ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

গীতা, সংস্কৃতি শিখিয়ে মূল্যবোধ জাগাচ্ছেন যে মুসলিম শিক্ষকরা

সিরাজ আলী কাদরী

প্রকাশিত : ০৭:২৯ পিএম, ১৮ আগস্ট ২০২২ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৭:৫০ পিএম, ১৮ আগস্ট ২০২২ বৃহস্পতিবার

গুজরাট সরকার ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে স্কুলে ৬ থেকে ১২ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ভগবদ্গীতা শেখানোর বিষয়ে ঘোষণা দেওয়ার অনেক অনেক আগেই সুরাটের একটি স্কুলে একজন মুসলিম শিক্ষক শিশুদের ভগবদ্গীতা পড়িয়েছেন ১২ বছর ধরে। এই শিক্ষক কেবল ভগবদ্গীতাই শেখান না, স্কুলের শিশুদের মধ্যে পারিবারিক মূল্যবোধের বীজও বপন করছেন।

শাহ মোহাম্মদ সাঈদ ইসমাইল ১২ বছর ধরে ঝাখরদা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজ করছেন। এটি সুরাট শহরের আলো থেকে অনেক দূরে আদিবাসী অধ্যুষিত মংরোল তহসিল এলাকায় অবস্থিত। এই স্কুলে পড়াশুনা করতে আসা হিন্দু শিশুদের ভগবদ্গীতা এবং মুসলিম শিশুদের কোরান শরীফ শেখানো হয়।

পাঠদানের প্রথম দিন থেকেই তিনি স্কুলে আসা আদিবাসী ও দরিদ্র শিশুদের মধ্যে সুশিক্ষা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা আসছেন। সে চেষ্টায় কিছুটা হলেও সফলও হয়েছেন। এই স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুরা পড়তে আসে। 

ওই গ্রামের সমাজে হিন্দু-মুসলিম একটি সহাবস্থান আছে এবং এই ছোট স্কুলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের ৭১ জন শিশু পড়তে আসে। উভয় ধর্মের সন্তানদের দেশের এবং আন্তর্জাতিক অনেক ভাষাও শেখানো হচ্ছে । 

সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী নেহা নয়ন ভাসাভা জানিয়েছে, তাকে চীনা, রোমান, তামিল, হিন্দি, উর্দু এবং গুজরাটি ভাষা শেখানো হয়েছে। প্রতিদিন রাতের খাবারের আগে, সমস্ত শিশু ভগবদ্গীতার একটি পাতা পড়ে। প্রতি রবিবার তারা গ্রামের একটি বাড়ি বেছে নেয়, যেখানে তারা ভগবদ্গীতার দুই পৃষ্ঠা পড়ে এবং বর্ণনা করে। 

ইসমাইল বলেছেন, ভগবদ্গীতা পাঠ করলে শিশুদের স্মৃতিশক্তি প্রখর হয়।

বলা হয়ে থাকে, একজন শিক্ষকের কোনো ধর্ম বা বর্ণ নেই। ইসমাইল তা সত্য প্রমাণ করছেন। সম্ভবত এটিই হবে গুজরাটের প্রথম স্কুল যেখানে একজন মুসলিম শিক্ষক শিশুদের মধ্যে গীতার জ্ঞানের পাশাপাশি মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলছেন।

ইসমাইল জানান, গত ১২ বছর ধরে তিনি এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। স্কুলে, শিশুরা মূল্যবোধের সাথে শিক্ষিত হয়। ভগবদ্গীতা প্রত্যেক শিশুকে দেওয়া হয়েছে। এটি গত ১২ বছর ধরে পড়ানো হচ্ছে। এখন ইসমাইল সরকার কর্তৃক ভগবদ্গীতা শেখানোর এই ধারনাটি ইতিবাচকভাবে দেখছেন। 

তিনি বলেছেন, তারা ২০১২ সাল থেকে সমস্ত স্কুলের বাচ্চাদের গীতা শেখাচ্ছেন, বাচ্চারা তাদের বাড়িতে প্রতিদিন গীতার একটি পৃষ্ঠা পড়ে এবং পরের দিন তাদের সহপাঠীদের কাছে সেটা ব্যাখ্যা করে।

ইসমাইল জানান, তিনি যখন প্রথম আসেন তখন গ্রামে একটি গীতাও ছিল না। 

“আমি অনেক লোকের জন্য গীতার কপি নিয়ে এনেছি। শিশুদের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যায়গুলির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।”

গীতা পড়ার উপকারিতা সম্পর্কে ইসমাইল বলেছেন, এই পাঠ ভাল আচরণ গড়ে তুলতে সাহায্য করে । 

গ্রাম প্রধান জগদীশ ভাসাভা বলেন, শিশুরা এখন যার যার মত করে দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের সাহায্য করছে।

গুজরাট থেকে বাংলার দিকে তাকিয়ে দেখা

উত্তরবঙ্গের একটি কলেজে নয় বছরের অভিজ্ঞতার পর রমজান আলী তিন বছর আগে সংস্কৃত শেখানোর জন্য সহকারী অধ্যাপক হিসেবে বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরায় যোগ দিয়েছিলেন। 

তিনি বলেন, ছাত্র এবং অনুষদ সদস্যরা তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানোয় তিনি অভিভূত হয়েছেন।

“আমাকে অধ্যক্ষ স্বামী শাস্ত্রজ্ঞানন্দজি মহারাজ এবং সবাই স্বাগত জানিয়েছিলেন।মহারাজ আমাকে বলেছিলেন যে, আমার ধর্মীয় পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ নয়, যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল ভাষার উপর আমার উপলব্ধি, আমার জ্ঞান এবং ছাত্রদের সাথে সেটা শেয়ার করার ক্ষমতা।”

চল্লিশের কিছু বেশি বয়সের আলী জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি সংস্কৃতির শিক্ষক হিসাবে কখনও কোনও বৈষম্যের মুখোমুখি হননি। 

“আমি সংস্কৃত শেখা বা শেখানোর কোনো সময়েই অনুভব করিনি আমি অপ্রত্যাশিত বা অবাঞ্ছিত। বেলুড় কলেজে ম্যানেজমেন্ট আমার থাকার ব্যবস্থা করেছে এবং নিশ্চিত করেছে যে আমি যাতে কোনো অসুবিধার সম্মুখীন না হই।”

রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের সংস্কৃত বিভাগের একজন ছাত্র বলল, সে আলীর ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য উন্মুখ আছে। 

তার মতে, একজন শিক্ষকের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা অনুচিত। 

লেখক: ভারতীয় দৈনিক ভাস্কর পত্রিকার সাংবাদিক

এএইচএস//