ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

যে ‘অসম্ভব’ কাজের জন্য নোবেল পেলেন সেভান্তে পেবো

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:০৭ পিএম, ৫ অক্টোবর ২০২২ বুধবার

কল্পনা করুন, একটি ডিকশনারির সবগুলো পাতা একটি কাগজের শ্রেডারে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং আপনাকে নতুন করে ডিকশনারিটি তৈরি করতে হবে। এবার কল্পনা করুন, ঐ ডিকশনারি থেকে কাগজের হাজার হাজার টুকরো অন্য বইয়ের কাগজের হাজার হাজার সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

এবার সেই কাগজের টুকরোর পাহাড়ের ওপর ঢেলে দিন এক কাপ কফি।

ফলাফল: একটি বিশাল কাগজের বল যাতে মিশ্রিত রয়েছে লক্ষ লক্ষ অক্ষর, অনেক ছাপা কাগজের ছোট ছোট অংশ, যার মানে বোঝা যায় না, এবং যেগুলো আলাদা করে পড়লে রীতিমতো বিভ্রান্ত হতে হয়।

এখন, সেই ডিকশনারিটিকে আপনি কি আবার নতুন করে তৈরি করতে পারবেন?

সুইডিশ বিজ্ঞানী সেভান্তে পেবো এভাবেই বর্ণনা করেছেন, নিয়ান্ডারথাল যুগের মানুষের বিলুপ্তির হাজার হাজার বছর পর তার ডিএনএর গঠন নকশা নতুন করে তৈরি করতে গিয়ে তিনি কী কঠিন সমস্যায় পড়েছিলেন।

মানুষের বিবর্তনের বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য ড. সেভান্তে পেবোকে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়।

সময়ের সাথে সাথে এই প্রাক-হোমো স্যাপিয়েন্স যুগের মানুষের সম্ভাব্য অবশেষের ক্ষয়, শত শত বছর ধরে ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের সাথে বসবাস, এবং আধুনিক মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ফলে নিয়ান্ডারথাল মানুষের ডিএনএকে আবার এক জায়গায় জড়ো করার কাজটি হয়ে উঠেছিল প্রায় অসম্ভব।

ড. পেবো ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে লিখেছিলেন, ‘নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ-র এমন সব ধরণের ক্ষতি হয়েছে যা জিনের বিন্যাস তৈরি করতে গিয়ে আপনাকে ভুল ফলাফল দিতে পারে, বিশেষভাবে আপনাকে যখন খুব অল্প সংখ্যক অণু নিয়ে কাজ শুরু হয়। এছাড়া সব জায়গাতেই রয়েছে আধুনিক মানুষের ডিএনএ-র মাধ্যমে নানা ধরনের দূষণ।’

কিন্তু ড. পেবো এবং তার দল সেই কাজেই সফল হয়েছেন, এবং এর জন্য সোমবার তিনি চিকিৎসার জন্য ২০২২ সালের নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন।

‘তার এই অগ্রণী গবেষণার মাধ্যমে সেভান্তে পেবো দৃশ্যত: অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন: আধুনিক মানুষের বিলুপ্ত আত্মীয় নিয়ান্ডারথালের জিনের পূর্ণাঙ্গ বিন্যাস তৈরি করেছেন,’ তাকে পুরষ্কার দেয়ার সিদ্ধান্তের ঘোষণায় নোবেল কমিটি মন্তব্য করেছে।

কিন্তু কাজটা কীভাবে করা হলো?

চাবিকাঠি ছিল প্রাচীন মিশরে
নিয়ান্ডারথাল মানুষের জিন নকশা তৈরির যে প্রক্রিয়াটি ড. পেবো ব্যবহার করেছেন তা বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে তার কৈশোরে। তার বয়স যখন ১৩ তখন তার মা তাকে নিয়ে মিশরে গিয়েছিলেন ছুটি কাটাতে।

সেখানে তিনি মিশরের প্রাচীন সংস্কৃতি এবং প্রত্নতত্ত্ব দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তখনই সিদ্ধান্ত নেন তিনি ভবিষ্যতে একজন মিশরবিদ হবেন।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে সেভান্তে পেবো ভর্তি হন স্টকহোম থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবং সেখানে তিনি ইজিপ্টোলজি বা মিশরবিদ্যায় ডিগ্রি শুরু করেন।

যাহোক, দু'বছর পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি জীবনে যা চেয়েছিলেন মিশরবিদ্যা তা নয়। এই বিভাগে পড়াশুনার প্রধান ঝোঁক ছিল হায়ারোগ্লিফিক ভাষার ব্যাকরণ শিক্ষার দিকে। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখতেন মমি আর পিরামিড আবিষ্কার করবেন।

এবিষয়ে বছর কয়েক আগে ড. পেবো বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘আমি যা ভেবেছিলাম এটা মোটেও তেমন রোমান্টিক কিংবা ইন্ডিয়ানা জোনস টাইপের ব্যাপার ছিল না।’

এই কারণেই তিনি ইজিপ্টোলজি ছেড়ে শুরু করলেন মেডিসিন পড়া। এরপর তিনি মলেকিউলার জেনেটিক্সে ডক্টরেট করেন। আর এর মধ্য দিয়েই কৈশোরে তার যে বিষয়কে ঘিরে তার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল সেই বিষয়কে তিনি তার পেশার ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত করতে পেরেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস ড. পেবোর ওপর যে প্রোফাইল প্রকাশ করেছে তাতে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বুঝতে শুরু করলাম যে ডিএনএ ক্লোন করার জন্য আমাদের কাছে অনেক প্রযুক্তি রয়েছে। কিন্তু এই প্রযুক্তি কেউ প্রত্নতাত্ত্বিক দেহাবশেষ - বিশেষ করে মিশরীয় মমিগুলির ওপর প্রয়োগ করেছে বলে মনে হয় না।’

ফলে এই পথ ধরে তিনি তৈরি করতে পারবেন, বলা যায়, তার নিজস্ব জিনোমিক টাইম মেশিন।

বিষয়টি নিয়ে তার প্রবল উৎসাহ তাকে টেনে নিয়ে গেল মমির ডিএনএ অধ্যয়নের দিকে। এর কয়েক বছর পর তিনি চলে যান ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট বার্কলেতে প্রাচীন ডিএনএ অনুসন্ধান নিয়ে গবেষণার জন্য।

এরপর এই গবেষণার ধারায় তিনি চলে যান জার্মানির মিউনিখে, যেখানে গুহাবাসী ম্যামথ এবং মেরু ভল্লুকের গবেষণায় তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন।

কাজটা সহজ ছিল না, কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি।

সময়ের সাথে সাথে তিনি আরও অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু করার জন্য প্রস্তুত হন: অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিয়ান্ডারথাল মানুষের ডিএনএ রহস্য উন্মোচন এবং বর্তমানের আধুনিক মানুষের থেকে নিয়ান্ডারথাল মানুষের জিন বিন্যাস কতখানি আলাদা তা ব্যাখ্যা করা।

তিনি হয়তো তখন ভেবে দেখেননি, কিন্তু তার হাত ধরেই বিজ্ঞানে চালু হয়েছিল নতুন একটি শাখা: প্যালিওজেনোমিক্স।

৪০ হাজার বছরের প্রাচীন কঙ্কাল
উনিশশো নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে জার্মানির লাইপজিগের ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর ইভোল্যুশনারি অ্যানেথ্রোপলজি বিভাগ ড. পেবোকে চাকরি দেয়।

তিনি নিয়ান্ডারথালদের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ নিয়ে কাজ করে আসছিলেন এবং এই ইন্সটিটিউট তাকে বিশাল এক গুণগত অগ্রগতির সুযোগ তৈরি করে দেয়। সেটা হলো ডিএনএ নিউক্লিয়াসের গঠন সম্পর্কে গবেষণা করা।

