ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

বিদ্রোহী নজরুল: যৌবনের দীপ্ত তেজস্বী

দেবব্রত নীল

প্রকাশিত : ০৯:১৫ এএম, ২৭ আগস্ট ২০২২ শনিবার

বাংলা সাহিত্যের ধূমকেতু কাজী নজরুল ইসলামের অনবদ্য সৃষ্টি বাংলা ভাষাকে রূপৈশ্বর্যে বিকশিত করেছে। বাংলা ভাষার অভিধানমঞ্জুরীসমূহকে বিদ্রোহী শব্দরাশির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তিনি বাংলা ভাষাকেই অনন্য সৌন্দর্যে্য ভূষিত করেছেন। তাঁর অনন্যসাধারন সৃষ্টি ভারত ও বাংলাদেশে এক অখণ্ড ও অবিভাজ্য মহিমায় বিধৃত হয়ে আছে। নজরুলের জীবন গতানুগতিক সাধারণ মানুষের মতো ছিল না।  কবিতার মতোই তাঁর জীবন ছিল ঝঞ্জার মতো উদ্দাম,দুর্নিবার,দুর্বিনীত। বাধাঁ বন্ধনহীন হয়ে তিনি ছুটে বেড়াতেন বাংলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। বাধঁনহারা জীবনের সমস্ত পাওয়া না পাওয়ার বেদনাই তাঁর সৃষ্টিকে বৈচিত্র্যে ভরে তুলেছিল। তৈল মাখা ক্ষুদ্র তনু ও নিদ্রারসে ভরা কোমলকান্ত নিস্তেজম্লান জীবনে নূতন উদ্দীপনা ও উৎসাহের সঞ্চার করে তিনি মানুষকে মুক্তজীবনের ডাক শুনিয়েছিলেন।

নজরুল-প্রতিভার একটি বিশিষ্ট পরিচয় বহন করত তার চেহারা। যৌবনে নজরুলের গায়ের রঙ ছিল উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। চেহারায় ছিল আর্যের লক্ষণ। হাঁটার সময় তার মাথার  কোঁকড়ানো চুলগুলি নাচত। তার লেখা বিদ্রোহীভাবাত্মক গান ও কবিতাগুলি যেন মূর্ত হয়ে উঠত বলিষ্ঠ সুগঠিত দেহে।

 ১৩৩০ সালের (১৯২৩) আশ্বিন মাসের 'কল্লোলে’ নজরুলের সম্বন্ধে একটি পরিচয় লিপি প্রকাশিত হয়। এ সময় তার বয়স ছিল  ২৪ বৎসর। 
 
 “কবি নজরুল ইসলাম—বলিষ্ঠ সুগঠিত দেহ, মাথায় বড় বড় ঝাঁকড়া চল, গোঁফ আছে, বিদ্রোহীর মতই উৎসাহে উজ্জ্বল চোখ। চোখ দুটি যেন পেয়ালা, কখনো সে পেয়ালা খালি নেই, প্রাণের অরুণ রসে সুদই ভরপুর। গলাটি সারসের মতো পাতলা নয়, পুরুষের গলা যেমন হওয়া উচিত তেমনি সবল, বীর্য-ব্যঞ্জক। গলার স্বর ভারী, কিন্তু সেই মোটা গলার সুরে আছে যাদু । ঢেউয়ের আঘাতের মতো, ঝড়ের ঝাপটার মতো তার গান আছড়ে পড়ত শ্রোতার বুকে। অনেক চিকন গলার গাইয়ের চেয়ে নজরুলের মোটা গলার গান  লক্ষগুণ ভালো লাগত। ... প্রবল হতে সে ভয় পেত না, নিজেকে মিঠে দেখাবার জন্যে সে কখনো চেষ্টা করত না। রবীন্দ্রনাথের পরে এমন শক্তিশালী কবি আর আসেনি বাঙলা দেশে। ”

প্রতিভা সোম ঢাকায় নজরুলের কাছে গান শিখেছিলেন। নজরুল তার বিখ্যাত গানের বই চোখের চাতক প্রতিভা সোমকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গে লেখা হয় কল্যাণীয়া বীণা-কন্ঠী শ্রীমতী প্রতিভা সোম জয়যুক্তাসু। পরে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে প্রতিভা সোমের বিবাহ হয়। স্মৃতিচারণে ঢাকায় দেখা নজরুল সম্পর্কে প্রতিভা সোম লিখেছেন,
“থাকি ঢাকা শহরে, বয়স তখন তের... নজরুল ইসলামের বয়স তখন তিশ-বত্রিশ অথবা তারও কিছু বেশী কিনা আমি জানি না। যৌবন তার চোখে মুখে সমস্ত শরীরে নদীর স্রোতের মত বহমান ও বেগমান। সেই বয়সে তাকে যারা দেখেছেন শুধু তাদেরই বোঝানো যাবে কী দুকূলপ্লাবী আনন্দধারা দিয়ে গড়া তার চরিত্র। ... এই ব্যক্তিটি নানা কারণেই তাই নানা মানুষের কাছে এক কল্পনার নায়ক। বস্তুত এমনই একজন নায়ক কোন দেশে কোন কালেই অবিরল নয়। মস্ত বড়ো বড়ো টানা কালো চোখ, এলোমেলো ঘন চুলের বাবরি, তীক্ষ্ণ নাসিকা, ঘষা তামার মতো রং, লাবণ্য সহজ সরল অদাম্ভিক ব্যবহার, উদ্দাম হাসি, উচ্ছ্বাস প্রবণতা—সবটা মিলিয়ে একটা ব্যক্তিত্ব বটে। আর তার লাটিয়ে পড়া গেরুয়া চাদর।”

সাহিত্য সঙ্গীত ছাড়াও নজরুলের বিচরন ছিল প্রায় সকল ক্ষেত্রেই। রাজনীতি, সভাসমিতি,খেলার মাঠে, রঙ্গরসে ব্যঙ্গৰিদূপে সবখানেই তিনি ছিলেন সেরার সেরা। উনবিংশ শতাব্দীর লাঞ্চনা শোষন নিপীড়েনের বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন বিংশ শতাব্দীর কোলে জন্ম নেয়া এক শ্রেষ্ঠ উপহার।

নজরুলের প্রকৃতি সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু যা বলেছেন তা সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য।

“দেহের পাত্র ছাপিয়ে সব সময়েই উছলে পড়েছে তার প্রাণ, কাছাকাছি সকলকেই উজ্জীবিত করে মনের যত ময়লা, যত খেদ, যত গ্লানি সব ভাসিয়ে দিয়ে। সকল লোকই তার আপন, সব বাড়িই তার নিজের বাড়ি। শ্রীকৃষ্ণের মতো, তিনি যখন যার—তখন তার। জোর করে একবার ধরে আনতে পারলে নিশ্চিন্ত, আর ওঠবার নাম করবেন না—বড়ো-বড়ো জরুরি এনগেজমেন্ট ভেসে যাবে।...হয়তো দু’দিনের জন্যে কলকাতার বাইরে কোথাও গান গাইতে গিয়ে সেখানেই একমাস কাটিয়ে এলেন; সাংসারিক দিক থেকে এ-চরিত্র আদর্শ নয়, কিন্তু এ-চরিত্রে রম্যতা আছে তাতে সন্দেহ কী। সেকালে বোহেমিয়ান চাল-চলন অনেকেই রপ্ত করেছিলেন—মনে-মনে তাদের হিসেবের খাতায় ভুল ছিল না। জাত-বোহেমিয়ান এক নজরুল ইসলামকেই দেখেছি। অপরূপ তার দায়িত্বহীনতা।”

নজরুল-চরিত্রের সর্বজনীনতা তার সৃষ্টিকেও সর্বজনীন করে তুলেছিল। সাধারণ মানুষের মনের কথাগুলো সাহসের ফুল হয়ে পরাধীন দেশবাসীর নিকট আবিভূর্ত হয়। সাহসের ফুল যখন শাসককে হুল ফুটাতে শুরু করলো তখন তার কলম কেঁড়ে নিয়ে বদ্ধ করা হলো কারা প্রকোস্টে। নজরুল বজ্রযোগী সন্ন্যাসীর মতো সত্যের সাধন করেছেন বলেই অমরতার স্বীকৃতি পেয়েছেন।

১৯৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৯শে আগস্ট তারিখে নজরুলের মৃত্যর সংবাদ পেয়ে বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) এর কলম বার বার কেঁদে ওঠে। জিজ্ঞাসার আকাঙ্খায় তিনি ব্যক্ত করেনঃ
“কবি নজরুল ইসলাম
এক্ষুনি শুনিলাম।
তুমি নাকি মারা গেছ?।
এটা তো মিথ্যা খবর-
তুমি অবিনশ্বর,
তুমি বিদ্রোহী বীর,
মৃত্যুর কাছে তুমি কি নোয়াবে শির?”

বিদ্রোহী নজরুল জীবনে কারোর কাছে মাথা নত করেন নি। মৃত্যর কাছেও তিনি নতি স্বীকার করেননি। তিনি তাঁর জীবনের সমস্ত ধ্যান ও জ্ঞান দিয়ে যৌবনের বন্দনা করে গেছেন। নিপীড়িত, প্রবঞ্চিত ও পরাধীন মানুষের প্রতিনিধি  হয়ে নজরুল শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামে তার মানব জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। যতদিন পৃথিবীতে শোষণ, অত্যাচার ও লাঞ্ছনা থাকবে, ততদিন নজরুল বেঁচে থাকবে শোষিত ও লাঞ্ছিত জনগণের মুক্তির সংগ্রামে অদম্য মনোবল, প্রেরণা ও শক্তি হয়ে।  
এসএ/