যেভাবে শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক টুইটার কিনে নিলেন
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১২:২২ পিএম, ২৯ অক্টোবর ২০২২ শনিবার
ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান হোসে শহরে মার্চের শেষভাগে এক স্নিগ্ধ সন্ধ্যা। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির জন্য এয়ারবিএনবি থেকে ভাড়া নেয়া এক বাড়িতে তাড়াহুড়ো করে আয়োজন করা হয়েছে একটি বৈঠক।
এটি টুইটারের ভবিষ্যতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইলন মাস্ক সম্প্রতি টুইটারের সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডারে পরিণত হয়েছেন। এখন কানাঘুষো চলছে, তিনি কোম্পানির বোর্ডেও যোগ দিতে চান।
টুইটারের চেয়ারম্যান ব্রেট টেলর সভাস্থলে এসে যা দেখলেন, সেটা তিনি প্রত্যাশা করেননি।
তিনি নাকি ইলন মাস্ককে পরে টেক্সট করে জানিয়েছিলেন, "এর চেয়ে আজব কোন জায়গায় আমি সম্প্রতি এরকম কোন বৈঠক করিনি।"
তিনি আরও বলেছিলেন, "এরা হয়তো এয়ারপোর্টের কাছাকাছি জায়গায় কোন এয়ারবিএনবি খুঁজছিল। সেখানে ট্রাক্টর থেকে গাধা, সবই ছিল।"
তবে বৈঠকটি বেশ ভালোভাবেই হয়েছিল।
এর কদিন পরেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল যে মিস্টার মাস্ক টুইটারের বোর্ডে যোগ দিচ্ছেন।
তবে এটি ছিল শুরু মাত্র। পরের ছয় মাসে যা ঘটেছিল সেরকম খ্যাপাটে ঘটনা সিলিকন ভ্যালির ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে। টুইটারের মালিকানা বদল নিয়ে চুক্তি একদিন এগুচ্ছে তো পরদিনই ভেঙ্গে পড়ছে- এরকম একটা অবস্থা।
এপ্রিলের শুরুতে ইলন মাস্ককে বেশ খুশিই মনে হচ্ছিল টুইটারের পরিচালনা বোর্ডে যোগ দিতে পেরে। তিনি ঘন ঘন টুইট করছিলেন কিভাবে এই কোম্পানি এখন বদলে যাবে।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে আসলে সমস্যা দানা বাঁধছিল। তার সঙ্গে টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পরাগ আগরওয়ালের বৈঠকে বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কিভাবে টুইটারের নানা সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে, সে প্রশ্ন দুজনের মধ্যে বেশ মতভেদ তৈরি হয়েছিল। ইলন মাস্ক বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন।
"পরাগের সঙ্গে কথা বলে টুইটারের সমস্যার সমাধান মিলবে না", এরকম টেক্সট পাঠিয়ে নাকি তিনি মি. টেলরকে তার হতাশার কথা জানিয়েছিলেন। "আমাদের কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।"
এরপর ইলন মাস্ক ১৪ এপ্রিল একটা ঘোষণা দিয়ে সবাইকে চমকে দিলেন- তিনি টুইটার একাই কিনে নিতে চান।
এজন্য তিনি ৪৪ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ চার হাজার ৪শ কোটি ডলার দাম অফার করে বললেন, এই দামে হলে তিনি কিনবেন, নইলে নয়।
টুইটারের বোর্ড সাথে সাথেই এই দাম প্রত্যাখ্যান করলো। তারা এমন কিছু ব্যবস্থাও নিল, যাতে করে ইলন মাস্ক টুইটার কিনতে না পারেন।
কিন্তু তারপরেই অবশ্য টুইটারের বোর্ড তাদের মত বদলালো। তারা বললো, ইলন মাস্কের প্রস্তাবে তারা রাজী। ২৫ এপ্রিল টুইটার আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা দিল।
ইলন মাস্ক টুইটার নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, এটি আসলে পথ হারিয়ে ফেলেছে। তিনি বলেছিলেন, টুইটার খুব বেশীমাত্রায় মত প্রকাশের অধিকার সীমিত করছে এবং, বিশ্বের 'টাউন হল' হিসেবে এটিকে মত প্রকাশের অধিকারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
কানাডার ভ্যাংকুভারের একটি বাণিজ্য সম্মেলনে তিনি বললেন, তিনি এই কোম্পানির অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে মোটেই চিন্তিত নন।
তবে ইলন মাস্ক টুইটার কেনার ঘোষণা দেয়ার পরের সপ্তাহ এবং মাসগুলোতে শেয়ার বাজারে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম পড়ে যাচ্ছিল। কোম্পানি হিসেবে টুইটারের দামও তখন কমতে থাকে। তখন অনেক বিশ্লেষকই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন, মি. মাস্ক টুইটারের জন্য বেশি দাম দিয়ে ফেলেছেন কিনা।
তবে মিস্টার মাস্ক প্রকাশ্যে ভিন্ন কিছু প্রশ্ন তুলছিলেন- তার একটা হচ্ছে, টুইটারে আসল ব্যবহারকারী একাউন্টের সংখ্যা কত?
ফোর্বস এবং ব্লুমবার্গ বিশ্বের সেরা ধনীদের যে তালিকা করেছে, ইলন মাস্ক আছেন তার শীর্ষে। তার সম্পদের পরিমাণ নাকি ২৫০ বিলিয়ন, অর্থাৎ দুই হাজার ৫০০ কোটি ডলার। ইলন মাস্ক অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে যাচ্ছিলেন যে, টুইটারে বট বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি করা ভুয়া একাউন্টের সংখ্যা অনেক বেশি।
টুইটার কেনার জন্য তার দেয়া প্রস্তাব যখন গৃহীত হলো, তখন তিনি বার বার জানতে চাইছিলেন, টুইটারের সত্যিকারের ব্যবহারকারীর সংখ্যা আসলে কতো।
টুইটারের নির্বাহীরা তখন জানিয়েছিলেন, প্রতিদিনের সক্রিয় ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫ শতাংশেরও কম আসলে 'বট' বা স্বয়ংক্রিয় কৃত্রিম ব্যবহারকারী। কিন্তু এই পরিসংখ্যান শুনে ক্ষেপে গিয়েছিলেন ইলন মাস্ক।
বট একাউন্টের এই সংখ্যাটা কিভাবে তারা হিসেব করে বের করেছেন, তা নিয়ে টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিস্টার আগরওয়াল একটি দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছিলেন। মিস্টার মাস্ক সেই পোস্টের জবাব দেন 'পুপ', অর্থাৎ মলের ইমোজি পোস্ট করে।
টুইটারের সঙ্গে ইলন মাস্কের চুক্তি তখন ধসে পড়ার উপক্রম। এরপর ৮ জুলাই তিনি ঘোষণা দিলেন, তিনি এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে চান।
ইলন মাস্ক আরও কম দামে টুইটার কিনতে দরকষাকষি করতে চাইছিলেন নাকি আসলেই এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছিলেন, সেটা বলা মুশকিল।
তবে টুইটার এসব কথা মানতে চাইছিল না। তারা যুক্তি দিচ্ছিল যে, টুইটার কেনার জন্য যে চুক্তি ইলন মাস্ক করেছেন, সেই চুক্তি মানতে তিনি আইনগত-ভাবে বাধ্য এবং এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
দুই পক্ষই এরপর নামী-দামী আইনজীবীদের নিয়োগ করেন, এবং ১৭ অক্টোবরে ডেলাওয়ারে এক আদালতে মামলার শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়, যেখানে মি, মাস্ককে চুক্তি মেনে কোম্পানিটি কিনতে বাধ্য করা হবে।
আদালতে দাখিল করা কাগজপত্রে টুইটার বলেছিল, এই প্লাটফর্মের প্রকৃত ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য তারা ইলন মাস্ককে দিয়েছে।
কিন্তু মি. মাস্ক বলেছিলেন, বট একাউন্টের সংখ্যা সম্পর্কে টুইটার প্রকাশ্যে যে দাবি করে, প্রকৃত সংখ্যা হয়তো তার কয়েকগুণ। তিনি এমনকি কোম্পানিটির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ পর্যন্ত এনেছিলেন।
প্রকাশ্যে কোম্পানির এরকম ক্রমাগত সমালোচনা টুইটারের বেশ ক্ষতি করছিল। টুইটারের বেশিরভাগ রাজস্ব আসে বিজ্ঞাপন থেকে। বিজ্ঞাপনদাতারা ভাবছিলেন, তাদের বিজ্ঞাপন আসলে ঠিক কতসংখ্যাক মানুষের কাছে পোঁছাচ্ছে।
