বাংলাদেশে সবচেয়ে কম মজুরি কোন খাতে?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১২:৪৩ পিএম, ১ সেপ্টেম্বর ২০২২ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১২:৪৬ পিএম, ১ সেপ্টেম্বর ২০২২ বৃহস্পতিবার
বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের পর তাদের নিম্ন মজুরি পাওয়ার বিষয়টি সবার মনোযোগে এসেছে। অবশেষে সরকারের হস্তক্ষেপে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র চা শ্রমিকরাই নয়, এরকম নিম্ন মজুরি পাচ্ছেন বাংলাদেশের আরও অনেক খাতের শ্রমিক। সবচেয়ে কম মজুরি পান বিড়ি শ্রমিককরা। আর সবচেয়ে বেশি পান নির্মাণ এবং সমিল শ্রমিকরা।
জ্বালানি ও ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জীবনের চড়া দাম, মূল্যস্ফীতির চাপে এই নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন করে তুলেছে।
এর কোন কোন খাতের মজুরি গত কয়েক বছরে পুনঃনির্ধারণ করা হলেও অনেকগুলো খাতের মজুরির কোন পরিবর্তন হয়নি। আবার সরকার নির্ধারিত মজুরির কম দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে কোন কোন খাতে।
বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি
বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশা খাতের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণে সরকারের একটি বিশেষ বোর্ড রয়েছে। এই বোর্ড নিয়মিতভাবে মজুরি পর্যালোচনা করে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে দেয়ার কথা।
কিন্তু তৈরি পোশাকের মতো খাতে কিছুটা নিয়মিতভাবে মজুরি নির্ধারণ করা হলেও অন্যসব খাতের শ্রমিকদের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে।
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. সেলিনা আক্তার এই প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ''আমি কিছুদিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি। এখন পুরো বিষয়টি যাচাই করে দেখবো। তবে কোনও সেক্টরে যদি মজুরি সময়োপযোগী না করা হয়, নিশ্চয়ই আমরা ব্যবস্থা নেবো।''
শ্রম সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৬ কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে, যারা বিভিন্ন খাতে কাজ করেন।
বাংলাদেশের সরকার ৪২টি খাত নির্ধারণ করে এই শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছে।
যদিও যে খাতে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করেন, সেই কৃষি খাতের ক্ষেত্রে আলাদা কোন মজুরি নেই। বাজারের চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে সেখানে মজুরি নির্ধারিত হয়।
বাংলাদেশের কোন খাতের শ্রমিকরা কেমন মজুরি পান?
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের গেজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একটি খাত থেকে আরেকটি খাতের মজুরির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে।
কোন কোন খাতের মজুরি মাত্র তিন হাজার টাকা, আবার কোন কোন খাতের মজুরি ১৬ হাজার টাকার বেশি।
যেমন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার টাকা। যার মধ্যে বেসিক হবে ৪ হাজার ১০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ২ হাজার ৫০ টাকা এবং অন্যান্য ১ হাজার ৮৫০ টাকা।
বিদেশি ক্রেতাদের চাপ, সরকারি নজরদারি ও শক্তিশালী শ্রম সংগঠন থাকায় এই খাতে মজুরি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
কিন্তু অন্যান্য খাতে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে সেটি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এর বাইরে রাবার শিল্প, পাটকল, বিড়ি, ম্যাচ শিল্প, জুট প্রেস, সিনেমা হল, হোসিয়ারি, কোল্ড স্টোরেজ, পেট্রোল পাম্প, আয়ুর্বেদিক কারখানা, আয়রন ফাউন্ড্রি. ওয়েল মিলস অ্যান্ড ভেজিটেবল প্রোডাক্টস, লবণ শিল্প, ইত্যাদি খাতের মজুরি সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয়েছিল বহু বছর আগে।
যেমন কোল্ড স্টোরেজ ও ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প খাতের শ্রমিকদের সর্বশেষ মজুরি নির্ধারিত হয়েছিল ২০১২ সালে, ম্যাচ শিল্পের ২০১৩ সালে আর বিড়ি শিল্পের ২০১৬ সালে।
আবার পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি বহু বছর আগে নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে আর সমন্বয় করা হয়নি। তবে এই খাতে এখন শ্রমিকরা আট থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসে আয় করেন বলে জানা গেছে।
বাজারে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল রেখে সেগুলো পরবর্তীতে আর সমন্বয় করা হয়নি। তবে কয়েকটি খাতের মজুরি পুন:নির্ধারণের কাজ চলছে বলে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিড়ি শ্রমিকরা এক হাজার বিড়ি তৈরির বিনিময়ে পান সাড়ে ৩১ টাকা। আর যারা দিন ভিত্তিক কাজ করেন তারা পান দিনে ২২০ টাকা। এদিকে নির্মাণ শ্রমিকদের দিনে মজুরি ৬২০ টাকা।
কেন বিভিন্ন খাতের মজুরিতে এতো পার্থক্য?
