ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

বরিস জনসন এরপর কী করবেন?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:০০ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ মঙ্গলবার

বরিস জনসকে কাজ খুঁজতে স্থানীয় জব সেন্টারে যেতে হবে না, এটা ধরেই নেয়া যায়।

বরিস জনসকে কাজ খুঁজতে স্থানীয় জব সেন্টারে যেতে হবে না, এটা ধরেই নেয়া যায়।

যুক্তরাজ্যে কনজারভেটিভ পার্টিকে ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিজয় এনে দিয়েছিলেন যিনি, সেই বরিস জনসন মাত্র তিন বছরের মাথায় পদত্যাগ করেছেন। শৈশবে তিনি 'বিশ্বের রাজা' হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু এখন তাকে তার কেরিয়ারের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।

বরিস জনসনের জীবনী লেখক এন্ড্রু গিমসন বলছেন, তিনি মোটেই সে ধরণের ব্যক্তিত্ব নন, যিনি কিনা ক্ষমতা ছাড়ার পর গ্রামে নিভৃত জীবন কাটাবেন এবং স্থানীয় চার্চের জন্য অনেক ভালো কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবেন।

তাহলে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়ার পর বরিস জনসন এখন কী করতে পারেন?

লেখালেখিতে ফিরে যাওয়া
রাজনীতিতে যোগ দেয়ার আগে সাংবাদিকতার পেশায় বেশ ভালো উপার্জনই করতেন বরিস জনসন। ওয়েস্টমিনস্টারের রাজনীতির তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে যখন তিনি উপরের দিকে উঠছেন, তখনো কিন্তু তিনি লেখালেখি অব্যাহত রেখেছিলেন। কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কয়েকদিন আগে তিনি তার লেখালেখিতে বিরতি দেন।

লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে সপ্তাহে একটি কলাম লেখার জন্য তাকে বছরে দুই লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ড দেয়া হতো। এখন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর লেখা পাওয়ার জন্য হয়তো গণমাধ্যমে রীতিমত একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতে পারে।

নিজের স্মৃতিকথা লেখার প্রস্তাবেও হয়তো তিনি প্রলুব্ধ হতে পারেন। যে কোন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এধরণের স্মৃতিকথা থেকে নিশ্চিতভাবেই ভালো আয় হতে পারে। প্রকাশনা জগতে এমন জল্পনা আছে, বরিস জনসনকে তার ক্ষমতায় থাকাকালীন স্মৃতিকথার জন্য হয়তো ১০ লাখ ডলারেরও বেশি দেয়া হতে পারে।

জনসন এরই মধ্যে আটটি বই লিখেছেন (যদি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাঁর কলামের সংকলনগুলোকেও গোনায় ধরা হয়)। এর মধ্যে তার নায়ক উইনস্টন চার্চিলের জীবনী এবং রাজনৈতিক স্যাটায়ার 'সেভেনটি টু ভার্জিনস' এর মতো বহু বিক্রিত বইও রয়েছে।

তবে ডাউনিং স্ট্রীট ছাড়ার পর তার প্রথম কাজ হবে শেষ পর্যন্ত উইলিয়াম শেক্সপীয়ারকে নিয়ে লেখা জীবনী-গ্রন্থটি শেষ করা, গত সাত বছর ধরে যেটি নিয়ে তিনি থেমে থেমে কাজ করছেন।

'শেক্সপীয়ার: দ্য রিডল অব জিনিয়াস' নামের এই বইটির প্রকাশনা স্বত্ব এর মধ্য একটি প্রকাশনা সংস্থা 'হোডার এন্ড স্টাউটন' পাঁচ লাখ পাউন্ডে কিনে নিয়েছে বলে শোনা যায়।

দু'হাজার ষোল সালে বইটি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্রেক্সিট গণভোটে জয়লাভ, এরপর প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জনসন তার লেখালেখির এই সময়সূচি ঠিক রাখতে পারেন নি।

"ক্ষমতা, কখন বিদ্রোহ করতে হবে এবং একজন রাজাকে হত্যা করতে হবে- শেক্সপীয়ারের লেখার মূল বিষয় কিন্তু এগুলোই", বলছেন এন্ড্রু গিমসন, যার লেখা বরিস জনসনের জীবনী-গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ সামনের মাসে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। "এখন যেহেতু নিজের দলই তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, কাজেই এই বইটি শেষ করার মতো উপাদান হয়তো তিনি সেখানেই পেয়ে যাবেন।"

বক্তৃতা দিয়ে আয়
সাবেক প্রধানমন্ত্রীরা যেসব কাজ করে বিপুল আয় করেন তার একটি হচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেয়া। বরিস জনসনের পূর্বসূরি টেরেসা মে কেবল ২০২২ সালেই নয়টি বক্তৃতা দিয়ে আয় করেছেন সাত লাখ ১৫,০০০ পাউন্ড।

জনসন যেহেতু বেশ কমেডি করতে পারেন, তাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেও ডিনার শেষের বক্তৃতার অনুষ্ঠানে তাকে পেতে অনেক উদগ্রীব ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি আরো বড় ধরনের অনুষ্ঠানে যেতে পারেন।

দু'হাজার উনিশ সালের মার্চ মাসে যখন তিনি কোন সরকারি দায়িত্বে ছিলেন না, তখন তাকে এক লাখ ৬০ হাজার পাউন্ড দেয়া হয়েছিল মাত্র দুটি বক্তৃতার জন্য- এর একটি ছিল একটি ব্যাংকের অনুষ্ঠানে, অন্যটি একটি ভারতীয় মিডিয়া গ্রুপের অনুষ্ঠানে।

"নিঃসন্দেহে তিনি এখন অনেক লেখালেখি করবেন, অনেক জায়গায় বক্তৃতা দেবেন," বলছেন লর্ড উডনি-লিস্টার, যিনি বেশ দীর্ঘ সময় বরিস জনসনের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। বরিস জনসন যখন লন্ডনের মেয়র ছিলেন, তখন লর্ড উডনি-লিস্টার তাঁর চীফ অব স্টাফ ছিলেন। পরে জনসন যখন প্রধানমন্ত্রী, তখনও আবার তিনি তার চীফ অব স্টাফ হন। 

তিনি বলছেন, বরিস জনসন এখন হয়তো তার প্রিয় বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবেন।

"যেমন ধরুন ইউক্রেন, যেখানে এখন পশ্চিমা জোটকে দুর্বল হতে দেখা যাচ্ছে," বলছেন লর্ড সভায় কনজারভেটিভ পার্টির এই সদস্য।

বক্তৃতা দিয়ে যে সেখান থেকে অনেক আয় করা যায়, সেটি সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী মোটেই ভুলবেন না, বলছেন লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক টিম বেইল।

"যতটুকু ধারণা পাওয়া যায়, তাতে মনে হয় বরিস জনসনের অর্থের প্রতি বেশ আগ্রহ আছে, কিন্তু তার অনেক বন্ধু-বান্ধব যেরকম অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন, সেটা তার নেই। কাজেই কিছু অর্থ উপার্জনের জন্য যা করা দরকার, তিনি হয়তো তাই করবেন।"

রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো
বরিস জনসন আর পার্লামেন্টে এমপি হিসেবে থাকবেন কিনা, তা নিয়ে অনেক জল্পনা আছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী তাকে মন্ত্রিসভায় কোন পদে নেবেন, এমন সম্ভাবনা কম। কাজেই, এর মানে হলো তাকে পেছনের সারিতে ফিরে যেতে হবে - যেটি এর আগেও তিনি করেছেন রাজনীতিতে হোঁচট খাওয়ার পর।

তবে যাই ঘটুক, ডাউনিং স্ট্রিট ছাড়ার পর আগামী দুবছর কিন্তু তিনি কোন কোম্পানির পক্ষে কোন তদবির করতে পারবেন না। ব্রিটেনে মন্ত্রীদের যে আচরণবিধি, তাতে এটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

"আমার মনে হয় না এত দ্রুত তিনি পার্লামেন্ট থেকে বিদায় নেবেন," বলছেন লর্ড উডনি-লিস্টার। "কিন্তু আমার এটাও মনে হয় না, তিনি পার্লামেন্টের পেছনের সারিতে বসে কেবল পাথর ছুঁড়বেন।"

তবে মি. জনসনের জন্য কিছু বিপদ আছে। লকডাউনের সময় বিধিনিষেধ ভেঙ্গে ডাউনিং স্ট্রীটে যেসব পার্টি হয়েছিল, সেগুলো এখন তদন্ত করছে এমপিদের একটি কমিটি। যদি এই তদন্তে দেখা যায় যে এ ব্যাপারে তিনি পার্লামেন্টে মিথ্যে বলেছিলেন, তাহলে পার্লামেন্ট থেকে তাকে বরখাস্ত করা হতে পারে।

