ঢাকা, শুক্রবার   ০১ নভেম্বর ২০২৪,   কার্তিক ১৭ ১৪৩১

ফিল্ড ভিজিটে একদিন

মো: তানভির আহমেদ

প্রকাশিত : ১১:৪৮ এএম, ২৯ আগস্ট ২০২২ সোমবার

পুস্তক থেকে অর্জিত জ্ঞানকে মাঠ পর্যায়ের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়া এবং ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সংযোগের অংশ হিসেবে মাঠ পরিদর্শন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়াশোনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এক অনুষঙ্গ। 

শনিবার (২৭ আগস্ট) তেমনই এক ফিল্ড ভিজিটে অংশ নেয় দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। ফিল্ড ভিজিট হিসেবে কোথায় যাওয়া হবে, ড্রেসকোড কেমন হবে, কী কী পড়তে হবে, সঙ্গে কী কী নিতে হবে এবং প্রাসঙ্গিক বেশ কিছু বিষয় জানিয়ে দেওয়া হয় ক্লাসেই। হাবিপ্রবির ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ যাত্রা শুরু করে ২০১৯ সালে ৩৯ শিক্ষার্থী ও পাঁচজন শিক্ষক নিয়ে। 

গতবছর বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রথমবার ফিল্ড ভিজিটে যায় বিভাগ। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। লেভেল-২, প্রথম সেমিস্টারের 'জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট' কোর্সের অংশ হিসেবে এ ফিল্ড ভিজিট। ফিল্ড ভিজিটে বিভাগ থেকে সংশ্লিষ্ট কোর্স শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক মোঃ মাহবুব চৌধুরী এবং বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক জুয়েল আহমেদ সরকার সফরে যুক্ত হন।

করোনা বন্ধের কারণে অফিসিয়ালি বিভাগের কারও কোথাও ট্যুর বা বনভোজনে যাওয়া হয়নি। এবারই প্রথম বিভাগের সবাই একসঙ্গে কোথাও যাওয়া, তাও আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে! তাই ফিল্ড ভিজিট এক প্রকার ঘুরতে যাওয়ার বাতাস পেয়ে বসে। নির্দেশনা মোতাবেক সকাল ৭টা ৫০মিনিট থেকে ক্যম্পাসে উপস্থিত হতে শুরু করে সবাই। সবাইকে নিয়ে বাস ছাড়ে ৮টা ২০মিনিটে। ভুটান থেকে আগত একজন বিদেশী শিক্ষার্থীসহ বিভাগের মোট ৫২জন শিক্ষার্থী এই ফিল্ড ভিজিটে অংশ নেয়। সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে রংপুর ব্রাক লার্নিং সেন্টার, দর্শনা, রংপুরে পৌঁছে যায় গাড়ি। আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন তারা। ফুল দিয়ে বরণ, শুভেচ্ছা বক্তব্য, ক্রেস্ট প্রদান ,প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প সম্পর্কে জানাতে স্লাইড প্রদর্শন এসবের মাঝেই আকাশটা অন্ধকার হয়ে আসে। 

দুপুরের পর থেকে ঝড়ো বৃষ্টিতে বারবার সিডিউল বিপর্যয় হয় ফিল্ড ওয়ার্কের মাঝে। এর মাঝে ‘জানো’ প্রকল্পের অধীনে জেলা পর্যায়ে কিশোরীদের কারাতে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে, অস্ট্রিয়ান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশনের সহ-অর্থায়নে, কেয়ার বাংলাদেশ ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তায় এবং ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) কর্তৃক বাস্তবায়নকৃত প্রজেক্ট জয়েন্ট এ্যাকশান ফর নিউট্রিশন আউটকাম বা (জানো)। এই প্রকল্পের আওতায় রংপুর জেলার ৩টি উপজেলার (গংগাচড়া, কাউনিয়া ও তারাগঞ্জ) নির্বাচিত ৭৯টি মাধ্যমিক ও ২১টি মাদ্রাসায় এবং নীলফামারী জেলার ৪ টি উপজেলায় (নীলফামারী সদর, ডোমার, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ) নির্বাচিত ১৬৯টি মাধ্যমিক ও ২৮টি মাদ্রাসায় সরকারের সহায়ক প্রকল্প হিসেবে কাজ করছে।

প্রকল্পের আওতায় ১৭৫ জন ছাত্রীকে আত্মরক্ষার কৌশল বিষয়ক ৩২ দিনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং প্রশিক্ষণ শেষে প্রকল্প এলাকার ৭ টি উপজেলায় প্রশিক্ষণ পরবর্তী সমাপনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিশোরীদের ইতোমধ্যে সনদ ও বেল্ট প্রদান করা হয়েছে। কিশোরীদের উৎসাহ দ্বিগুণ করতে রংপুর জেলার ৩টি উপজেলার গংগাচড়া, কাউনিয়া ও তারাগঞ্জ) নির্বাচিত ১২ জন প্রশিক্ষনার্থীদের নিয়ে রংপুর জেলা পর্যায়ে সেই কারাতে প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয় এবং প্রতিযোগিতা শেষে ৩ জন বিজয়ীর হাতে ক্রেস্টসহ অংশগ্রহনকারী সকলের হাতে একটি করে স্মারক সনদ তুলে দেওয়া হয়।

এই ভিজিটে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে পড়ানো জেন্ডার এর সঙ্গে ডেভেলপমেন্টের যে ওতপ্রোত সম্পর্ক তা আরও একবার অনুধাবন করে স্বচক্ষে। সমাজের বড় একটি অংশ নারী। এখনও কিছু সমাজে তারা অবহেলিত ও বঞ্চিত সবকিছু থেকে। সামান্য সহযোগিতা ও কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ পেলে নারীরা সামিল হতে পারবে সমাজের মূলধারায়। ফিল্ড ওয়ার্কে অংশ নেওয়া একজন শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার। 

তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে একটি বিষয় দেখে বড় হয়েছি যে, আমার বেসিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে স্কুলে যাওয়ার বই-খাতা, ড্রেস সব পরিবারের সদস্য মা-বাবা বা ভাই এনে দিলেও পরিবেশের সাথে মিশতে বা যখন পরিবার আমার সাথে থাকবেনা সেই পরিবেশে নিজেকে কীভাবে নিরাপদ রাখবো এই বিষয়টি তেমন প্রাধান্য পায়নি। আমার কোন প্রশিক্ষণ বা স্কিল নেই এমন পরিবেশে পড়ে গেলে কী করতে হবে। কিন্তু প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ নারীদের আত্মরক্ষার্থে কারাতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে একেবারে স্কুল লেভেল থেকেই, যা সত্যিই প্রশংসনীয়’। 

বিকেলে ঝড় কিছুটা কমলে মনিরামপুর বড়খোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে যায় ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা। উপস্থিত কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে মতবিনিমত করেন তারা। বিদ্যালয়ে একটি কর্নার আছে যেখানে শিক্ষার্থীদের তরুণ ও বয়ঃসন্ধিকালের নানা পরিবর্তন ও রোগ বিষয়ে সচেতন করা হয়। যা শিক্ষার্থীদের কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে সহায়তা করে। স্কুলের শিক্ষার্থীরা বেশ স্বাস্থ্য সচেতনও বটে। স্কুলের একপাশে বাগান করেছে নিজেরা। এটি তাদের জন্য অপ্রতুল কি না এমন প্রশ্নে তারা বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে পতিত যায়গায় এবং উঠানে বাগান করেছি সকলে। সেখান থেকে উৎপাদিত সবজি পরিবারের সদস্যরা মিলে খাই’।

সারাদিনে বিভিন্ন জায়গা ঘোরা এবং প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া শেষ। এবারে ফেরার পালা। প্রতিষ্ঠানটির এবং বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যদের সঙ্গে আলাদা পরিচয় পর্ব ও ফটোসেশন শেষ করে গাড়িতে উঠি। এভাবেই শেষ হয় বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের আনন্দঘন ও শিক্ষণীয় প্রথম ফিল্ড ভিজিটের। এখানে না আসলে হয়ত বিষয়গুলো বই-পুস্তকে পড়েই মুখস্থ রাখতে হতো শিক্ষার্থীদের। আজ স্বচক্ষে দেখলো সবাই। এমন ফিল্ড ভিজিট সামাজিক বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি কোর্সেই থাকা উচিত। পরিবর্তনশীল এ বিশ্বের গতিশীল সকল বস্তু। ইন্ডাস্ট্রিগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে যুগোপযোগী গ্রাজুয়েট তৈরির মাধ্যমে বেকার ও অদক্ষ জনগোষ্ঠীর অভিশাপ ঘোচানো সম্ভব। এ জন্য তাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের, প্রফেশনালসদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এমন আন্তঃসম্পর্ক ও মিথষ্ক্রিয়া অত্যন্ত জরুরি।

এসি