পিসিওএস প্রতিরোধে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন জরুরি
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:২৭ পিএম, ২৭ আগস্ট ২০২২ শনিবার
পলিসিস্টি ওভারিয়ান সিনড্রোম (পিসিওএস) অনিরাময়যোগ্য রোগ। তবে সচেতন হলে প্রতিরোধ সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তাঁরা বলছেন, বিশ্বে প্রতি ১০ নারীর একজন এই রোগে আক্রান্ত। ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নারীরা সাধারণত এতে ভূগছেন। আক্রান্তের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সী কিশোরীর সংখ্যাই বেশি। দেশে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ পিসিওএস। ডায়াবেটিস, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইসিস-সি, বন্ধ্যত্ব, জরায়ু ক্যান্সারসহ দীর্ঘস্থায়ী অসংক্রামক রোগ বাড়াতে পিসিওএস বড় ভূমিকা রাখে। এ পরিস্থিতিতে রোগটি নির্মূলে ওজন নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন জরুরি।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে একটি দৈনিক পত্রিকার কার্যালয়ে 'পিসিওএস একটি হরমোনজনিত সমস্যা। জানুন, চিকিৎসা নিন' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এসব কথা বলেন। সমকাল, পিসিওএস টাস্কফোর্স এবং বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির আয়োজনে রেনেটা লিমিটেডের সহযোগিতায় গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
সমকালের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান শেখ রোকনের সঞ্চালনায় গোলটেবিলে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির পরিচালক ও পিসিওএস টাস্কফোর্সের প্রধান পৃষ্ঠপোষক অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান, পিসিওএস টাস্কফোর্সের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক এস এম আশরাফুজ্জামান, পিসিওএস টাস্কফোর্সের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সভাপতি (নির্বাচিত) অধ্যাপক হাফিজুর রহমান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিইএস-এর সাধারণ সম্পাদক এবং পিসিওএস টাস্কফোর্সের উপদেষ্টা ডা. শাহজাদা সেলিম, বারডেম হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিইএস-এর সহসভাপতি এবং পিসিওএস টাস্কফোর্সের উপদেষ্টা ডা. ফারিয়া আফসানা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিইএস-এর বৈজ্ঞানিক সম্পাদক এবং পিসিওএস টাস্কফোর্সের উপদেষ্টা ডা. এম সাইফুদ্দিন, বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও পিসিওএসের উপদেষ্টা সহযোগী অধ্যাপক তানজীনা হোসেন, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিইএস সদস্য এবং পিসিওএস টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব ডা. নাজমা আক্তার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিইএস-এর দপ্তর সম্পাদক এবং পিসিওএস টাস্কফোর্সের সমন্বয়ক ডা. মারুফ মোস্তারী, রেনাটা লিমিটেডের মার্কেটিং ম্যানেজার মো. খায়রুল ইসলাম প্রমুখ।
ডা. ফারুক পাঠান বলেন, দেশের তরুণীদের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পিসিওএস সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু তারা প্রকাশ্যে বলেন না। আন্তঃসামাজিক পরিবর্তন ও নগরায়ণের কারণে এই রোগের হার দিন দিন বাড়ছে। পরিশ্রমের অভাব ও অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণেও রোগটি দেখা দিতে পারে। নগরায়ণের প্রভাবে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে এই রোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক। আমাদের জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে পিসিওএস প্রতিরোধ সম্ভব। রোগটি প্রতিরোধে ওজন