লন্ডনের যে আসন থেকে তিনি এমপি হয়েছেন, সেখানে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা মাত্র সাত হাজার একশো ভোটের। যদি সামনের নির্বাচনে ভোটাররা ব্যাপক হারে কনজারভেটিভ পার্টি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তাহলে এই আসনটি ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।

রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন
পার্লামেন্টে সর্বশেষ যে 'প্রাইম মিনিস্টার'স কোয়েশ্চন' পর্বে বরিস জনসন অংশ নিয়েছিলেন, সেখানে তিনি বলেছিলেন, 'তার লক্ষ্য মোটাদাগে অর্জিত হয়েছে, তবে আপাতত', কিন্তু তারপর তিনি বলেছিলেন, হাস্টা লা ভিস্টা, বেবি' (আবার দেখা হবে)। এটুকু ইঙ্গিত দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হতে পারতেন, কিন্তু এরপরই হলিউডের টার্মিনেটর ছায়াছবির আরেকটি শব্দ-গুচ্ছ দিয়ে তিনি বক্তৃতা শেষ করেন, "আই উইল বি ব্যাক (আমি ফিরে আসবো)।"

তিনি কি আসলেই ফিরে আসতে পারেন? যদি তার উত্তরসূরি পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে হেরে যান, তাহলে হয়তো বিরোধী দলের নেতা হিসেবে?

প্রফেসর বেইল, যিনি কনজারভেটিভ পার্টির ইতিহাস নিয়ে একটি বই লিখেছেন, তিনি বরিস জনসনের এরকম প্রত্যাবর্তন উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তবে, তাঁর মতে, এক্ষেত্রে দলের মধ্যে তাকে ফিরে পাওয়ার জন্য একটা মরিয়া চেষ্টা থাকতে হবে।

"কিন্তু কনজারভেটিভ পার্টি যদি বরিস জনসনের কাছে ফিরে যায়, তাহলে দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুবই চিন্তায় পড়ে যাবো," বলছেন প্রফেসর বেইল।

জ্যাকব রিস-মগ দীর্ঘদিন ধরে বরিস জনসনের এক ঘনিষ্ঠ মিত্র। তিনি চাননি বরিস জনসন ক্ষমতা ছাড়ুন। সম্প্রতি তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোনের পর আজ পর্যন্ত কেউ একবার নেতৃত্ব হারানোর পর আবার ফিরে আসেননি। কিন্তু গিমসন এসব ঐতিহাসিক তুলনা নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজী নন।

"তিনি যেটাই করুন না কেন, বরিস জনসনকে নিয়ে একটা অন্ধভক্তি থেকেই যাবে। অনেকেই দুই বা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন মাঝখানে বিরতি দিয়ে।"

নিজের পথে চলবেন?
তবে বরিস জনসন যেটাই করুন না কেন, একটি সরকারি ভাতা (পাবলিক ডিউটি কস্ট এলাউন্স) তিনি পাবেন, যেটা তাকে সাহায্য করবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজর এই ভাতা চালু করেন। এর অধীনে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বছরে এক লাখ ১৫ হাজার পাউন্ড পান, যেটি দিয়ে তিনি তার অফিস এবং সেক্রেটারির খরচ নির্বাহ করতে পারেন।

বরিস জনসন অনেক দীর্ঘ সময় ধরে রাজনীতির যেসব স্বাভাবিক নিয়ম-নীতি, সেগুলো অগ্রাহ্য করে গেছেন। এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে তিনি তার পূর্বসূরিদের পথে হাঁটবেন।

গিমসন বলেন, "তিনি কখনোই হয়-এটা-নয়-ওটা ধরণের ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি যেটা চান, সেটাই করেন। আমার মনে হয় তিনি যেটাই করেন, তা নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকবেন। কোন কিছু না করে বসে থাকা তার ধাতে নেই।"

প্রফেসর বেইল একথার সঙ্গে একমত: "এখানে তো তার হারানোর কিছু নেই। রাজনৈতিক প্রচারণা, রাজনীতিতে ফিরে আসা, এবং পাশাপাশি অর্থকড়ি উপার্জন - এর সবকিছুই তো একসঙ্গে চলতে পারে।" সূত্র: বিবিসি

এসি