চিকিৎসার জন্য নোবেল পুরস্কার প্রদানের দায়িত্বে থাকা করোলিনস্কা ইন্সটিটিউট এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘নতুন ইন্সটিটিউটে, ড. পেবো এবং তার দল পুরাতন হাড় থেকে ডিএনএ-কে আলাদা করা এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করার পদ্ধতিগুলিকে ক্রমাগত উন্নত করেছেন। গবেষণা দলটি নতুন প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়েছে যা জিন বিন্যাসকে খুব সুদক্ষ করে তুলেছে।’

নিয়ান্ডারথাল জিন বিন্যাসের এই গবেষণার জন্য প্রায় ৪০,০০০ বছর আগের নিয়ান্ডারথাল হাড়ের নমুনা ব্যবহার করা হয়। এই হাড়গুলোতে ডিএনএ-এর কোডগুলি ভালভাবে সংরক্ষিত ছিল।

এবং এর পেছনে একটি কারণ ছিল, তা হল এই হোমিনিডদের মধ্যে নরমাংস খাওয়ার প্রথা।

‘আমরা যখন নমুনাগুলি বিশ্লেষণ করেছি তখন লক্ষ্য করেছি যে প্রায়ই আমরা এমন হাড়ের টুকরোগুলিতে বেশি সাফল্য পেয়েছি যেগুলিতে কাটা দাগ ছিল কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে যে হাড়গুলিকে ভাঙা হয়েছিল। জীবাশ্মবিদদের মতে, এর থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে এই মানুষগুলিকে খেয়ে ফেলা হয়েছিল,’ ড. পেবো বিবিসিকে বলছিলেন।

‘আপনি যদি হাড়ের এই সামান্য টুকরোগুলো থেকে মাংসকে আলাদা করে খেয়ে ফেলেন এবং হাড়গুলো গুহার কোণে ফেলে দেন, তাহলে সেখানে তারা দ্রুত শুকিয়ে যাবে এবং হাড়গুলোর মধ্যে মাইক্রোবিয়াল তৎপরতা কম হবে।। এবং এগুলো অনেক দ্রুত শুকিয়ে যাবে।’

‘আমাদের নিয়ান্ডারথাল প্রকল্পের সাফল্যের জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয় এসব নরখাদকদের,’ বলছিলেন তিনি।

এই কাজে ড. পেবো আধুনিক ডিএনএ সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেন এবং উঁচু মানের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য এমন পরীক্ষাগার তৈরি করেন যেটি নমুনাগুলিতে দূষণ রোধ করতে পারে।

এরপর তিনি লক্ষ লক্ষ ডিএনএ খণ্ড বিশ্লেষণ করেন এবং পরিসংখ্যানগত কৌশল ব্যবহার করে দূষণ সৃষ্টিকারী আধুনিক জিন থেকে সেগুলোকে আলাদা করেন।

এই গবেষণার মাধ্যমে তিনি শুধুমাত্র নিয়ান্ডারথালের ডিএনএ-র বিন্যাসই আবিষ্কার করেননি। তিনি একই সঙ্গে এর জিনোম এবং আধুনিক মানুষের মধ্যে সংযোগও খুঁজে পেয়েছেন।

এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে হোমো স্যাপিয়েন্সের সাথে নিয়ান্ডারথালদের যৌন সম্পর্ক ছিল এবং নিয়ান্ডারথালদের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি ঘটেছিল।

একই সঙ্গে গবেষকরা হোমিনিডের আরেকটি প্রজাতি আবিষ্কার করেছিলেন যা মূলত এশিয়ায় বাস করত। এর নাম ডেনিসোভান।

আর পর পর এসব আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবেই এই সুইডিশ গবেষককে বিশ্বের সবচেয়ে অসামান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। সূত্র: বিবিসি

এসি