নিয়ন্ত্রণ জরুরি। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে পিসিওএসের মতো আর ১০টি গুরুতর রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নিলে পরবর্তী সময়ে হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগ দেখা দিতে পারে। সচেতনতার অভাবে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসকের কাছে কম আসেন। প্রতিক্রিয়াটা ধীরে ধীরে হয় বলে ৭০ শতাংশের বেশি রোগী পরীক্ষার বাইরে থেকে যায়।
অধ্যাপক এস এম আশরাফুজ্জামান বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ জন নারীর মধ্যে ৩০ জনই এ রোগে ভোগেন। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত ও প্রতিরোধে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। আমাদের কাজ হলো সচেতনতা তৈরি করা, মানুষকে জানানো। মিডিয়ার কাজ হলো তা প্রচার করা। সরকারের কাজ পলিসিগত পরিবর্তন আনা। তিনি বলেন, কিশোরী অনেকেরই উচ্চতার তুলনায় অনেক ওজন বেশি দেখা দেয়। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে ওজন বাড়ে। পরে শরীরে ইনসুলিনের সমস্যা দেখা দেয়। তার মধ্যে পুরুষ হরমোন বাড়ে। এরপর মাসিক অনিয়মিত হয়। অনেকের মুখে দাড়ি লোম দেখা দেয়। বর্ণেও সমস্যা হয়। অনেকের চুল পড়ে যায়।
ডা. হাফিজুর রহমান বলেন, পিসিওএস আক্রান্ত নারীর বিভিন্ন সময়ে নানা জটিলতা দেখা দেয়। সন্তান জন্মদানের সময় শিশু ও মাতৃমৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। একলাম্পশিয়া দেখা দিতে পারে; অস্বাভাবিক ক্ষুধা, অতিরিক্ত হতাশাও তৈরি হতে পারে। পরবর্তী সময়ে জরায়ুতে কানসার, ডায়াবেটিস, হেপাটাইসিস-বি, হেপাটাইটিস-সি'তে আক্রান্ত হতে পারে।
ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, ১০ বছর আগেও প্রসূতি মায়েদের মধ্যে পিসিওএস সমস্যা বেশি ছিল না। দেশের মানুষের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তনের কারণে পিসিওএস বেড়েছে। এর ফলে গর্ভকালীন মায়ের জটিলতা বাড়ছে। পিসিওএস শিশু ও মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রজনন স্বাস্থ্যে পিসিওএসের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। আমরা যদি প্রজনন স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে চাই, গর্ভকালীন মাতৃমৃত্যু কমাতে চাই তাহলে শুরুতেই এই রোগ শনাক্ত ও প্রতিরোধে জোর দিতে হবে।
ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, বর্তমান বিশ্বের নারীরা যে সমস্যাগুলোয় বেশি ভুগে থাকেন তার অন্যতম হচ্ছে পিসিওএস। এটি কয়েকটি বিষয়ে সমন্বিত একটি হরমোনজনিত জটিলতা। এটি একটি হরমোন, যেখানে এন্ড্রোজেন বা ছেলেদের যে পুরুষালি হরমোনটা মেয়েদের শরীরে যতটুকু মাত্রায় থাকার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় নিঃসৃত হচ্ছে। পাশাপাশি সেটি ওজন বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন নারীর ভেতর অন্তত ১ জন এ রোগে আক্রান্ত। আক্রান্ত নারীর সবচেয়ে বেশি যে সমস্যা হয়, তা হলো অনিয়মিত পিরিয়ড। সাধারণত ২১ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে পিরিয়ডের স্বাভাবিক সময়। কিন্তু পিসিওএস হলে দুই মাস বা তিন মাস পরপর পিরিয়ড হয়। যারা এই সমস্যার মুখোমুখি, তাদের ভেতর ৫০ শতাংশ নারীই ওবিস।
ডা. ফারিয়া আফসানা বলেন, প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন নারীই পিসিওএস রোগে আক্রান্ত হন। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম দেখা দিলে নারীর শরীরে ইনসুলিন হরমোনের কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়। আবার, পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেনের মাত্রা রক্তে বেড়ে যায়। ফলে ওভারি বা ডিম্বাশয় থেকে ওভাম বা ডিম তৈরি হতে নানা অসুবিধা হয়।
তানজীনা হোসেন বলেন, এটি একটি হরমোনজনিত রোগ হলেও সামাজিক সমস্যাও বটে। প্রতিরোধে কিশোর বয়সেই ওজন নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। গণমাধ্যমেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার চাপের পাশাপাশি শরীরিক সুস্থতার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
ডা. এম সাইফুদ্দিন বলেন, বর্তমানে অনেক নারীই পিসিওএসে ভূগছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে এ রোগে আক্রান্তের হার বেড়েই চলেছে। নারীর প্রজনন হরমোনের তারতম্যই পিসিওএস হওয়ার কারণ।
ডা. নাজমা আক্তার বলেন, চিকিৎসা করানোর আগে রোগের ধরন সম্পর্কে জানতে হবে। পিসিওএসের মোট চারটি ধরন। প্রথমত, ইনসুলিন রেজিসট্যান্স পিসিওএস, যা প্রায় ৭০ শতাংশ পিসিওস রোগীর মধ্যেই দেখা দেয়। এক্ষেত্রে ইনসুলিনের প্রভাবে কোষগুলো অবশ হয়ে যায়। সাধারণত ইনসুলিনের প্রভাবে এ ধরনের পিসিওএস হয়। এতে ওজন বেড়ে যায়। দেখা দেয় ক্লান্তিও। প্রতিদিন ব্যায়াম করলে এ ধরনের পিসিওএসের সমাধান মিলবে। দ্বিতীয় ধরনটি হচ্ছে অ্যাড্রেনাল পিসিওএস।
যেসব নারীর মাসিকের সময় অনেক যন্ত্রণা হয় তাঁরা এ ধরনের পিসিওএসে আক্রান্ত। কর্টিসল ও ডিএইচইএ-এর উচ্চমাত্রার ইঙ্গিত দেয় এটি। তৃতীয় ও চতুর্থ ধরনটি হচ্ছে যথাক্রমে- ইনফ্লেমেটরি পিসিওএস ও পোস্ট-পিল পিসিওএস।
অনিয়মিত জীবনযাপন ও অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার ফলে এ ধরনের ইনফ্লেমেটরি পিসিওএস হয়। ফলে টেস্টোটেরনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা পিসিওএসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের পিসিওএস হলে মাথাব্যথা, ক্লান্তি ও ত্বকে ব্রণ দেখা দেয়। যেসব নারী ওরাল কনট্রাসেপটিভ পিল খাওয়া হঠাৎ করে বন্ধ করে দেন তাঁদের পোস্ট পিল পিসিওএস হতে পারে। কারণ, পিল বন্ধ করার পর কৃত্রিম প্রোজেস্টেরন ওভারিতে সমস্যা তৈরি করে, যা পিসিওএসের কারণ হতে পারে। এই চারটি
ধরনের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হলো প্রথম ধরনটি অর্থাৎ ইনসুলিন রেজিসট্যান্স পিসিওএস।
ডা. মারুফ মোস্তারী বলেন, আগে সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক নারী পলিস্টিক ওভারি সিনড্রোমে (পিসিওএস) আক্রান্ত হতেন। কিন্তু দিনে দিনে কিশোরীদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা যাচ্ছে। পিসিওএস রোগে যাঁরা ভুগছেন তাঁরা যেন অপচিকিৎসা গ্রহণ না করেন। কারণ, সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করলে এ রোগ প্রতিরোধযোগ্য। একইসঙ্গে সুস্থ জাতি গঠনে কৈশোর থেকেই মেয়েদের সুস্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন হতে হবে। এজন্য একটি গাইডলাইন জরুরি।
মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, পিসিওএস প্রতিরোধে রেনাটা লিমিটেড বিশ্বমানের ওষুধ বাজারে এনেছে। আগামী মাস পিসিওএস সচেতনতা মাস। এ মাসে জনসাধারণকে বিষয়টি জানাতে হবে। তাদের এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে।
শেখ রোকন বলেন, দেশ যখন আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এর 'সাইড এফেক্ট' হিসেবে পিসিওএস বাড়ছে। দুর্ভাগ্যবশত, বেশিরভাগ নাগরিকই বিষয়টি সম্পর্কে জানেন না। এজন্য জনসচেতনতা জরুরি।
কেআই//