আমরা একটু কম খেলে অনেকে খেতে পায়
অমল সরকার
প্রকাশিত : ০১:১৮ পিএম, ২ নভেম্বর ২০২২ বুধবার | আপডেট: ০৩:০৮ পিএম, ২ নভেম্বর ২০২২ বুধবার
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি সতর্কবার্তা নিয়ে রাজনীতির ময়দান বেশ সরগরম। তিনি বিশ্বব্যাপী মন্দা এবং সেই সূত্রে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা প্রকাশ করে দেশবাসীকে বলেছেন, জমি ফাঁকা ফেলে না রেখে কিছু না কিছু চাষ করতে।
শেখ হাসিনার বক্তব্য এপারেও কিছু মানুষের নজর কেড়েছে। তাঁদের একজন, আমার পরিচিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক কৃষি আধিকারিক আমাকে ক’দিন আগে বলছিলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সময়োপযোগী কথাটি বলেছেন। কারণ, জনসংখ্যা বাড়লেও চাষের জমি বৃদ্ধির কোনও সুযোগ নেই। বরং প্রতি বছর অ-কৃষি কাজে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার একর কৃষি জমি। গোটা বিশ্বই এই সমস্যার শিকার। ফলন বৃদ্ধিরও একটা সীমা আছে। কিন্তু জনসংখ্যা তুলনায় বাড়বেই।
সমস্যাটা হল, আসন্ন আর্থিক মন্দা। যে বিপদের কথা শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন, বিশ্বের নামজাদা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরাও বলছেন। মন্দা শুরু হলে আমদানির পরিমাণ কমতে বাধ্য। ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের জোগানে ভাটা পড়া অসম্ভব নয়। তাছাড়া, মন্দার সময় রপ্তানি কম-বেশি সব দেশই কমিয়ে দেবে।
তখন দেখা দেবে আসল চ্যালেঞ্জ। সেই আসল চ্যালেঞ্জটা হল কে নিজের খাবারের সংস্থান নিজে করতে পারে। সাধারণভাবে আমরা ধরে নিই, দু-বেলা খাবার জোগানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অতএব চ্যালেঞ্জটা তাঁদের, যাঁরা কিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছেন।
কিন্তু বিষয়টির এতটা সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। কিছু পরিস্থিতি আসে যখন নাগরিক কর্তব্যও জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। সব ব্যাপারে সরকার, আইন, সংবিধান দেখিয়ে নাগরিক কর্তব্য পাশ কাটিয়ে চলা যায় না।
ভারতের কথাই ধরা যাক। ২০১৩ সালে এ দেশে খাদ্য সুরক্ষা আইন চালু হয়েছে। তারপর প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত হতে চলল। দেখা যাচ্ছে বিশ্ব ক্ষুদা সূচক বা গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারত ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। এর অর্থ খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার আইন থাকা সত্ত্বেও বহু মানুষ না খেয়ে থাকছে।
যদিও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বহু বছর আগে বলেছে, কোনও রাজ্যে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে সেই রাজ্যের মুখ্য সচিবকে এজন্য জবাবদিহি করতে হবে। এর ফলে যেটা হয়েছে তা হল, প্রশাসনের লোকেরা কিছুতেই অনাহারে মৃত্যু শিকার করে না। ফলে সরকারের নথিতেও অনাহারে মৃত্যু শূন্য দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তব কি তাই?
এখন প্রশ্ন হল, আমরা নাগরিকেরা কি এই অবস্থার পরিবর্তনে কোনও ভূমিকা নিতে পারি? আমি বিশ্বাস করি, হ্যাঁ, পারি। রাষ্ট্রর পাশাপাশি নাগরিকদেরও এই ব্যাপারে বড় ভূমিকা পালন করার দায়িত্ব আছে। কীভাবে?
এই ব্যাপারে অনেকেরই নানা মত থাকা স্বাভাবিক। আমি আমার ভাবনাটি বলি। আমি মনে করি, এর উত্তর আছে আমাদের ধর্মীয় বিধানে। কম বেশি সব ধর্মেই উপবাস পালনের কথা বলা আছে। নিষ্ঠাবান মুসলিম একমাস রোজা পালন করে থাকেন। এটি এমন একটি মহৎ ধর্মীয় বিধান যেখানে নিরন্ন মানুষের ক্ষিদের জ্বালা সেই মানুষও উপলব্ধি করতে পারে যার বিপুল খাবারের আয়োজন আছে। হিন্দুদের পুজোআচ্চাতেও উপবাস পালনের রীতি আছে। কম-বেশি সব ধর্মেই পরিমিত আহারের বিধান রয়েছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানও বহু আগেই সুস্থ থাকার বিধান হিসাবে বিধি মেনে উপবাসের কথা বলেছে। অর্থাৎ শরীর নামক যন্ত্রটিকে নিয়ম করে সপ্তাহে একদিন বা একবেলার জন্য খাওয়াদাওয়া থেকে বিশ্রাম দিলে তা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল।
কিন্তু বাস্তবে আমরা উল্টোটা করে থাকি। বহু অর্থনীতিবিদের মতে কিছু মানুষ তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার খায়। কারণ তাদের সামর্থ্যের জোরে তারা উদ্বৃত্ত, অপ্রয়োজনীয় খাবার কিনতে পারে। যেমন, প্রত্যেক ভারতীয়র দৈনিক গড়ে ৪৮৯ গ্রাম খাদ্যসামগ্রী জরুরি। অসংঘটিত, দিন আনি-দিন খাই শ্রমিক-কৃষকের সেই পরিমাণ খাদ্য কেনার সামর্থ নেই। ফলে তাদের আধপেটা খেয়েই থাকতে হয়।
ভারতের জনসংখ্যা আনুমানিক ১৪০ কোটির কাছাকাছি। এ বছর প্রকাশিত জনশুমারির রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির সামান্য বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, মাথাপিছু দৈনিক চাল খাওয়ার পরিমাণ ৪১৬ গ্রাম। এ হিসাবে বার্ষিক জনপ্রতি চালের ব্যবহার ১৫২ কেজি। কিন্তু পরিমানটি নিয়ে বিতর্ক আছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার ২০১৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী চাল খাওয়ার পরিমাণ মাথাপিছু ৪৬০ গ্রাম। আর একটি হিসাব হল ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি)। তাদের মতে, বাংলাদেশের মানুষ দৈনিক গড়ে ৩৯৬.৬ গ্রাম চাল খায়।
যদিও আমি যে কথাটি বলতে চাই, সেটি বোঝানোর জন্য এত তথ্য পরিসংখ্যানের খুব একটা প্রয়োজন নেই। বিষয়টি আসলে উপলব্ধির। তবু ভারতের একটি হিসাব তুলে ধরে বিষয়টিকে সহজ ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
ভারতের বিপুল জনসংখ্যার প্রায় ৩০ কোটি মানুষ খুব ভাল করে খেয়ে-পরে বাঁচে। যদি তারা প্রত্যেকে সপ্তাহে এক কেজি করে খাবার কম কেনে বা কম খায় তাহলে ১৫ কোটি কেজি বা ১৫ লাখ ক্যুইন্টাল চাল বেঁচে যাবে। এর অর্থ বছরের হিসেবে ৭ কোটি ৮০ লাখ চাল উদ্বৃত্ত হবে। এই বিশাল পরিমাণ উদ্বৃত্ত চাল বাজারের জোগান এবং চাহিদার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করবে এবং দাম সাধ্যের মধ্যে বেঁধে রাখতে সাহায্য করবে।
এটা সম্ভব আমরা যদি সপ্তাহে এক বেলা উপোস থাকি। তাতে লাভ অনেকগুলি। এক. শরীর-স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। দুই. সাশ্রয়ের সংস্কৃতি জনপ্রিয় এবং মজবুত হবে। তিন. এই ধরনের অভ্যাস মানসিক শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আস্তিক, নাস্তিক নির্বিশেষে সকলেই এটা করতে পারি। এটা করা গেলে আমাদের কিছুটা সাশ্রয় অন্যের মুখে খাবার তুলে দিতে সক্ষম হবে।
ছোট বেলায় মা-কাকিমাদের দেখেছি, রান্নার চাল নেওয়ার সময় এক-দু মুঠো চাল আবার হাঁড়িতে তুলে রাখতে। এটা আসলে ছিল মাস শেষে টানাটানির দিনগুলি চালিয়ে নেওয়ার জন্য। সেই ব্যবস্থাটাই আমরা একটু বড় আকারে ভাবতে পারি আমাদের সহ-নাগরিকদের কথা ভেবে। আমরা, যাদের ভরপেট খাওয়ার সুযোগ আছে, তারা সপ্তাহে একদিন একবেলা না খেলে বহু সহ নাগরিকের খাওয়া নিশ্চিত করতে পারি। এই ভাবেই আমরা এক মুঠো সুন্দর ভবিষ্যৎ নিজেদের এবং সহনাগরিকদের জন্য সঞ্চয় করে রাখতে পারি।
লেখক: ভারতীয় সাংবাদিক এবং বাংলাদেশ বিষয়ে স্বাধীন গবেষক।