ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

চা শ্রমিকদের জীবন চলে কীভাবে?

একুশে টেলিভিশন  

প্রকাশিত : ০৮:৪১ এএম, ১৯ আগস্ট ২০২২ শুক্রবার

বাংলাদেশের চা শ্রমিকেরা মজুরি বাড়ানোর দাবিতে বাগানে লাগাতার ধর্মঘট করছেন। কিন্তু মালিকপক্ষ দাবি অনুযায়ী মজুরি না বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অনঢ়। ফলে চা শিল্পে একটি অচলবস্থা তৈরি হয়েছে। দেশের ২৪১টি চা বাগানে এই ধর্মঘট শুরু হয় গত ৯ আগস্ট থেকে। দেড় লাখের বেশি শ্রমিক  চা পাতা তোলার কাজ থেকে বিরত আছেন। 

শ্রমিকেরা কত মজুরি পান
চা  বাগানগুলোতে এ , বি এবং সি এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এ শ্রেণির চা বাগানেই  দিনে সর্বোচ্চ মজুরি ১২০ টাকা। শ্রমিকেরা এখন দিনে ৩০০ টাকা মজুরি  চাচ্ছেন। প্রতি দুই বছর পর পর তাদের মজুরি বাড়ানোর কথা থাকলেও ২০১৮ সালের পর আর  মজুরি বাড়ানো হয়নি। মজুরির বাইরে শ্রমিকেরা সপ্তাহে তিন কেজি আটা পান, দুই টাকা কেজি দরে। এছাড়া তাদের চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা দেয়ার কথা। একই সঙ্গে সন্তানদের শিক্ষা সুবিধা থাকার কথা।

শ্রমিকেরা চলেন কীভাবে?

মৌলভী বাজার বরমচাল চা বাগানের শ্রমিক  চন্দন কুর্মী। তার স্ত্রী দুই সন্তান ও দুই ভাইসহ ছয় সদস্যের পরিবার। সবাই তার ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন,“ সকালের নাস্তা রেশনে পাওয়া আটা দিয়ে হয়। দুপুর ও রাতের খাবারের জন্য কমপক্ষে আড়াই কেজি চাল লাগে।

আমি যা মজুরি পাই তা দিয়ে আড়াই কেজি চালই কেনা সম্ভব নয়। অন্যান্য খরচের টাকা কোথায় পাবো। আসলে আমরা এক বেলা না খেয়ে থাকার পরও সংসার চলে না।”

শ্রমিকদের ১২০ টাকা মজুরির মধ্যেও ফাঁক আছে। তিনি জানান,“কমপক্ষে ২০ কেজি চা পাতা তুলতে পারলে ১২০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। এর কম হলে প্রতি কেজিতে ছয় টাকা করে কেটে নেয়া হয়। কিন্তু যদি ২০ কেজির বেশি হয় তাহলে প্রতি কেজিতে মাত্র দুই টাকা বেশি দেয়া হয়।”

শ্রমিকেরা যদি চা বাগানের জমিতে ফসল বা শাক সবজির চাষ করেন তাহলে তাদের আবার রেশন দেয়া হয় না। চিকিৎসা বলতে স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে  যেকোনো রোগে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট  ছাড়া আর কিছু দেয়া হয়না।

ওই একই এলাকার কালিটি চা বাগানের শ্রমিক দয়াল আমলিক বলেন,“আমরা মাছ মাংস বছরে  এক-দুইবার  খেতে পারি কোনো উৎসবের সময়। আর সারা বছর ঘরের পাশে লাগানো শাক সবজি দিয়ে চালিয়ে নিই। আর  সব বেলায় খেতে পাই না।”

এক পর্যায়ে তিনি বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলেন,“বিশ্বাস করুন আমরা না খেয়ে থাকি। আমাদের সন্তানদের পড়াশুনা করাতে পারি না। এনজিওর যে স্কুল এখানে আছে তাতে পঞ্চম শ্রেণির পর আর পড়ানো হয় না। আমাদের ঘর চালা ফুটো হয়ে পানি পড়ে।  পাঁচটি টিন লাগলে দেয় একটি। আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি।”

সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী?
চা শ্রমিকদের সন্তানরা যেন চা শ্রমিক হওয়ার জন্যই বড় হয়। তাদের জীবনে আর কোনো স্বপ্ন দেখার সুযোগ নেই। যদি একজনকে পড়াশুনা করাতে হয় তাহলে অন্য সন্তানদের আর পড়ালেখা করানো যায় না। তারপরও ভাগ্যবানদের একজন শমসেরনগর চা বাগানের যুবক অঞ্জন দাস। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করে এখন সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে।  বাবা-মায়ের একামাত্র সন্তান অঞ্জন ছয় মাস  বয়সে বাবাকে হারান। তার মায়ের অদম্য ইচ্ছায় তিনি পড়াশুনা করতে পেরেছেন।  তিনি জানান,“আমি একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমার মা খেয়ে না খেয়ে এনজিওর লোন নিয়ে আমাকে পড়াশুনা করিয়েছেন। আর কলেজ ওঠার পর থেকে নিজে টিউশনি করিয়েছি। কিন্তু যাদের সন্তান বেশি তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। একজনকে পড়ালে অন্য সন্তানদের পড়ানো সম্ভব হয় না। ১২০ টাকা মজুরিতে পেটই চলে না, পড়াবে কীভাবে? ”

তিনি জানান, সব  চা বাগান মিলিয়ে তার মত উচ্চ শিক্ষিত হাতে গোনা কয়েকজন পাওয়া যাবে। প্রায় সবাই সর্বোচ্চ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনার পর আর করতে পারেন না।

এদিকে মজুরি অনেক কম হওয়ায় চা শ্রমিকদের  বলতে গেলে সবাইই ঋণগ্রস্ত। তারা বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেন। প্রতি সপ্তাহেই ঋণের কিস্তি শোধ করতে হয়।  ফলে তাদের মজুরির টাকাও ঘরে নিতে পারেন না। আর সন্তানরা অপুষ্টিসহ নানা রোগে ভোগে।

আন্দোলন কতদিন চলবে?

চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেণ পাল জানান, চা বাগানগুলোতে স্থায়ী শ্রমিক আছে এক লাখ। আর অস্থায়ী আছে ৫০ হাজার। তাদের  ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা প্রায় আট লাখ।  তিনি বলেন,“আমাদের দাবি ২০টি। মূল দাবি হলো মজুরি দিনে ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে  ৩০০ টাকা করতে হবে। এটা পূরণ হলেই আমরা কাজে ফিরে যাব।  কিন্তু বুধবার মালিকদের সঙ্গে আলোচনায় তারা আমাদের মজুরি মাত্র ২০ টাকা বাড়িয়ে ১৪০ টাকা করতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু আমাদের ৩০০ টাকার দাবি পুরণ না হলে আমরা আন্দোলন চালয়ে যাব। আমরা আর চলতে পারছি না। দেয়ালে পিঠ থেকে গেছে।”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন,“মালিকেরা বলছেন যে চা উৎপাদনে তাদের লোকসান হয়। তাহলে তারা ব্যবসা করেন কীভাবে?”

মালিক এবং শ্রম অধিদপ্তর আগামি ২৩ আগস্ট শ্রমিকদের সঙ্গে আবার বৈঠকে বসবেন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহারের  আহ্বান জানানো হয়েছে।

চা সংসদের সিলেট ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান জি এম শিবলি বলেন,“আমরা এখনো কোনো বেতন বাড়াতে রাজি হয়নি। তারা যে ৩০০ টাকা মজুরি চাইছেন সুযোগ সুবিধা মিলিয়ে তার চেয়ে বেশি দিচ্ছি। তাদের সাথে আরো আলোচনা হবে।” চা সংসদ দাবি করেছে ২০১২ সাল থেকে ১০ বছরে চায়ের নিলাম মূল্যের প্রবৃদ্ধি প্রতি বছর  ০.১৬ শতাংশ হারে বাড়লেও চা-শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছ মোট ৯৪.২০ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ বিশ্বের তিন শতাংশ চা উৎপাদন করে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশি চায়ের বাজারের মূল্য প্রায় ৩ হাজার পাঁচশ’ কোটি টাকা।  জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ।

চা শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকারও বেশি দামের  চাপাতা নষ্ট হচ্ছে বলে দাবি বাগান মালিকদের।

সূত্র: ডয়েচে ভেলে

এসবি/