঁড় করান। কয়েকজন সেনা গাড়ির চারপাশ ঘিরে ধরে। একজন জানালা দিয়ে রাইফেল ঢুকিয়ে দেয়। নল মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করে। গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে থাকা অবস্থায় প্রাণ যায় জামিলের। আরেকটা গুলি করা হয় পেটে। নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে রওনা দেয় ব্রিগেডিয়ার মাসহুরুল। ধানমন্ডির কাছাকাছি মিরপুর রোডের ওপর দেখা হয় কালো পোশাক পরা কয়েকজন যমদূতের সঙ্গে।

যমদূতরা ফারুকের ট্যাংক বাহিনীর সদস্য। তারা হাত-পা বেঁধে মাসহুরুলকে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়।

গুলির বৃষ্টি
ধানমন্ডি ১৩/১ সড়কের এক বাড়ির সামনে গুলি শুরু হয়েছে। স্টেনগান থেকে বৃষ্টির মতো গুলি বের হচ্ছে।
এই বাড়িতে থাকেন বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি। কয়েক জায়গায় ফোন করলেন। কেউ সাড়া দেয় না। কয়েকজন সেনা চলে আসে ড্রয়িংরুমে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

সামনে দাঁড়ান মেজর ডালিম আর রিসালদার মোসলেমউদ্দিন। দুজনের হাতে গুলিভরা স্টেনগান। স্টেনগান থেকে গুলি করে মোসলেমউদ্দিন। এমন সময় সন্তানসম্ভবা স্ত্রী আরজু মনি সামনে এসে দাঁড়ান। দুজনে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়লেন। পড়ে যাওয়ার সময় মনির মাথা সোফার হাতলের সঙ্গে লাগে।

রক্তাক্ত আরজু বললেন, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলো। আমার ছোট ছোট দুইটা বাচ্চা আছে। মা-বাবার মৃত্যুদৃশ্য দেখল তিন বছর বয়সের তাপস।

আক্রান্ত সেরনিয়াবাত    
মিন্টো রোডের ৩৭ নম্বর বাড়িতে রক্তগঙ্গা বইছে।
স্টেনগানের গুলি চালিয়ে দেয় বাড়ির ওপর। শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সেরনিয়াবাতের। তিনি বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি। ফোন করলেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। ফোন ধরেছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা। ফোন করার পর তিনি এখন বাড়ির সবাইকে নিয়ে বৈঠকখানার ঘরে বসে আছেন।

নিজের পিস্তল নিয়ে বড় ছেলে আবুল হাসনাত সেনাদের ঠেকাতে চেষ্টা করলেন। ঘরের ভেতর থেকে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়লেন, ঠেকানো গেল না। গুলির সংখ্যা বাড়ায় খুনির দল।

ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির কাছে হাসনাতের ব্যারিকেড তুচ্ছ হয়ে যায়। একদল সেনা নিয়ে হুড়মুড় করে বাড়ির ভেতর চলে আসেন শাহরিয়ার। বৈঠকখানার ঘরে দেখা হয়। সেরনিয়াবাত জানতে চাইলেন, তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে?

শাহরিয়ার বললেন, ‘আমাদের’।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও বঙ্গবন্ধু গবেষক 

এএইচএস//এনএস//