টুইটার সদর দফতরেও এসব চাপ কাজ-কর্মে বেশ ব্যাঘাত সৃষ্টি করছিল। টুইটারের কিছু কর্মী বেশ চাইছিলেন ইলন মাস্ক যেন তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হয়ে আসেন। কিন্তু অনেকে গোপনে এবং প্রকাশ্যে বলছিলেন, ইলন মাস্ক টুইটার কিনে নিলে সেটা হবে একটা বিপর্যয়, কোম্পানির সার্বিক লক্ষ্য থেকে শুরু করে 'কনটেন্ট মডারেশন', সবকিছুর জন্য।
বিষয়টা যেন অবধারিতভাবেই আদালতে একটা মামলার দিকে গড়াচ্ছিল। মি, মাস্ক নিজে, টুইটার, বিচারকরা, সাংবাদিকরা- সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এই মামলার জন্য। কিন্তু তারপরই ঘটনা আবারও নাটকীয় মোড় নিল।
টুইটারের বিরুদ্ধে নানা রকমের গাদা গাদা অভিযোগ করার পর আচমকা মিস্টার মাস্ক আবার ঘোষণা করলেন, তিনি চুক্তি মোতাবেক টুইটার কিনতে চান।
তিনি বললেন, "টুইটার কেনার মানে হচ্ছে 'এক্স' অ্যাপ তৈরির কাজ ত্বরান্বিত হওয়া। এই এক্স অ্যাপকে তিনি বর্ণনা করেছেন 'এভরিথিং অ্যাপ' বা সবকিছু করতে পারে এমন একটি অ্যাপ হিসেবে।
কেন তিনি তার মত বদলালেন? হয়তো তিনি ভেবেছিলেন মামলায় তিনি হেরে যেতে পারেন। নিজের সিদ্ধান্ত বদলের কয়েকদিন আগে টুইটারের আইনজীবীদের এক সওয়াল জবাবের মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল তার। তিনি হয়তো একটা এরকম কড়া জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়ে অনেক তথ্য প্রকাশে বাধ্য হতে চাননি।
কারণ যেটাই হোক, টুইটার যে সর্বশেষ ঘোষণার পরও খুশিতে শ্যাম্পেনের বোতল খোলেনি, তার যথেষ্ট কারণ আছে।
ইলন মাস্কের সঙ্গে এই চুক্তি করতে গিয়ে তারা একবার দংশনের শিকার হয়েছে, দুই বার ইতস্তত করেছে। তবে এবার টুইটারের চেয়ারম্যান মি, টেলর টুইট করে শুধু বলেছেন, ইলন মাস্কের সঙ্গে লেন-দেন সম্পন্ন করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ।
টুইটার এখন আদালতের মামলাটির কার্যক্রমও স্থগিত রাখতে বলেছে, তবে একবারে বাতিল করতে বলেনি। অন্যদিকে মিস্টার মাস্কের আইনজীবীরা বলেছেন, কোন 'না' জবাব তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
২৮ অক্টোবর লন্ডন সময় বিকেল পাঁচটার মধ্যে মিস্টার মাস্ককে টুইটার কেনার জন্য অর্থ পরিশোধ করতে হবে বলে কথা ছিল।
ইলন মাস্কের ব্যাংক এবং ধনী বন্ধুরা এজন্যে শত শত কোটি ডলার ঢালবেন। বাকীটা দেবেন তিনি নিজে, কিছুটা টেসলায় তার শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে। যে চুক্তিটা একদম ভেস্তে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল, তা এখন শেষ পর্যন্ত কার্যকর হতে যাচ্ছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসবি/