ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

বিশ্বনেতারা স্মরণ করছেন একজন ‘মহৎপ্রাণ রানিকে’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:৫৩ পিএম, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:২০ পিএম, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ শুক্রবার

বিশ্বনেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন, যিনি ৯৬ বছর বয়সে মারা গেছেন। তারা রানির গভীর দায়িত্ববোধ ও সহনশীলতা এবং রসবোধ ও দয়ালু মনোভাবের প্রতি সম্মান জানিয়েছেন।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাঁক্র রানিকে স্মরণ করেছেন 'একজন মহৎপ্রাণ রানি' হিসেবে, যিনি ছিলেন 'ফ্রান্সের একজন বন্ধু'।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রানির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করেছিলেন ৪০ বছর আগে। তিনি রানিকে বর্ণনা করেছেন - 'একজন সম্রাজ্ঞীর চাইতেও বেশি কিছু, যিনি একটি যুগের নির্মাতা"।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০২১ সালে যুক্তরাজ্য সফরের কথা উল্লেখ করে মিস্টার বাইডেন বলেন, "তিনি তার রসবোধ দিয়ে আমাদের উদ্বেলিত করেছেন, দয়ালু হৃদয় দিয়ে মুগ্ধ করেছেন এবং তার প্রজ্ঞা আমাদের মধ্যে ছড়িয়েছেন"।

"রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন অতুলনীয় প্রজ্ঞাবান একজন রাষ্ট্রনায়ক যিনি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে গভীর করেছেন। আমাদের সম্পর্ককে দৃঢ় করতে তিনি সহায়তা করেছেন," মিস্টার বাইডেন যোগ করেন।

কানাডার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন রানি এলিজাবেথ দ্বিতীয়। তার রাজত্বের সময়ে ১২ জন প্রধানমন্ত্রী দেশটির দায়িত্বে এসেছেন।

আবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন কানাডিয়ানদের জন্য তার ছিলো গভীর ভালোবাসা।

মিস্টার ট্রুডো বলেছেন রানির সঙ্গে আলাপচারিতার অভাব বোধ করবেন তিনি, যেখানে রানি ছিলেন জ্ঞানী, কৌতূহলী, সহায়ক ও মজার এবং আরও অনেক কিছু। "তিনি ছিলেন দুনিয়ায় আমার প্রিয় মানুষদের একজন। আমি তার অভাব বোধ করবো," অশ্রুসজল কণ্ঠে বলছিলেন তিনি।

'একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব'
ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কমিশনসহ বিশ্বজুড়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হচ্ছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডেন লেইন বলেছেন, রানির প্রতিটি প্রজন্মের সাথে সহমর্মিতা ও সক্ষমতা, ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগ - সবই ছিলো সত্যিকার নেতৃত্বের উদাহরণ।

নেদারল্যান্ডসের রাজা উইলেম -অ্যালেক্সান্ডার রানি এলিজাবেথের দূরসম্পর্কের কাজিন। তিনি ও রানি ম্যাক্সিমা প্রয়াত রানির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে তাকে 'অবিচল ও জ্ঞানী' হিসেবে স্মরণ করেছেন।

সুইডেনের রাজা কার্ল ষোড়শ গুসতাফিও রানির একজন আত্মীয়। তিনি বলেছেন, "তিনি সবসময় আমার পরিবারের প্রতি সহমর্মী ছিলেন এবং আমাদের যৌথ পারিবারিক ইতিহাসের একজন মূল্যবান যোগসূত্র"।

বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপ্পে এবং রানি মাথিলডে রানি এলিজাবেথকে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যিনি তার রাজত্বের সময়কালজুড়ে মর্যাদা, সাহস আর একনিষ্ঠতা দেখিয়েছেন।

রানির সাথে জাস্টিন ট্রুডোর সাক্ষাত হয়েছে অনেকবার, এমনকি এ বছরের গোড়াতেও একবার দেখা হয়েছে উইন্ডসরে

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ রানির চমৎকার রসবোধের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার পর জার্মান-ব্রিটিশ পুনর্মিলনে তার অঙ্গীকার চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে"।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজের দু'দফা যুক্তরাজ্য সফরের সময় রানির সাথে সাক্ষাতের কথা স্মরণ করেছেন। "আমি কখনো তার আন্তরিকতা ও সহৃদয়তাকে ভুলবো না,"এক টুইট বার্তায় বলেন তিনি।

"এক সাক্ষাতের সময় রানি মহাত্মা গান্ধী তার বিয়েতে যে রুমাল উপহার দিয়েছিলেন সেটি আমাকে দেখিয়েছিলেন। আমি সবসময়ই এই সৌজন্যতার প্রশংসা করি"।

সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান ও যু্বরাজ মোহাম্মেদ বিন সালমান তাদের শোকবার্তা পাঠিয়েছেন, যেখানে বাদশাহ রানিকে বর্ণনা করেছেন 'নেতৃত্বের রোল মডেল, যা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে'।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ব্রিটিশ সরকার ও জনগণকে আন্তরিক সমবেদনা জানিয়েছেন। বলেছেন "তার চলে যাওয়া ব্রিটেনের মানুষের জন্য বিরাট ক্ষতি"।

একটি আশ্বস্ত উপস্থিতি
সাত দশক ধরে রাজত্বের সময়ে রানি এলিজাবেথ অসাধারণ সব পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছেন। এটিও অনেকের শ্রদ্ধা জানিয়ে দেয়া বার্তায় উঠে এসেছে। বারাক ওবামা লিখেছেন, "উন্নতি ও স্থবিরতার সময়কালে তিনি ছিলেন- চাঁদে পা রাখা থেকে শুরু করে বার্লিন ওয়ালের পতন পর্যন্ত"।

গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। "ব্রিটেনকে বিশ্বের টালমাটাল সময়ে নেতৃত্ব দেয়া রানির মৃত্যু শুধু ব্রিটিশ জনগণের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও একটি বিশাল ক্ষতি," তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন।

আইরিশ প্রেসিডেন্ট মাইকেল ডি হিগিনস শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেছেন রানির অসাধারণ কর্তব্যবোধ ব্রিটিশ ইতিহাসে বিশেষ জায়গা দখল করে রাখবে।

"তার ৭০ বছরের রাজত্বকালজুড়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যেখানে তিনি ব্রিটিশ জনগণকে আশ্বস্ত হওয়ার মতো উল্লেখযোগ্য উৎস হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন," বিবৃতিতে বলছিলেন তিনি।

আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিচেল মার্টিন রানির সময়কালকে 'ঐতিহাসিক সময়' উল্লেখ করে রানির চলে যাওয়াকে 'একটি যুগের অবসান' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

"জনসেবা ও দায়িত্বের প্রতি তার নিষ্ঠা ছিলো সুস্পষ্ট এবং তার প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা ছিলো সত্যিকার অর্থে অনন্য," মিস্টার মার্টিন বলেছেন তার বিবৃতিতে।

আয়ারল্যান্ডে ২০১১ সালে সফরের সময়ে রানির সৌজন্যতা ও উষ্ণ মন্তব্যের কথাও স্মরণ করেছেন তিনি।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, উপনিবেশ থেকে আফ্রিকা ও এশিয়াকে বের করে আনা ও কমনওয়েলথের উদ্ভবসহ কয়েক দশকের ব্যাপক পরিবর্তনের সময়ে রানি এলিজাবেথ ছিলেন একজন আশ্বস্ত উপস্থিতি।

এক বিবৃতিতে তিনি জনগণের জন্য জীবনভর কাজ করার জন্য রানির প্রতি সম্মান জানান। "বিশ্ব তার নেতৃত্ব ও নিষ্ঠাকে দীর্ঘকাল ধরে স্মরণ করবে", বলেন তিনি।

রানি এলিজাবেথ আরেক কমনওয়েলথ রাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়া সফর করেছেন ১৬ বার। প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ বলেছেন অনেকে তাকে ছাড়া এই বিশ্বকেই জানে না।

"বহু বছরের কোলাহল ও গোলমালের মধ্যে তিনি নিরন্তর ভদ্রতা ও ধৈর্যশীল প্রশান্তি প্রদর্শন করেছেন"।

"তিনি ভালো সময়কে উদযাপন করেছেন। তিনি খারাপ সময়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। খুশি ও গৌরবোজ্জ্বল কিন্তু স্থিতিশীল"।

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, ভোর ৪টা ৫০ মিনিটে একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে রানির মৃত্যুর খবর দিয়েছেন।

"তিনি ছিলেন অসাধারণ। রানির জীবনের শেষ দিনগুলো থেকেই বোঝা যায় যে বিভিন্ন দিকে তিনি কে ছিলেন। তার ভালবাসার জনগণের পক্ষে তিনি সব দিকেই কাজ করেছেন," বলছিলেন তিনি।

তিনি ইতিহাসেই বাস করেছেন, তিনি ইতিহাস নির্মাণ করেছেন
রানি এলিজাবেথ দ্বিতীয় তার রাজত্বের সময়কালে তের জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, রানি বিশ্বকে বিমোহিত করেছেন তার দয়া, কমনীয়তা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে।

আরেক সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন তিনি কখনোই রানির বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, মহান প্রজ্ঞা ও দারুণ রসবোধের কথা ভুলবেন না।

'একজন মহান ও সুন্দর নারী ছিলেন তিনি - তার মতো কেউই ছিলো না' - মিস্টার ট্রাম্প এটি তার নিজের অনলাইন প্লাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন।

পুরো রাজত্বকালে যে ব্যাপক পরিবর্তন রানি দেখেছেন তা উল্লেখ করে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগও বলেছেন "তিনি স্থিতিশীলতা, দায়িত্বপূর্ণ নেতৃত্ব ও নৈতিকতা, মানবিকতা ও দেশপ্রেমের বাতিঘর হিসেবে একজন আইকন হয়ে থাকবেন"।

রানি ইসরায়েল সফর করেননি। তবে প্রিন্স চার্লস, এডওয়ার্ড, উইলিয়াম ও প্রয়াত প্রিন্স ফিলিপ গিয়েছেন। প্রিন্স ফিলিপ কে কবর দেয়া হয়েছে জেরুসালেমে-

"রানি এলিজাবেথ ঐতিহাসিক চরিত্র ছিলেন। তিনি ইতিহাসে বাস করেছেন। ইতিহাস নির্মাণ করেছেন। বিদায়ের মধ্য দিয়ে তিনি চমৎকার উৎসাহমূলক লিগ্যাসি রেখে গেছেন," প্রেসিডেন্ট হারজগ লিখেছেন।

জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ দ্বিতীয় বলেছেন, তার দেশ আইকনিক নেতার মৃত্যুতে শোক পালন করছে। তিনি বলেন, রানি ১৯৮৪ সালে জর্ডান সফর করেছিলেন।

"তিনি ছিলেন প্রজ্ঞা ও নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্বের বাতিঘর...জর্ডানের একজন পার্টনার ও প্রিয় পারিবারিক বন্ধু"।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি টুইট বার্তায় বলেছেন যে, এই অপূরণীয় ক্ষতির খবর তার জন্য ছিলো গভীর দুঃখের।

রাশিয়ার নেতা ভ্লাদিমির পুতিন রানির সাথে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ করেছেন এবং একবার রানিকে ১৪ মিনিট অপেক্ষমাণ রেখেছিলেন বলে খবর এসেছিলো।

তিনি রাজা তৃতীয় চার্লসের কাছে গভীর শোকবার্তা পাঠিয়েছেন।

"সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যুক্তরাজ্যের সাথে রানীর নাম অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত হওয়া," এক বিবৃতিতে লিখেছেন মিস্টার পুতিন।

"কয়েক দশক ধরে দ্বিতীয় এলিজাবেথ সঠিকভাবেই সম্মান ও ভালোবাসা উপভোগ করেছেন এবং একইভাবে পেয়েছেন বিশ্বমঞ্চের কর্তৃত্ব"।

রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমাদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার কবলে আছে এখন। আফ্রিকান নেতারাও রানি এলিজাবেথের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। কমনওয়েলথ দেশের প্রধান হিসেবে অনেকেই তাকে খুব ভালোভাবে জানতেন।

কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী উইলিয়াম রুটো রানির ঐতিহাসিক লিগ্যাসির প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন কেনিয়ার মানুষ দেশটির সাথে রানির আন্তরিক সম্পর্কের অভাব বোধ করবে।

সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ কেনিয়া ১৯৬৩ সালে স্বাধীন হয়েছিলো। রানির কাছে এটি ছিলো একটি বিশেষ জায়গা। এখান থেকে তিনি রানি হয়েছিলেন।

উনিশশো বায়ন্ন সালে তার ২৫ বছর বয়সে তখন প্রিন্সেস হিসেবে ছুটি কাটাতে সেখান গিয়েছিলেন তিনি। তখন তার পিতা রাজা ষষ্ঠ জর্জ ঘুমের মধ্যে মারা যান। কমনওয়েলথে যুক্ত হওয়া নতুন দেশ গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট আলী বঙ্গো অনডিম্বা বলেছেন, রানি ছিলেন আফ্রিকার মহান বন্ধু এবং বিনিময়ে আফ্রিকাও তাকে ভালোবেসেছে।

ঘানার প্রেসিডেন্ট নানা আকুফো আড্ডু টুইট করে তার দেশে রানির সফরের কথা স্মরণ করেছেন।

"দায়িত্ব পালনে তিনি বন্ধুত্বপূর্ণ আভিজাত্য, স্টাইল ও আনন্দ নিয়ে এসেছিলেন"।

রানি যখন ঘানা সফর করেছিলেন তখন সেটিও ছিলো ব্রিটিশ উপনিবেশ। সফরটি ছিলো বিতর্কিত ও রানির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ছিলো। মাত্র পাঁচ দিন আগে আক্রায় বোমা বিস্ফোরণ হয়। কিন্তু রানি নিরুৎসাহিত হননি। কারণ এর আগেও একবার তাকে সফর বাতিল করতে হয়েছিলো গর্ভবতী থাকার কারণে। সূত্র: বিবিসি

এসি