বিভিন্ন খাতের মজুরি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, খাত ভেদে নিম্নতম মজুরিতে অনেক পার্থক্য রয়েছে।
যেমন হোটেল ও রেস্তোরায় নিম্নতম মজুরি ৩৭১০ টাকা হলেও নির্মাণ ও কাঠ শিল্পে এটি ১৬ হাজার টাকার বেশি।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের একজন পরিচালক নাজমা ইয়ামসিন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''বিভিন্ন খাতে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা, ঝুঁকি ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে অনেক সময় মজুরির কমবেশি হয়। যেমন একজন দক্ষ কাঠমিস্ত্রি কিন্তু মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত মজুরির চেয়েও বেশি আয় করতে পারেন। আবার অনেকে নির্ধারিত মজুরি কাঠামোর কমও নিতে বাধ্য হন।''
কোন খাতের মজুরি নির্ধারণ করার পর তিন থেকে পাঁচ বছর পরপর সেটি পুর্নমূল্যায়ন করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু অনেক খাতের মজুরি বছরের পর বছর ধরে আর কোন পরিবর্তন হয়নি।
নাজমা ইয়াসমিন বলছেন, ''সাধারণত নতুন মজুরি নির্ধারিত হয় সরকার, মালিক পক্ষ আর ট্রেড ইউনিয়নের আলোচনার মাধ্যমে। অনেক সময় সরকার বা মালিক নিজে থেকে এটা করতে পারে, আবার শ্রমিকদের চাপেও হতে পারে। কিন্তু অনেক খাতে দেখা যায়, যেসব খাতের ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠন জোরালো নয়, তাদের মজুরির বিষয়টি ঠিকভাবে মনোযোগ পায় না।''
বাংলাদেশে প্রায় ৬ কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে বলে বিলস জানিয়েছে। এর প্রায় অর্ধেক অদক্ষ শ্রমিক।
তিনি জানান, অনেক সময় নিজেদের অধিকার, সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরির বিষয়টি শ্রমিকদের জানা থাকে না। ফলে তারা মালিকদের সঙ্গে দরকষাকষি বা অধিকার আদায় করে নিতে পারে না।
অনেক সময় বিভিন্ন খাতের শ্রমিকরা যেমন মজুরি বোর্ড অনুযায়ী বেতন পান, আবার বাজারের চাহিদাও তেমন মজুরি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
যেভাবে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়
বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরী নির্ধারণ করা হয়। এই আইনে বলা আছে, কিভাবে নিম্নতম মজুরী বোর্ড গঠন হবে, কিভাবে কাজ করবে, কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে এবং কতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করবে, সবই সেখানে বলা হয়েছে।
তবে কোন পেশার মজুরীর ক্ষেত্রে নিম্নতম মজুরী বোর্ড নিজেরা উদ্যোগ নিতে পারে না। এ বিষয়ে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে তাদের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানোর পর এই মজুরী বোর্ড কাজ শুরু করে এবং তাদের পর্যালোচনা শেষে সুপারিশ প্রদান করে।
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পর পর নিম্নতম মজুরী পুনর্বিবেচনা করার বিধান রয়েছে।
ফলে কোন কোন খাতে যেমন পাঁচবছর পরে পুনরায় পর্যালোচনা করা হয়, কোন কোন খাতে তিনবছর পরে হয়ে থাকে, আবার কোন কোন খাতে দীর্ঘসময় ধরে কোন পর্যালোচনা হয় না।
সাধারণত শ্রমিকদের জীবনযাপনের ব্যয়, জীবনযাপনের মান, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা এবং দ্রব্যের মূল্য, মূল্যস্ফীতি এগুলোর সঙ্গে কাজের ধরণ অর্থাৎ সেই কাজে ঝুঁকি কতটা আছে এবং মালিক পক্ষের কতটা সামর্থ্য আছে, সেগুলোও বিবেচনায় নিয়ে নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসবি/