ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে! : একটি সমসাময়িক পর্যালোচনা

অ্যাড. শেখ নবীরুজ্জামান বাবু

প্রকাশিত : ০৯:৫৭ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০২২ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১০:১১ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০২২ বৃহস্পতিবার

বিস্ময়কর চিহ্ন সাধারণত একটি বিস্মৃত বাক্যের শেষে ব্যবহৃত হয়। এটি প্রশংসা, রাগ এবং অবাকের মত আবেগ প্রকাশ করে। গুরুত্বপূর্ণ তত্তে¡র ওপর জোর দেওয়া এবং সতর্ক অর্থেও এটি ব্যবহার করা হয়। “বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে!” প্রবন্ধের শিরোনামে শেখ ফজলুল হক মণি কেন বিস্ময়কর চিহ্ন ব্যবহার করেছিলেন সেটি কী শুধু তাঁর ভাষাগত দক্ষতা নাকি রাজনৈতিক দূরদর্শিতা তা ব্যাখ্যা করার অবকাশ রাখে। 

১৯৭২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৫টি পর্বে প্রবন্ধটি দৈনিক ‘বাংলার বাণী’তে প্রকাশিত হয়। বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব ও তখনকার সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে লেখা শেখ ফজলুল হক মণি’র “বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে!” শিরোনামের প্রবন্ধটি চার যুগ পরও বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে বার বার আলোচনা-পর্যালোচনা হয়।  

পৃথিবীতে যেদিন থেকে মানুষের উদ্ভব হয়েছে সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে রাজনীতি। তবে তার রূপ হয়তো আধুনিক যুগের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। কিন্তু একথা আমাদের মানতেই হবে- শিল্প, সাহিত্য, ধর্মীয় মতবাদের মতো রাজনীতিও মানুষকে অনুসরণ করেছে প্রাক-ঐতিহাসিক কাল থেকেই। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে অসংখ্য মতবাদ ও তত্তে¡র জন্ম দিয়েছেন প্রথিতযশা দার্শনিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এদের কারো কারো রাজনৈতিক তত্ত্ব এখনো সমাদৃত। কিছু কালের ধূলিতে মলিন হয়ে যাচ্ছে। কিছু নতুন তত্ত্ব ও মতবাদ আবার পুরাতনকে চ্যালেঞ্জ করে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। নতুন-পুরাতনের আবর্তনেই এগিয়ে যায় আমাদের পৃথিবী। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র- “প্রত্যেক ক্রিয়ার একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে”। তেমনি রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে শেখ ফজলুল হক মণি’র “বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে!” তত্ত¡টিও বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে সমভাবে প্রযোজ্য। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে যদি আমরা মানুষের ইতিহাস অনুসন্ধান করি, তাহলে দেখব মানবসমাজ কখনোই রাজনীতি মুক্ত ছিল না। সে সময়ের মানুষের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ আধুনিক দৃষ্টি দিয়ে দেখলে কিছু এলোমেলোই মনে হওয়ার কথা। কিন্তু এ কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সব সমাজই সময়োপযোগী চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েই বিকশিত হয়। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো বিশ শতক। এই শতকের শুরুতে কার্ল মার্কসের তত্তে¡র উপর ভিত্তি করে লেনিন ‘রুশ’ বিপ্লব ঘটান। লেনিনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঢেউ যেয়ে পড়ে কিউবায়। ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে এই বিপ্লব ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন করে দেয়। বঙ্গবন্ধু ২৩ বছর বিপ্লবের স্বাভাবিক পন্থা অবলম্বন করে তথা ধাপে ধাপে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সর্বশেষ ‘হিংসাত্মক বিপ্লবের’ (যুদ্ধ) মাধ্যমে বিশে^র মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের জন্ম দেন। ‘বঙ্গবন্ধুর বিপ্লবকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল, দেশি বিদেশি চক্র ও আমলাতন্ত্র যে কোন সময় প্রতিবিপ্লবী হয়ে উঠতে পারে’- এই আশংকা থেকেই মূলত শেখ ফজলুল হক মণি ‘বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে!’ শিরোনামে প্রবন্ধটি লিখেন।

‘বিপ্লব’ হচ্ছে এমন একটি রূপান্তরের প্রক্রিয়া যা পুরাতন বুনিয়াদকে সমূলে চূর্ণ করে। এটি এমন এক পরিবর্তন যা পুরনো ব্যবস্থার প্রধান সম্পর্কটিকে ভেঙে ফেলে। ১৬৮৮ সালের গৌরবময় ‘বিপ্লব’কে বর্ণনা করতে শব্দটির রাজনৈতিক ব্যবহার দেখা যায়। ‘বিপ্লব’ মূলত অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে বদলে দেয়। মার্কসবাদে ‘বিপ্লব’কে একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য করা হয়। ‘বিপ্লব’ সর্বদাই সমাজবিকাশের ক্ষেত্রে একটা উল্লম্ফন। বিপ্লবের ফলে নতুন রীতিনীতি, নতুন ধ্যান-ধারণা, নতুন সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে উত্তরণ। কার্ল মার্কস বলেন,‘বিপ্লব হলো ইতিহাসের চালিকাশক্তি।’ (ক্লাস স্ট্রাগল্স ইন ফ্রান্স: কার্ল মার্কস) সমাজ প্রগতির জন্য বিপ্লব অপরিহার্য। বস্তুত মার্কসবাদীরা বিপ্লব বলতে রাজনৈতিক বিপ্লবকে অতিক্রম করে বিপ্লবকে সমাজ বিপ্লবের তত্ত¡ হিসেবে দেখেন। মার্কসবাদ আমাদের দেখিয়ে দেয় সমাজ একদিন শুভ্র সুন্দর সকালে আপনা থেকেই উদিত হয় না। এটি দীর্ঘদিনের বৈপ্লবিক কাজের ফলাফল। মার্কসের কাছে ‘বিপ্লব’ হচ্ছে শ্রেণিসংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ। শোষণমূলক সমাজের অভ্যন্তরে যে বৈপরীত্য বা দ্ব›দ্ব থাকে তার ফলেই বিপ্লব সংঘটিত হয়।

লেনিন ‘আত্মগত ও নৈব্যক্তিক’ এই দুটি শর্তকে বিপ্লব সংঘটনের ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক বলে মনে করেন। তিনি বলেন,“আত্মগত অবস্থা হচ্ছে জনগণের বিপ্লবী চেতনা ও সংগ্রামকে শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি ও দৃঢ়তা, বিপ্লবের জন্য সমস্ত শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করার সামর্থ্য এবং একটি দলীয় সংগঠন যা সমাজের অগ্রণী বাহিণী হিসেবে নির্ভুল রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণে সক্ষম হবে। অপরদিকে, নৈর্ব্যক্তিক শর্তের তাৎপর্য হচ্ছে দেশে নানা সমস্যা চরম হবে, শাসক শ্রেণী উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন না করে শোষণ করতে পারবে না, শোষিত শ্রেণির দুঃখ দুর্দশা চরম হবে এবং স্বাধীন আন্দোলনগুলি বৃদ্ধি পাবে।” (টম বটোমর, মার্কসীয় সমাজতত্ত¡, হিমাংশু ঘোষ অনূদিত, কে পি বাগচী এন্ড কোম্পানী, কলকাতা, ১৯৯৩)। বৈপ্লবিক পরিবর্তন কেবল এই জন্যই দরকার নয় যে এ ছাড়া অন্যভাবে শাসক শ্রেণিকে সরানো যাবে না, বিপ্লব প্রয়োজন বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা লাভের জন্যও। মার্কস এঙ্গেলস লিখেছেন,“ কমিউনিস্ট চেতনার ব্যাপক উত্থান ও নিজের উদ্দেশ্যের সাফল্য - এই উভয়ের জন্য মানুষের মধ্যে গণপরিবর্তন অপরিহার্য, পরিবর্তন একমাত্র ঘটবে কার্যকর আন্দোলনে, বিপ্লবে...।” (মার্কস এঙ্গেলস, জার্মান ভাবাদর্শ, ১৮৪৫, গৌতম দাস অনূদিত, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ফেব্রæয়ারি ২০০৯, পৃ: ১৫১)। সুতরাং সমাজের মৌলিক রূপান্তরের উদ্দেশ্য নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংগ্রাম হল ‘বিপ্লব’। যেমন ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব, ১৯৪৯ সালের চীনের বিপ্লব, ১৯৫৯ সালের কিউবা বিপ্লব, ১৯৭১ সালের ‘বাংলাদেশ’ এর বিপ্লব।
 
বস্তুত গণতন্ত্র ও বৈপ্লবিক পদ্ধতির মধ্যে কোন বিরোধ নেই। বরং উভয়ের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বর্তমান। বস্তুত বিপ্লব থেকে এই গণতন্ত্রের ধারণাটির উদ্ভব হয়েছে। আপ্থেকার বলেছেন: “গণতন্ত্র বলতে যদি জনসাধারণের ব্যাপক ভূমিকাকে বোঝায় তাহলে বিপ্লবের মধ্যে এই গণতন্ত্রের নির্যাস নিহিত আছে। বৈপ্লধিক প্রক্রিয়া এবং তার পরিণতি গণতন্ত্র বিরোধী তো নয়ই বরং গণতন্ত্রের মৌলিক আদর্শের পরিপোষক। বিপ্লবের প্রকৃতি যত মৌলিক হবে, গণতন্ত্রও তত গভীর ও ব্যাপক হবে। সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের ধারণাও প্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হবে।” আপ্থেকার আরো বলেছেন: “মৌলিক বিপ্লব সংখ্যাগুরু সাধারণ মানুষের নিবিড়তম সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের ফলে বিস্তৃত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কারণে বিপ্লব হল স্বদেশজাত এবং সম্পূর্ণরূপে গণতন্ত্রসম্মত।” আপ্থেকারের মতানুসারে, অতীতের সকল ঐতিহাসিক বিকাশের মধ্যে বৈপ্লবিক প্রক্রিয়াই হল সর্বাধিক গণতন্ত্রসম্মত।

বাঙালির মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে যে স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলেন, আলোচ্য প্রবন্ধে শেখ মণি তাকেই বলেছেন ‘বিপ্লব’। ‘বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে!’ প্রবন্ধের প্রারম্ভেই তিনি বলেছেন,“স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমরা বিপ্লব ও যুদ্ধ উভয় প্রক্রিয়া এবং অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছি।” ১৯৪৭ অনিবার্য ছিলো কিনা আজকে আলোচনা অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক না; তার চাইতেও বেশী প্রাসঙ্গিক হলো ১৯৪৭ সালে বৃটিশ বিদায়ের পর এই বাংলায় যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলো তাদের শ্রেণি চরিত্র এবং দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে তাদের ভাবনা। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করলেই খুব সহজেই বোঝা যায়-পরিবর্তন ছিলো অনিবার্য। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু’র ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ কিংবা অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ইতিহাসের আলোকে দেখলে খুব স্বাভাবিক মনে হয় যে পরিবর্তন আসবেই। ততকালীন পুর্ববাংলার মধ্যবিত্ত মানস ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে নিজেকে প্রস্তুত করছিলো সমাজ পরিবর্তনের দিকে। এই পরিবর্তন মুক্তিকামী মানুষের মুক্তিসংগ্রামে পরিণত করেছিলেন একজন স্বপ্নবান মানুষ-বাঙ্গালীর ইতিহাসের ‘রাখাল রাজা’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। ধাপে ধাপে গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে চুড়ান্ত বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছিলো শুধু তাঁর সুদুরপ্রসারী নেতৃত্ব-ভাবনা এবং মেধা-প্রজ্ঞার কারণে। বঙ্গবন্ধু চরিত্রের এক অদ্ভুত সুন্দর দিক হলো-তিনি লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। আর তাঁর সেই লক্ষ্য ছিলো বাঙ্গালী জাতির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক মুক্তি।

২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের পর বাঙ্গালী আবার পরাধীণতার জোয়াল কাঁধে নিতে রাজি ছিলোনা। পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া পুর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা আবার পাকিস্তানের উপনিবেশ হবার জন্য নিজেরা প্রস্তুত ছিলোনা। প্রস্তুত ছিলো না বলেই ১৯৪৭ পরবর্তী বাঙ্গালীদের সংগ্রাম ছিলো প্রধানতঃ নিজেদের রাজনৈতিক দল গঠন এবং আবহমন বাঙ্গালীর ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা জাগিয়ে তোলা। আসলে খুব বেশি সময় নষ্ট হয়েছে বলা যাবেনা। ১৯৪৮ সালেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্যে পথচলা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সফলতার কারণেই খুব দ্রুত বাঙ্গালীরা নিজেদের সংগঠিত করতে পারে এবং তার আগে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ-কৃষক প্রজা পার্টি-গণতন্ত্রী দল খুব দ্রæত জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলো। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক আপোষহীন মহাসংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং যার ধারাবাহিকতায় ‘৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ‘৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৬ এর ছয় দফা, ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং সবশেষে নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয়ী বাঙ্গালী জাতি রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ। এখানেই একটা বিষয় খুব পরিস্কার যে তৎকালীন সত্তর দশকে পৃথিবীর দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদ বিরোধী অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক যে মুক্তি সংগ্রাম চলছিলো-তা ল্যাটিন কিংবা ভিয়েতনামে ছিলো অনেক বেশী ঋজু এবং সশস্ত্র আর বাংলাদেশে তা ছিলো ধাপে ধাপে। কখনো গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, কখনো নির্বাচন কখনো আলোচনা চুড়ান্ত পর্বে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম । কিন্তু আজকে পিছন দিকে তাকালে একবারো মনে হয়না আমাদের মুক্তিসংগ্রাম একবারের জন্য হলেও দিক্ভ্রান্ত হয়েছে। এখানেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সৌন্দর্য।

বঙ্গবন্ধু বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ধীরে ধীরে জাতিকে প্রস্তুত করেছেন, আর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশের সব মানুষকে জানিয়ে করা যায় না, এর জন্য অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়। তখন পাকিস্তান একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। তার একটি অংশকে আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা অবশ্যই গোপনীয়তার সঙ্গে না করলে, বিপ্লবী না হলে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলা ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা খোলা থাকে না এবং এত গোপনীয়তার পরও বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াতে হয়েছে। পূর্ব প্রস্তুতি না থাকলে ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হতো না, বঙ্গবন্ধুও মুক্তি পেতেন না, ‘৭০-এর নির্বাচনও হতো না, তার রায় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধেও যাওয়া সম্ভব হতো না। যুদ্ধ শুরু হলে কোটি মানুষ বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া গেল আর তারা জায়গা দিয়ে দিল! আগে থেকে কোনো যোগাযোগ ছাড়া সব হয়ে গেল! পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন হয়ে গেল আবার সেই সরকার বৈদ্যনাথ তলা বর্তমান মুজিব নগরে শপথ নিল! মুজিব নগর সরকার গঠিত না হলে সারা বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়ে দিত? বাংলাদেশ সৃষ্টি কোনো ব্যক্তির বাঁশি বাজানোর ফলে হয়ে যায়নি। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ।

যে ক্ষেত্রে শাসক বা শোষক শ্রেণি বিপ্লবী সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে শাসন কর্তৃত্ব নিজেদের দখলে রেখে বিপ্লবী শক্তিকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয় তাকে প্রতিবিপ্লব (Counter Revolution) বলে। মার্কসবাদে বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। বিপ্লব হঠাৎ করে হয় না। এর পিছনে অনেক সময়ের যৌক্তিক ইতিহাস থাকে। প্রতিবিপ্লব হঠাৎ করেই হয়। যেমন-সামরিক বাহিনী কর্তৃক চিলির বামপন্থী রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দের সরকারকে উচ্ছেদ, ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মোশতাক গংদের ক্ষমতা দখল। 

মার্কসীয় মতে প্রতিবিপ্লব গণতন্ত্রের বিরোধী। আপ্থেকার বলেছেন: “প্রতি-বিপ্লবই হল গণতন্ত্রের বিরোধী এবং সেইজন্য তা ষড়যন্ত্রমূলক। প্রতিবিপ্লব জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বার্থের পরিপন্থী।” (দ্য ন্যাচার অব ডেমোক্রেসি ফ্রিডম এন্ড রেভুলেশন: হারবার্ট অপ্থাকার)। প্রতিবিপ্লব হিংসা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতির ভিত্তিতে পরিচালিত হয় এবং সংখ্যাগুরু মানুষের প্রতি অবজ্ঞা পোষণ করে। এই প্রতিবিপ্লব শোষক প্রকৃতির।

শেখ ফজলুল হক মণি’র আলোচিত প্রবন্ধের প্রাসঙ্গিকতাও এখানে। বাংলাদেশেও একই ঘটনা ঘটেছে। বিপ্লবীরা অসতর্ক ও অনভিজ্ঞ হওয়ায় প্রতিবিপ্লবীরা এখানে বিজয়ী হয়েছে এবং অত্যন্ত অল্প সময়ে। জাতির জনক সাধারণ ক্ষমায় কোনো যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করেননি, ৭০ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মামলা বিচারাধীন ছিল। ১১ হাজার মামলার রায় হয়েছিল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আরেকটি পলাশী মঞ্চস্থ করে মোশতাককে ক্ষমতায় আনা হলো, অল্প সময়ের মধ্যে মঞ্চে এলেন লর্ড ক্লাইভ রূপি জিয়া। জিয়া সামরিক ফরমান বলে দালাল আইন ‘৭৩ রহিত করে যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে তাদের বিচারের রাস্তা বন্ধ করে তাদের নিয়ে দল গঠন করে দেশে হীনমন্যতার রাজনীতি শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি জিয়াউর রহমানকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করে। বাংলাদেশকে বোমাবাজি, সন্ত্রাসের রাজত্ব বানিয়ে ছাড়ে। অপপ্রচার চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র অব্যাহতভাবে চালিয়ে আসছে। জেনারেল জিয়া ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি দুর্বিষহ করে দিয়েছেন। রাজনীতিকে কেনাবেচা আর ব্যবসায় পরিণত করেছেন। দৃশ্যত এইগুলো সবই প্রতিবিপ্লবী কর্মকাÐ। বিপ্লবের উদ্দেশ্য থাকে একটি জাতির ভাগ্যোন্নয়ন। প্রতিবিপ্লবের লক্ষ্য সেই জাতিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। বিপ্লবে জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে। প্রতিবিপ্লবে স্বার্থানেষী মহলের ধ্বংসাত্মক কর্মকাÐ থাকে।

‘৭৫ এর ১৫ আগস্টে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রতিবিপ্লব ঘটে। আর কেন সেটি প্রতিবিপ্লব- তার যথার্থ মূল্যায়ন প্রয়োজন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে ঘটনাটি ঘটেছিলো, যে হত্যাকাÐটি হয়েছিলো, সেটি কোনো মতেই কোনো ব্যক্তিকে বা কোনো রাষ্ট্রপতিকে হত্যা নয়। এটি সম্পূর্ণ রূপে ছিলো একটি প্রতিবিপ্লব। কারণ যে ঘটনার মধ্য দিয়ে একটি জাতির সংবিধান বদলে যায়, ঐ ঘটনাকে কখনোই একটি হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। প্রতিবিপ্লবীরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশের সংবিধানে যে পরিবর্তনগুলো এনেছিলো, যার ভেতর দিয়ে তারা প্রতিবিপ্লবটিকে একেবারে সাংবিধানিকভাবে বাস্তবায়িত করেছিলো। একটি দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনাই হচ্ছে সংবিধানের মূল সুর এবং তার মূল বিষয়। আমাদের এই প্রস্তাবনায় বলা ছিলো, “মার্চ মাসের ২৬ তারিখে জাতীয় মুক্তির জন্য 'ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে'।” কিন্তু আমরা যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছি, '৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঐ জায়গাটা পরিবর্তন করে বলা হয় ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে। এই ‘সংগ্রাম’ কথাটি বাদ দিয়ে ‘যুদ্ধ’ কথাটি কেন আনা হলো। কেননা শুধু নয় মাসের যুদ্ধটাকে রাখার জন্য। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি যে ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছিলো তা বাদ দেয়ার জন্য। এর মধ্য দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনকেই শুধু অস্বীকার করা হয়নি, অস্বীকার করা হয়েছে '৫২র ভাষা আন্দোলনকে এবং শহীদেরকে। অস্বীকার করা হয়েছে '৬৬র ৬ দফা। এ অস্বীকারের কারণ বাঙালি, বাংলা ভাষা, জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে শেষ করে দেয়ার জন্য।

১৯৭১ সালের আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো আসলেই এক সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে বিপ্লব আর বাকশাল ছিলো আমাদের দ্বিতীয় বিপ্লব আর আমাদের এই দুই বিপ্লব ঠেকানোর জন্য ১৫ ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালে সংঘটিত ধর্মাশ্রয়ী-সাম্রাজ্যবাদী-পেট্রোডলারের মালিকদের যৌথ অক্ষচক্রের মাধ্যমে সংগঠিত এক ভয়াবহ প্রতিবিপ্লব। 

শেখ মণি প্রতিবিপ্লবী বলতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীচক্র, জামায়াতে ইসলাম ও মুসলিম লীগের সমর্থক, পাকিস্তানী মতাদর্শে বিশ্বাসী আমলা এবং পাকিস্তান-আমেরিকা ও চীনের এজেন্টদের বুঝিয়েছেন। তৎকালীন সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তিনি প্রতিবিপ্লবীদের ষড়ষন্ত্রের তত্ত¡ বিশ্লেষণ করেছেন। এশীয় কূটনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের স্বার্থে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিপতিদের সাথে চীনের সংযোগ ও মদ্দে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতিবিপ্লবী সৃষ্টি করে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। চীন-মার্কিন-পাকিস্তান সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নসাৎ করার অভিপ্রায়ে প্রতিবিপ্লবী শক্তিসমূহকে কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে কিংবা উৎখাত করে বিকল্প সরকার গঠন করে তাদের তাঁবেদারী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।

শেখ ফজলুল হক মণি ‘বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে!’ প্রবন্ধটির প্রথম আর্টিকেলটি লিখেন ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২। আর্টিকেলের শুরুতে তিনি বিপ্লব ও যুদ্ধের পরে কী হয় তা নিয়ে চিরন্তন বাণী উচ্চারণ করেছেন। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৩ বছর আন্দোলন সংগ্রাম তথা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পরিশেষে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, তাই তিনি বলেছেন।    

“বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব, যুদ্ধের পরে দারিদ্র। এবং পরিবর্তনের প্রয়াস। দুটো স্বাভাবিকভাবেই দেখা দিতে পারে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমরা বিপ্লব ও যুদ্ধ উভয় প্রক্রিয়া এবং অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছি।” (বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবে!- দূরবীণে দূরদর্শী, পৃ: ৮৯, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)

এই আর্টিকেলের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ প্যারায় তদানীন্তন রাশিয়ার ক্ষমতার পালাবদলের প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন শেখ মণি। ইতিহাস বলে, “১৯১৭ সালে রাশিয়ায় যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা ক্ষমতায় আসে তা ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি। এ বিপ্লব ঘটেছিল কয়েকটি পর্বে। সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসে একের পর এক গণবিক্ষোভের পর ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন রাশিয়ার জার নিকোলাস। জার সেসময় ছিলেন পুরানো, অচল এবং স্বৈরতান্ত্রিক এক শাসকচক্রের প্রতিনিধি। তার পতনের পর রুশ উদারপন্থী এবং সমাজতন্ত্রী দলগুলো মিলে সরকার গঠন করেছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল রাশিয়াকে একটি আধুনিক পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পথে নিয়ে যাওয়া। তাদের কথায়, তাদের নীতির মূল আদর্শ ছিল ফরাসী বিপ্লব। সে সময় পশ্চিমা বিশ্বে রাশিয়ার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতীক ছিলেন একজন তরুণ সমাজতন্ত্রী - যার নাম আলেক্সান্ডার ক্রেনেস্কি। অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে জনপ্রিয় মন্ত্রী ছিলেন তিনি। তার উচ্চাভিলাষ ছিল রাশিয়াকে বিশ্বের সবচাইতে বড় প্রগতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা, রাশিয়ায় গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করা। বহু আইন পাস করেছিলেন ক্রেনেস্কি। এর মধ্যে ছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, পুরোনো বংশগত পদবী বিলুপ্ত করা, নারীদের সমানাধিকার - এ রকম আরো অনেক আইন।

মনে করা হয়, ক্রেনেস্কি ছাড়া কেউই এত আইন পাস করাতে পারতেন না। ক্রেনেস্কি ছিলেন একজন দুর্দান্ত বক্তা - যিনি রাজনৈতিক তত্ত¡কে প্রায় আধ্যাত্মিক ভাষায় প্রকাশ করতে পারতেন। কিন্তু জনপ্রিয়তার স্রোতে ভাসতে থাকা ক্রেনেস্কি হয়তো বিপদ আন্দাজ করতে ভুল করেছিলেন। ১৯১৭ সালের ৩রা এপ্রিল আরেকজন সম্মোহনীক্ষমতা সম্পন্ন নেতা ১০ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে সেন্ট পিটার্সবার্গ বা পেত্রোগ্রাদে এলেন। তার নাম ভ্লাদিমির লেনিন। শুরু থেকেই লেনিন অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাত করার ডাক দিতে থাকলেন। কারণ তার ভাষায় ঐ সরকার ছিল একটি বুর্জোয়া পুঁজিবাদী সরকার। বাস্তবিক লেনিন তার পুরো জীবনে কখনোই উদারনৈতিক কোন সরকারকে ভালো চোখে দেখেন নি। অনেক বছর পর বিবিসিতে ইতিহাসবিদ এলেনা শাপিরোকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ক্রেনেস্কি স্বীকার করেছিলেন যে, ‘তিনি লেনিন এবং বলশেভিকদের উপযুক্ত গুরুত্ব দিতে ভুল করেছিলেন।’ ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে ক্রেনেস্কি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হলেন। তার থাকার জায়গা হলো উইন্টার প্যালেস বা শীত প্রাসাদে - যা ছিল জারের সাবেক বাসভবন। অনেকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেন যে ক্রেনেস্কি নেপোলিওনের মতোই উচ্চাভিলাষী। অরল্যান্ডো ফাইজেসের কথায়, ‘১৯১৭ সালের আগস্ট মাস নাগাদ ক্রেনেস্কি একটা বিভ্রমের মধ্যে ছিলেন।’ সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা তখন ভেঙে পড়েছে। ক্রেনেস্কি যাকে সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন-চিফ হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছিলেন - সেই কর্নিলভ তখন ক্রেনেস্কিকে রেখে হোক বা বাদ দিয়ে হোক - এক ধরণের সামরিক একনায়কতন্ত্র কায়েম করার চেষ্টা করছিলেন। ক্রেনেস্কির ওপর তখন আরো কারোরই আস্থা ছিল না। অক্টোবরের শুরুর দিকে ক্রেনেস্কির কর্তৃত্ব ভেঙে পড়লো। অন্যদিকে, লেনিনের চাপে বিপ্লবী বলশেভিকরা একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য এক গোপন প্রস্তাব পাস করলো। লেনিন জোর দিয়ে বললেন, ‘যা করার দ্রæত করতে হবে।’ তিনি ঠিক করলেন রাশিয়ার পুরোনো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অক্টোবরের ২৫ তারিখ অভ্যুত্থান হবে। যা ইউরোপিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৭ই নভেম্বর। পেত্রোগ্রাদে মোতায়েন সামরিক বাহিনীর লোকদের মধ্যে যে বলশেভিক সমর্থকরা ছিল - তাদের দিয়ে রাজধানীতে সশস্ত্র পাহারা বসানো হলো। এর পর বলশেভিকরা শীত প্রাসাদ আক্রমণ করলো, ক্রেনেস্কির অবশিষ্ট কয়েকজন মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হলো। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা সোভিয়েত শাসনকে একদলীয় একনায়কতন্ত্রে পরিণত করলো। ক্রেনেস্কি মনে করতেন, ‘বলশেভিক শাসন বেশি দিন টিকবে না।’ তাই অভ্যুত্থানের পর তিনি গ্রামে চলে গেলেন এবং সৈন্য সংগ্রহ করে লেনিনের অনুগত বিদ্রোহীদের আক্রমণের চেষ্টা করলেন। যখন সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো, ক্রেনেস্কি রাশিয়া ছেড়ে পালালেন। বাকি জীবন নির্বাসনেই কাটাতে হয় ক্রেনেস্কিকে। তিনি মারা যান নিউইয়র্কে ১৯৭০ সালে।” (বিবিসি অনলাইন)। 

এই আর্টিকেলে শেখ ফজলুল হক মণি রাশিয়ার ক্রেনেস্কি আর লেনিনের উদাহরণ টেনে লিখেছেন, “জারের রাজাকে সরিয়ে ক্রেনেল্কি ক্ষমতায় বসেছিল। লেনিন ক্রেনেস্কিকে তাড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতা কেড়ে নিলেন রাশিয়ার। লেনিন সফল হয়েছিলেন। তাই এটাকে প্রতিবিপ্লব না বলে ইতিহাস চিহ্নিত করেছে অগ্রবর্তী বিপ্লব বলে।” (বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবে!- দূরবীণে দূরদর্শী, পৃ: ৮৯, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)

লেনিন যেহেতু দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তথা বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা নিয়েছিলেন, এ কারণে শেখ মণি একে প্রতিবিপ্লব না বলে অগ্রবর্তী বিপ্লব বলেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে নতুন মতবাদ বলা যায়। সাফল্যের নিরিখে রাষ্ট্রনায়কদের জীবনের তুলনামূলক কৃতিত্বের হিসাব নিকাশ সম্পর্কে শেখ মণি বলেন,“ইতিহাস সমকালীন জনপ্রিয়তার নিরিখে মানুষকে বিচার করে না। বিচার করে না তাৎক্ষণিক আইনের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে। সাফলের নিরিখে রাষ্ট্রনায়কদের জীবনের তুলনামূলক কৃতিত্বের হিসাব নিকাশ গ্রহণ করা হয়।”(বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে!, পৃ: ৮৯)। রুশ বিপ্লবের প্রেক্ষাপট ও শেখ মণি’র লেখা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ক্রেনেস্কির জনপ্রিয়তা লেনিনের চেয়ে বেশি হওয়া সত্তে¡ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে তার পতন ত্বনান্বিত হয়েছিল। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে প্রশাসন যন্ত্র নিজের মত সাজানোর বিকল্প নেই। শেখ মণি তার অসংখ্য লেখায় প্রশাসন যন্ত্র নিয়ে কথা বলেছিলেন। পাকিস্তান আমলের সেনাবাহিনী ও আমলা দিয়ে যে মুজিবের শাসন চলতে পারে না। তাও তিনি বহুবার বলেছেন। এক্ষেত্রে ‘৭৫ এর প্রতিবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে প্রশাসন যন্ত্রের ব্যর্থতা স্বাতন্ত্রিক গবেষণার দাবী রাখে।

এই আর্টিকেলের ৫ম ও ৬ষ্ঠ প্যারায় শেখ ফজলুল হক মণি ইন্দোনেশিয়ার জাতির জনক সুকর্নোর প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। “ইতিহাসের পাতায় নায়ক খলনায়কে পরিণত হলেন। সুকর্ন ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের উত্থানকালের প্রধান সারির নেতা। তবে নিজ দেশে তার শাসনামলে তিনি পরিচিত ছিলেন অন্য এক পরিচয়ে, স্বৈরাচারী একনায়ক। এই একনায়ক দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে ছিলেন। মর্জিমতো দেশ শাসন করেছেন, সেনাবাহিনীর উপর ভর করে জনমতের তোয়াক্কা না করে নিজেকে ঘৃণিত করেছেন। তিনি যৌবনে হল্যান্ডের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছেন। এ জন্যে সুকর্নকে কারাগারে ও নির্বাসনে থাকতে হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ইন্দোনেশিয়া দখল করে। কিন্তু ১৯৪৫ সালে জাপান পরাজিত হবার পর ইন্দোনেশিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করে। এ সময় স্বাধীনতাকামীরা জাপানীদের রেখে যাওয়া অস্ত্র ব্যবহার করে এবং সুকর্নর নেতৃত্বে তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। স্বাধীনতাকামীরা চার বছর লড়াই করে হল্যান্ডের সেনাদের ইন্দোনেশিয়া থেকে বিতাড়িত করে। সুকর্ন ১৯৪৯ সালে দেশের প্রেসিডেন্ট হন। তিনি ইন্দোনেশিয়ায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক সংস্কার সাধন করেন। পশ্চিমা শক্তিগুলো সুকর্নর স্বাধীনচেতা মনোভাবকে পছন্দ না করায় ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীকে তার বিরুদ্ধে উস্কে দেয়। ১৯৬৫ সালে জেনারেল সুহার্তো এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সুকর্ন’র কাছ থেকে সকল ক্ষমতা কেড়ে নেন। দুবছর পর সুকর্ন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অসুস্থ সুকর্নের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেনি সুহার্তোর সামরিক সরকার। ফলে দ্রæত স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে সুকর্নের। ১৯৭০ সালের ২১ জুন জাকার্তার সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন সুকর্ন। পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে তার কিডনি বিকল হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার নায়ক, যাকে কি না সর্ব সাধারণ জাতির পিতার আসনে বসিয়েছিল, যিনি সকল ক্ষমতা কেন্দ্রে বসে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সেই সুকর্নই শেষকালে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। জীবনের শেষ অধ্যায়ে গিয়ে মানুষের মনে খলনায়কের আসন পেয়েছেন, অথচ তিনি ইন্দোনেশিয়ানদের মহানায়ক হয়েই ইতিহাসে অমর হতে পারতেন!” (সূত্রঃ নিউজজি২৪)

সুকর্ন প্রসঙ্গে শেখ মণি বলেন, “পক্ষান্তরে ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণো ক্ষমতায় এসেছিলেন বিপ্লবের পথ ধরে, যুদ্ধের পরে। তার দেশে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। সুকর্ণো কেবল নব্য ইন্দোনেশিয়ার জন্মদাতাই নন, তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের ইন্দোনেশীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে সব চাইতে উজ্জলতম নক্ষত্র, সব চাইতে চাকচিক্যময় মহাপুরুষ। ... হতবাক বিশ্ব, বিষ্ময়, বিমূঢ় ইন্দোনেশিয় জনগণ, অবাক বিষ্ময়ে দেখলো, সুকর্ণো আর তার দেশের কর্ণধার নন। যা কেউ কল্পনায়ও আনেনি, বা কেউ ভাবতে পারেনি, বাস্তবে তাই ঘটে গেল।” (বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবে!- দূরবীণে দূরদর্শী, পৃ: ৮৯, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)

ইতিহাসের পাতা থেকে সুকর্ন হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ শেখ ফজলুল হক মণি বলেছেন। যে কোন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন সবদিক দিয়ে মনোযোগী হওয়া। সুকর্ন সেটা না করে শুধু সোবাহিনীর উপর নির্ভর করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার দিকে মনোযোগ দেন। বিপ্লবের পর ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টরা যখন তাকে উৎখাতের চেষ্টা করে, তাদের হারিয়ে দিলেও তাদের সমূলে উৎপাটন করেননি। ফলস্বরূপ প্রতিবিপ্লবীরা ষড়যন্ত্রের সুযোগ পেয়ে যায়। সুকর্ন কোনকিছু আমলে না এনে প্রতিবিপ্লবীদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। নিজের প্রশাসনে ঢুকিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং তাদের ক্ষমতার কাছাকাছি রেখেছিলেন। সুকর্ন নিজের শেকড় তথা নিজের দলকে অকেজো করে সর্বদলীয় মোর্চা করেছিলেন, আর সেখানে শত্রু ও প্রতিবিপ্লবীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ট। যাদের সমূলে ধ্বংস করা উচিৎ ছিল, যাদের জেলখানায় পাঠানো উচিৎ ছিল- তা না করে তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রে বসিয়ে প্রতিপালন করেছিলেন। সবার মুখ রক্ষা করতে গিয়ে তিনি একা হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে ১৯৬৫ সালে যখন প্রথম আঘাত আসলো তথা প্রতিবিপ্লব ঘটল, তখন তাকে রক্ষা করার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। বরং একযোগে সবাই তার বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। মাঝখান দিয়ে নিরীহ ১৯ লাখ ইন্দোনেশিয়ার প্রাণ চলে গেল। বাংলাদেশের তখনকার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দুরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা শেখ মণি’র এই বিশ্লেষণটি স্বাতন্ত্রিক গবেষণার দাবী রাখে। 

বিশ্বের তাবৎ বিপ্লবীর নেতারা কিভাবে সেই প্রতিবিপ্লবকে মোকাবেলা করেছে আর যারা করতে পারেনি তাদের পরিনাম কি হয়েছে। এখান থেকে বঙ্গবন্ধু সরকার কিভাবে শিক্ষা নিতে পারে। এই প্রসঙ্গে শেখ ফজলুল হক মণি বলেন, “সুকর্ণো কোনদিন নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে মনোযোগ দেননি।...সুকর্ণো এই প্রবণতাকে লক্ষ্যে না এনে, আমল না দিয়ে কালনাগিনীর বংশোদ্ভূত প্রতিবিপ্লবীদের পুনবার্সন করেছিলেন রাজনীতির নাট্যমঞ্চে, টেনে এনেছিলেন প্রশাসন যন্ত্রের জঠরে, বসিয়েছিলেন নিজের দক্ষিণহস্ত বামহস্ত করে। যে মূল সংগঠনের জোরে তিনি নিজেকে করেছিলেন প্রতিষ্ঠিত সেই মৌল শক্তি জাতীয়তাবাদী দলটিকে সম্পূর্ণ অকেজো করে দিয়ে, শত্রুদের নিয়ে গঠন করেছিলেন সর্বদলীয় মোর্চা, যে মোর্চার বৃহৎ অংশ দখল করে নিয়েছিল প্রতিবিপ্লবী শত্রুরা। যাদেরকে পাঠানো উচিত ছিলো কয়েদখানায়, যাদের রক্তবীজের নব জাতকদের মারা উচিত ছিলো নবজাতকদের জন্ম লগ্নে মারা উচিত ছিল গলা টিপে, তাদেরকেই প্রতিপালন করেছিলেন তিনি।” (বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবে!- দূরবীণে দূরদর্শী, পৃ: ৯০, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)

স্বাধীনতা পরবর্তী ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ ভাবনায় শেখ মণি যে কাতর হয়েছিলেন, তার স্বরূপ দেখতে পাই আর্টিকেলের শেষ প্যারায়। নিজের আতঙ্কের কথা তিনি জনসমক্ষে প্রকাশ করলেন। আর তাঁর আতঙ্কের কারণও ব্যাখ্যা করলেন। ১৯৭২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর শেখ ফজলুল হক মণি এই আর্টিকেল যখন লেখেন তখন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটার সম্ভাবনা ছিলো না। এমনটা যাতে না ঘটতে পারে তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন শেখ মণি কিন্তু ইতিহাস বড় নির্মম তিনি রক্ষা করতে পারেননি। তিনি যেহেতু ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন তাই ছিলেন সর্বদা সর্তক। তাই তো আহ্বান করেছিলেন সংবাদপত্রসেবী কর্মীদের। শেখ ফজলুল হক মণি লিখেছেন, “বাংলাদেশের ব্যাপারে এ রূপ ঘটবে এমন কথা বলি না। বঙ্গবন্ধু এমন লোক নন যে, তার আওয়ামী লীগকে বাতিল করে দিয়ে সুকর্ণোর মতো সার্বজনীন ফুটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকবেন আর প্রতিবিপ্লবীদের উপর ভরসা করে রাষ্ট্র চালাবেন। তবুও বিষয়টি নিয়ে আলাচেনা করছি এই কারণে যে, বাংলাদেশ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ারই একটি রাষ্ট্র। মানুষ এখানে দরিদ্র, মধ্যবিত্তের উচ্চভিলাস এখানে অপরিমিত, স্বাধীনতার শত্রæরা এখানে তৎপর, পুরাতন আমলারা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রে পুনর্বাসিত। সুতরাং সময় থাকতে রোগ না ধরা গেলে দাওয়াইটিও কেউ খুঁজবে না। এবং সংবাদপত্রসেবী হিসেবে সে দায়িত্ব আমাদেরই"। (বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবে!- দূরবীণে দূরদর্শী, পৃ: ৯০, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)

‘বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে!’ প্রবন্ধের ১ম আটিকেলের শেষে ব্যাখ্যা করেছেন, কেন তিনি ক্রেনেস্কি, লেনিন ও সুকর্নর প্রসঙ্গ ও তাদের উত্থান পতনের প্রসঙ্গ বলেছেন। বঙ্গবন্ধু প্রতিবিপ্লবীদের উপর ভরসা করে যে রাষ্ট্র চালাবেন না, সেই বিশ্বাস তার উপর ছিল শেখ মণি’র। তারপরেও তিনি প্রাসঙ্গিক কারণে কলাম লিখেছিলেন। বাংলাদেশ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্র হওয়ার কারণে দেশি বিদেশি শত্রুরা ছিল ভিতরে ভিতরে। এখানকার মানুষ দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত হওয়ার কারণে তাদের চাহিদা সীমাহীন ছিল। প্রতিবিপ্লবীরা এদেরকে তাদের দলভুক্ত করতে পারে। তাছাড়া ক্রেনেস্কি ও সুকর্নর মত বাংলাদেশেও পুরাতন এবং সুবিধাবাদী আমলারাই প্রশাসন যন্ত্রে ছিল। এসব নানাবিধ কারণে শেখ মণি’র মনে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বাহন সংবাদপত্র, আর সেই সংবাদপত্রসেবীদের এই সকল বিষয়ে সতর্ক হওয়ার উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন তিনি। যদি উপযুক্ত সময়ে এই বিষয় সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন না করা হয়, তার পরিণাম যে ভাল হবে না, তাও শেখ মণি উল্লেখ করেছেন।

আলোচ্য প্রবন্ধের ২য় আর্টিকেলটি প্রকাশিত হয় ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭২। শেখ ফজলুল হক মণি এই আর্টিকেলের প্রথম প্যারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে জাতিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, সেই কথাটির পুনরাবৃত্তি করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “স্বাধীনতা অর্জন করা যেমনি কঠিন কাজ স্বাধীনতা রক্ষা করা সেরকমই কঠিন।” (বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে!, ২য় আর্টিকেল, ১ম প্যারা, পৃ: ৯১)। দেশের প্রতিবিপ্লবীদের তৎপরতা সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া যাতে সাধারণ জনগণ পূর্বেই সম্ভাব্য শত্রু সম্পর্কে একটি ধারণা নিতে পারে। নৈতিক দায়িত্বের নিরিখে দেশের মুখ্য কর্ণধার হিসেবে এটা বঙ্গবন্ধুর নৈতিক দায়িত্ব, সতর্ক করার পেছনে যুক্তি হিসেবে শেখ মণি একথা বলেন। পরবর্তীতে প্রতিবিপ্লবীদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আরো স্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,“বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রæরা দেশের ভেতরে ও বাইরে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে।” বঙ্গবন্ধুর এই দুটি উক্তির মধ্য দিয়ে বোঝা যায়- প্রতিবিপ্লবীদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ওয়াকিবহাল ছিলেন। ঐ সময় বাংলাদেশ ইস্যুতে চীন ভেটো প্রদান করেছিল, তা থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাত করতে চায়। সাথে সাথে পাকিস্তানের সকল ষড়যন্ত্রের পেছনে চীন মদদ দেবে। শেখ মণি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে চীনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। 

কী ছিল চীনের ভূমিকা- “মুক্তিযুদ্ধে চীনের সরকারি অবস্থান ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চীন বাঙালির সংগ্রাম ও নির্যাতনের প্রতিও কোনো সহানুভূতি দেখায়নি। বরং পাক সামরিক চক্রের প্রতি জানিয়েছিল আকুণ্ঠ সমর্থন। গোপনে পাকিস্তানের সামরিক চক্রকে নৈতিক শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিল এবং সরাসরি সামরিক উপকরণ সরবরাহ করেছিল। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত-সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরের পর চীনের পাকিস্তানপন্থী নীতি আরো প্রকট হয়ে ওঠে। সেপ্টেম্বর মাসে চীন পাকিস্তানকে এই বলে আশ্বস্ত করে যে, জাতীয় স্বার্থরক্ষায় চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করবে। বাঙালি বিরোধি বক্তব্য না রাখলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত দিয়ে চীন নিয়মিতভাবে পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র পাঠাতো। এছাড়াও গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণ দানের জন্য চীন অক্টোবর মাসে সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর হতে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান মোট ২০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের চীনা সামরিক উপকরণ সাহায্য হিসেবে পেয়েছে যার মধ্যে ১৯৭১ সালেই সরবরাহ করেছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র। আর চীনের রাইফেল ও অন্যান্য উন্নত সমরাস্ত্র দিয়েই পাকবাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছে বাঙালিকে। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে পূর্বাঞ্চলে সামরিক হামলা চালালে শুরু হয় সরাসরি পাক-ভারত যুদ্ধ। এ সময় হতে চীন জাতিসংঘে সরাসরি বাঙালি বিরোধি ভূমিকা পালন করতে থাকে। পাক-ভারত যুদ্ধের জন্য চীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে দায়ি করে। যুদ্ধ বিরতির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা এবং পাকবাহিনীর বর্বরতার ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করার লক্ষ্যে ৫ ও ৭ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে দুটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে। কিন্তু প্রস্তাব দুটোর বিরুদ্ধে চীন প্রথম ভেটো প্রয়োগ করে এবং চীনের নিজস্ব প্রস্তাবে ভারতকে আগ্রাসী পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, চীন জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের মাত্র ৪০ দিনের মাথায় নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসন লাভের পর প্রথম প্রস্তাবেই ভেটো প্রয়োগ করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করলে চীন এক বিবৃতিতে ‘তথাকথিত’ বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের তীব্র সমালোচনা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশকে তথাকথিত বাংলাদেশ বলে অভিহিত করে চীন চরম অবহেলা করেছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।” (সুত্রঃ দৈনিক পূর্বকোণ)

চীন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল, আবার যুদ্ধোত্তরকালেও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। অথচ বঙ্গবন্ধু বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি জনপ্রিয় সরকার চলমান ছিল।  চীনের ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে শেখ মণি বলেন, “এই ষড়যন্ত্রের একমাত্র লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হতে পারে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের জনপ্রিয় বিপ্লবী সরকারের পতন ঘটিয়ে পুরাতন শাসকশ্রেণীকে বহাল করা। কিংবা নতুন কোন প্রতিবিপ্লবী সরকারের পত্তন করা এবং সে সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যে পাকিস্তানের যে কোন ষড়যন্ত্রের সে সঙ্গী হবে। ... তাই সফল হোক, আর বিফলতার পঙ্কে ডুবে যাক, পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকরা হৃতবাজার পুনরুদ্ধারের লোভে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করার জন্যে চীনের সহযোগিতায় প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালাবেই।” (বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে!, ২য় আর্টিকেল, ১ম প্যারা, পৃ: ৯১)

চীন বঙ্গবন্ধুর বিপ্লবী জনপ্রিয় সরকারকে উচ্ছেদ করতে চায়- শেখ মণি এটাই প্রথমে বলেছেন। উদ্দেশ্যও পরিস্কার, পুরাতন শাসকশ্রেণীকে ফিরিয়ে আনা বা কোন প্রতিবিপ্লবী সরকারের সূচনা করা। যে সরকার চীনের তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হবে, সাথে সাথে পাকিস্তানের পুঁজিবাদীদের সহযোগিতা করবে এবং বাংলাদেশের বেহাত বাজারও ফিরে পাবে। এজন্য অগণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চীন যেকোন প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালাবেই।  

এই আর্টিকেলের দ্বিতীয় প্যারায় আমেরিকা তথা ইয়াঙ্কিদের প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন শেখ ফজলুল হক মণি। কূটনৈতিক অংশ হিসেবে আমেরিকা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও তাদের ষড়যন্ত্র ছিল দৃশ্যমান। তৎকালীন আমেরিকান সরকারের ভূমিকা কী ছিল- “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকা ছিল হতাশাব্যঞ্জক ও বিতর্কিত। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম নিক্সন, পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস পাকিস্তানঘেঁষা নীতি গ্রহণ করেন। মূলত এটি ছিল নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির নীতি। তারা এ সময় পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার নৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন যুগিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভ থেকেই নিক্সন সরকার ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক ঘৃণ্য কার্যকলাপকে সমর্থন জানিয়ে আসছিল। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন বাংলাদেশের বিজয় সুনিশ্চিত তখন যুক্তরাষ্ট্র ‘পাকিস্তান বনাম ভারত-বাংলাদেশ’ যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব উত্থাপন করে। এ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের গতিবেগকে স্তিমিত করে পাকবাহিনীকে পুনরায় অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার সুযোগ প্রদান করা। যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ অভিমুখে সপ্তম নৌবহরও প্রেরণ করেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকির মুখে যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত এ নৌবহর প্রেরণ বন্ধ করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক দলের উদারপন্থি নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সোচ্চার ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচার মাধ্যমের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে দ্বিধাহীনভাবে প্রচার চালিয়েছিল।” (মহাজ্ঞানী.কম)

বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভ করার পরেও এই চীন ও যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত পাকিস্তানের সাথে আঁতাত করে বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু সরকারকে হটানোর চেষ্টা করতে পারে আর তাদের এই কাজ সফল করার জন্য দরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরের পরাজিত গোষ্ঠী। এই প্রসঙ্গে শেখ ফজলুল হক মণি লিখেছেন, “পাকিস্তানের পুঁজিপতিদের স্বার্থের সাথে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির দীর্ঘদিন ধরে সংযুক্ত এবং যেহেতু বাংলাদেশের বন্ধু ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার বিরোধিতা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চে উভয়ের নীতির ঐক্য রয়েছে, সেহেতু বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেওয়ার পরেও চক্রান্ত সফল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে ইয়াঙ্কিরাও বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের উৎখাতের জন্য সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। ...সুতরাং এরমাত্র বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে তাদেরকে বাংলাদেশের ঘরের শত্রু বিভীষণদের মাধ্যমেই অগ্রসর হতে হবে। উপরোক্ত আলোচনার পরিপেক্ষিতে স্বভাবতই যে প্রশ্নটি সকলের মনকে নাড়া দেওয়ার কথা সেটা হলো যারা এই ঘরের শত্রু বিভীষণ, তাদের সামাজিক বা রাজনৈতিক স্বার্থ কি বা মনস্তাত্তি¡ক কারণ কি, যে কারণে ত্রিশ লাখ লোকের রক্তের প্লাবণের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন করার একআত্মঘাতী চক্রান্তে তারা লিপ্ত হয়ে পড়তে পারে।" (বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবে!- দূরবীণে দূরদর্শী, পৃ: ৯১, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)     

চীনের মত আমেরিকাও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক কারণে চক্রান্ত শুরু করতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন শেখ মণি। আবার এদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যে পাকিস্তান থাকবে তাও নিশ্চিত। তবে একথাও শেখ মণি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন যে, অভ্যন্তরীন শক্তিদের সরাসরি সহযোগিতা ছাড়া কোনক্রমেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে বাইরের শত্রুরা সাহস পাবে না। সতরাং অভ্যন্তরীণ শত্রুদের এই হীন উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।

‘বাংলার বাণী’তে ‘বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে!’ প্রবন্ধের তৃতীয় নিবন্ধটি লেখা হয় ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২। এই আর্টিকেলে তিনি মুলত দ্বিতীয় আর্টিকেলে আলোচ্য বিষয়ের বিস্তৃত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। চীন-আমেরিকা-পাকিস্তান বাংলাদেশের ভিতরে প্রতিবিপ্লবী কার্যক্রম একমাত্র অভ্যন্তরীণ শত্রুদের মাধ্যমে চালাতে পারে- এই বিষয়টি আবার পুনর্ব্যক্ত করেন শেখ মণি। বাংলাদেশ এক সময় ব্রিটিশ ঔপেিবশিক শাসনের অধীনে ছিল। ‘সোনার বাংলা’ স্বাধীন হলেও উপর্যুক্ত তিন দেশ সাম্রাজ্যবাদী নব্য ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করতে চায় অভ্যন্তরীণ শত্রুদের কাজে লাগিয়ে। যেহেতু বাংলাদেশের সাথে ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান, সেহেতু এশীয় রাজনীতি ও নব্য ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আভ্যন্তরীণ প্রতিবিপ্লবী শক্তিসমূহের সংহতি মজবুত করে বঙ্গবন্ধুর বিপ্লবী সরকারকে নিস্তেজ করা বা উৎখাত করতে চায় এই আন্তর্জাতিক চক্রটি।

শেখ ফজলুল হক মণি দুটি শ্রেণিকে চিহ্নিত করেছেন যারা দুশমনদের হাতের ক্রীড়ানক হতে পারেন। 
প্রথমত: বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাধারণ আভ্যন্তরীণ শত্রুরা- এই শ্রেণির শত্রুদের চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বা সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের জটিলতার দিকে না গিয়ে সরলীকরণ হিসাব ধরে বিন্যস্ত করেছেন তিনি। শেখ মণি সেই সকল প্রতিক্রিয়াশীলদের বুঝিয়েছেন, যারা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচির বিরোধীতা করেছিল, যারা কোনদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি তথা বিরোধীতা করেছিল। এরা হলো পিডিপি, জামাতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম। এদের ভোট প্রায় ১০ ভাগ। এদের মধ্য থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, আল-শামস্ বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। 

পিডিপি, জামায়াত ইসলাম, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা প্রসঙ্গে ‘বাংলাদেশ কোন্ পথে যাবে?’ আর্টিকেলে শাহরিয়ার কবির বলেন, তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের মূল্যে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে শুধু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নয়, যারা এদেশে ইসলামের নামে রাজনীতি ও সন্ত্রাসে বিশ্বাসী তারা সবাই স্মরণকালের নৃশংসতম গণহত্যা ও নারীধর্ষণসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান মদদদাতা ও খেদমতগার ছিল। জামায়াতে ইসলামী এদের ভেতর প্রধান দল হলেও হিংস্রতায় নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, পিডিপি কেউ কম ছিল না। তাদের ঘাতক বাহিনী আলবদর, আলশামস, রাজাকার, শান্তি কমিটি ও মুজাহিদ বাহিনীরা গণহত্যা ও নির্যাতন কী ধরনের নৃশংসতা প্রদর্শন করেছিল দেশে ও বিদেশে তার হাজারও বয়ান আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার প্রধান সহযোগীরা এ কারণেই ১৯৭২-এর সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষণার পাশাপাশি ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল এবং অন্য কোনো সংগঠন প্রতিষ্ঠার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ধর্মের নামে গণহত্যাকারীদের বিচারও আরম্ভ করেছিলেন। গণহত্যাকারী পাকিস্তানের এ দেশীয় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দোসরেরা ’৭১-এর শোচনীয় পরাজয়ের গøানি কখনও ভুলতে পারেনি। এই চরম গøানি ও ক্ষোভ তাদের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্ররোচিত করেছে, যা তারা বাস্তবায়ন করেছে এককালে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর কর্মকর্তা জেনারেল জিয়াউর রহমানের দ্বারা। ” 

প্রাসঙ্গিক কারণে, দেশে যদি কোন প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বা কোন বিদেশী শক্তি প্রতিবিপ্লবী চক্রান্তে হাত দেয় তাহলে তারা সঙ্গত কারণে এদের মধ্য থেকে পুনরায় অনুচর সংগ্রহের চেষ্ট করবে। এমন মতই শেখ মণি যুক্তির মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-
“...পাকিস্তান বা চীনের বা আমেরিকার দ্বারা পরিচালিত কোন প্রতিবিপ্লবী চক্রান্তে এদের শরীক হওয়ার সম্ভাবনা আর একটি কারণে খুবই প্রকট। সেটা হলে এরা বনেদীভাবে সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিকভাবে ভারত বিদ্বেষী এবং যে কোন শক্তি লঙ্ঘন কিংবা কোন স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করে সহজে এদেরকে বাংলাদেশ সরকার-বিরোধী কাজে টেনে নামাতে পারবে।” (বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবে!- দূরবীণে দূরদর্শী, পৃ: ৯২, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)

প্রতিবিপ্লবী আন্তর্জাতিক চক্র সহজেই স্বাধীনতা বিরোধীদের কাজে লাগাতে পারবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন শেখ মণি। কারণ এই সব প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী জন্মগতভাবে সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিকভাবে ভারতবিদ্বেষী। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে সহজেই এদেরকে কাজে লাগাতে পারবে আর্ন্তাতিক এই চক্রটি। তবে তারা যে পুরাতন লেবাস নিয়ে সফল হবে না এটা নিশ্চিত করে বলেছেন শেখ মণি। রাজনৈতিক পুনর্জীবন লাভের জন্য এরা যে কোন মঞ্চে যোগ দিতে তারা প্রস্তুত। সেখানে যদি তারা বর্তমান সরকারের বিরোধতিা করতে পারে ও ভারতবিরোধী প্রচারণা করতে পারে। সেক্ষেত্রে এই চক্রের সাথে চীন-আমেরিকা-পাকিস্তানের সাথে মিলে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ উভয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই।

দ্বিতীয়ত: আমেরিকা ও চীনের এজেন্ট ও সমর্থকরা-এই এজেন্ডায় শেখ ফজলুল হক মণি লিখেছেন, “বাংলাদেশ সাবেক পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আমেরিকার সাথে গত ২৩ বছর ধরে ও চীনের সাথে গত ১০ বছর ধরে বাধা পড়েছিল। এদেশে ব্যবসা বাণিজ্যে, অফিস আদালত, পুরাতন সামরিক বাহিনীতে একদল লোক বরাবর চীন ও আমেরিকাকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। তাছাড়া রাজনৈতিক মতবাদের কারণেই এখানে চীন সমর্থক রাজনৈতিক দলও প্রকাশ্যে কাজ করতে পারতো। বিগত স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এরা সরাসরি বাংলাদেশের সপক্ষে কাজ তো করেই নাই, পক্ষান্তরে সমর্থন জুগিয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক চক্রকে। বিশেষ করে সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারতবর্ষ বাংলাদেশের আবির্ভাবকে সমর্থন দেওয়ার ফলে এরা মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হস্তকে সুদৃঢ় করার জন্য। ...চীন ও মার্কিন লবীর এই অনুগত অনুচররা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উৎখাতের জন্য এবং আমাদের সাথে ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে প্রতিষ্ঠিত সদ্ভাব নষ্ট করার জন্য সর্বতোভাবে কাজ করবে।” (বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবে!- দূরবীণে দূরদর্শী, পৃ: ৯৫, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)

শেখ মণি মনে করেন- দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ পাকিস্তান ও চীনের সাথে অনেকগুরো কারণে বাঁধা পড়েছিল। তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস আদালতে, পুরাতন সেনাবাহিনীতে একদল লোক সবসময় চীন ও আমেরিকাকে সমর্থন দিয়ে এসছিল। চীনপন্থী রাজনীতি করারও সুযোগ ছিল। এরা মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ তো করে নাই বরং উল্টো পাকিস্তানী সামরিক চক্রকে সহযোগিতা করেছিল। আর যেদিন থেকে ভারত-রাশিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দিল, সেদিন থেকে তারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হস্তকে শক্তিশালী করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের স্বাভাবিক সমস্যা নিয়ে তারা প্রকাশ্যে আসা শুরু করেছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র লবীর এই অনুগতরা বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতের জন্য এবং ভরত-রাশিয়ার সম্পর্ক নষ্টের জন্য সবকিছু করতে পাওে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন শেখ মণি।
  
আলোচ্য প্রবন্ধের চতুর্থ আর্টিকেলটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭২। এই নিবন্ধে শেখ ফজলুল হক মণি যেসব আমলা প্রতিবিপ্লবী হয়ে উঠতে পারে তাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। সেইসব আমলাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করেছেন শেখ মণি। আমলাদের বিশাল একটি অংশ শুধু পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন তা নয়, তারা পাকিস্তানী মনমানসিকতায় বেড়ে উঠেছে, পাকিস্তানী ভাবপন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোতে কাজ করতে অভ্যস্ত ছিল তারা। আমলাদের একটি বড় অংশ সাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তারা পাক হানাদারদেও  সহযোগী হিসেবে কাজ করেই ক্ষান্ত হয়নি, মানসিকভাবে তারা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ চায়নি। 

শেখ ফজলুল হক মণি লিখেছেন, “বাংলাদেশের রাজনীতির গত দশ বছরের ইতিহাস লক্ষ্য করলেই একথা প্রমাণিত হবে যে, এখানকার প্রশাসন কর্তাদের অধিকাংশই এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দেননি, এমনকি চাননি যে, বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম হউক। ...এবং পঁচিশে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এদেশের শতকারা পঁচানব্বই জন সরকারি আমলা পাক সরকারের অধীনে কাজ করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে শতকরা নব্বই জন করেছিল স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে।” (বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবে!- দূরবীণে দূরদর্শী, পৃ: ৯৫, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)

তৎকালীন আমলাদের সম্পর্কে শেখ মণি যুক্তি সহকারে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিয়েছেন। ষাটের দশকের আমলাদের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে একথা স্পষ্ট হবে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দেয়া দূরে থাক, অধিকাংশ আমলা চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। ‘৭১ এর অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমলারা যে অফিস বর্জন করেছিল, তা ছিল জনগণের চাপে। কারণ বঙ্গবন্ধুকে যখন গ্রেফতার করা হলো তখন তারা আবার অফিস আদালত খুলে বসেছিলেন। ‘৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৫ ভাগ আমলা অফিস করেছিলেন। ৯০ ভাগ আমলা তা করেছিলেন স্চ্ছোয়। এসব যৌক্তিক কারণে আমলাদের অবিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করেন তিনি।

শেখ মণি সাধারণ জনগণের কিছু প্রত্যাশার কথা বলেছেন। জনগণ চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরকার নতুন প্রশাসন গড়ে তুলবেন। কিন্তু শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার কারণে পুরাতন আমলাদের পুনর্বহাল করতে হয়েছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে শিক্ষিত ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকের অভাব ছিল। এ কারণে অধিকাংশ প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাপন্ন আমলাদের দ্বারা পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। এ কারণে এই সব সুবিধাভোগী আমলা চাইবে বঙ্গবন্ধুর বিপ্লবী গণতান্ত্রিক সরকারকে অজনপ্রিয় করে তুলতে। এমনকি দেশটাকে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নিক্ষেপ করতেও দ্বিধা করবে না। 

বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচির প্রতি আমলারা মূলত বিদ্বেষী ছিল। এই প্রসঙ্গে শেখ ফজলুল হক মণি লিখেছেন, “বর্তমান সরকারের সমাজবাদী কর্মসূচির জন্যও পুরাতন আমলারা সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকবে। একটি পুঁজিবাদী সামাজিক ব্যবস্থার আওতায় রাজ কর্মচারীদের ভোগের ও বৈভবের দিগন্তু যতটা প্রসারিত, সমাজতন্ত্রে সেটা সম্ভব নয় কোন ক্রমেই। ... কারণ অপরিমিত সামাজিক সুযোগ ভোগ করে অভ্যস্ত এই অসৎ আমলারা কোনদিন চাইবে না যে, তাদের সুবিধা ও বৈভব ভোগের অধিকার একদিন জনগণ কেড়ে নিক। এবং এই কারণে তাদের অন্যতম লক্ষ্য হবে বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি বানচাল করে দেওয়া। এই পরিকল্পনা সফল করার জন্য তারা যে কোন রকমের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিবিপ্লবী চক্রান্তের সাথে হাত মিলাবেই। আর আমেরিকা ও চীনের সাথে বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে যেখানে তাদের যোগসূত্র রয়েছে সেখানে তাদের সাথে হাত মিলানই স্বাভাবিক।” (বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবে!- দূরবীণে দূরদর্শী, পৃ: ৯৬, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)

প্রসঙ্গক্রমে শেখ মণি’র অভিমত- বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক কাঠামো বাস্তবায়ন হলে অতিরিক্ত সকল সুযোগ সুবিধা বন্ধ হবে। আর এখানেই আমলারা বেঁকে বসেছিলেন। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় আমলাদের ভোগ ও বৈভব যত বেশি সমাজবাদী ব্যবস্থায় তা নেই বললে চলে। সমাজবাদী কমৃসূচি যেন বাস্তবায়িত না হতে পারে এজন্য এইসব সুবিধাবাদী আমলারা আন্তর্জাতিক প্রতিবিপ্লবী চক্রের সাথে মিলে প্রতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে।

শেখ মণি মনে করেন- আমলাদের একটি অংশ যারা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন, তারা হয়ত প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত বিরোধীতা করবে। তবে তাদের এই বিরোধীতা আদর্শের কারণে নয়, স্বার্থের কারণে। এই শ্রেণির আমলারা শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মত জনপ্রিয় সরকারের সাথে থাকবে না।

শেখ ফজলুল হক মণি আর্টিকেলের শেষে সংক্ষেপে আমলাদের প্রতিবিপ্লবী চরিত্রের কারণগুলো তুলে ধরেছেন- আমলারা পাকিস্তানের পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর সাথে জুড়ে ছিল বলে এরা গণতন্ত্র বিমুখ। এরা অপরিমিত ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার মালিক হবার জন্য আগ্রহী থাকে, সাথে সাথে এরা দুর্ণীতিপরায়ণ এবং অপব্যয়ী। এরা আমেরিকাসহ পশ্চিমা শক্তির দ্বারা লালিত হয়েছে, আবার চীনের সাথে এদের সংযোগ ছিল। আমলারা সমাজতন্ত্রের বিরোধী, কারণ তারা জানে বঙ্গবন্ধু যেভাবে তাঁর সমাজতন্ত্রের কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন তাতে করে একদিন তাদের সঞ্চিত অবৈধ গোপন সম্পদ ধরা পড়বে। ক্ষমতার উৎসগুলো বিকেন্দ্রিকরণ হোক তারা তা চায় না। এরা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব মানতে রাজী নয়, কারণ তারা জানে তাদের উপর বর্তমান সরকারের নির্ভরশীলতা একটা সাময়িক ব্যাপার। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের নেতিবাচক ভূমিকার কারণে তারা ভীতসন্ত্রস্ত। তাছাড়া জনগণের সেবক হিসেবে এরা কাজ করে না। উচ্চপদ লাভের জন্য এরা পরস্পরে দ্বন্ধে জড়িয়ে পড়ে দোষ চাপায় সরকারের উপর। আমলারা উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতালিপ্সু হওয়ার কারণে ষড়যন্ত্র করে রাজশক্তি দখল করা স্বাভাবিক প্রবণতা। যে কোন জনপ্রিয় সরকার এদের জন্য ক্ষমতা হরণকারী বলে বিিেচত। প্রতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সাথে যারা সরাসরি জড়িত তাদের সাথে মিলে আমলারা প্রতিবিপ্লবে অংশ নিবেন।

‘বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে!’ প্রবন্ধের ৫ম ও শেষ আর্টিকেলটি প্রকাশিত হয় ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২। শেখ মণি চারটি আর্টিকেলে বাংলাদেশের সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি এখানে আশাবাদী এই কারণে যে, বাংলাদেশে আর কোন বিকল্প সংগঠন নেই- যার উপর ভর করে কোন প্রতিবিপ্লব ঘটতে পারে। বিপ্লবী সরকারকে অজনপ্রিয় করতে পারলেই তারা কেবল প্রতিবিপ্লব ঘটাবে। এজন্য তিনি আওয়ামীলীগকে সতর্কতার সাথে রাষ্ট্র পরিচালনার উপর বেশি জোর দিতে বলেছেন। 

প্রসঙ্গক্রমে, শেখ ফজলুল হক মণি বৃটেনের টার্চিলের কথা বলেছেন। চার্চিল দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি বিশ্বের নেতা হয়ে উঠেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ পরবর্তী বৃটেনের জনগণ চার্চিলকে ক্ষমতায় না এনে এটলীকে এনেছিল। এটাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সৌন্দর্য। আর ক্ষমতার পালাবদল কারো জীবননাশের মাধ্যমে হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে ভিন্ন প্রেক্ষাপট। শেখ মণি বলেন- “...আওয়ামী লীগের উপর যদি জনতা আস্থা হারিয়ে ফেলে, এদেশের সরকার চালানোর দায়িত্ব যদি আওয়ামী লীগের হাত থেকে সরে যায় তাহলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে তাতে সৃষ্টি হবে মারামারি হানাহানি।

সুতরাং দলের স্বার্থে নয়, বাংলাদেশের স্বার্থেই আওয়ামী লীগকে আজ সরকার চালাতে হবে পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। এবং এ কারণেই ব্যক্তিগত লোভ লালসার কথা ভুলে গিয়ে তাদের হাত দিতে হবে জনগণের সমস্যার আশু সমাধানের জন্য। এ পথে যদি কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাকে দমন করতে হবে কঠোর হস্তে।

প্রতিবিপ্লবীদের নিয়ে দাবা খেলা চলতে পারে, গণমৃত্যু সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা যত শীঘ্র পুরাতন দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে জনগণের দিকে দৃষ্টি সম্প্ররিত করে দিতে পারি তত আমাদেরও মঙ্গল। দেশেরও উপকার এবং এরও একমাত্র উপায় হচ্ছে উচ্চাভিলাষী মধ্যবিত্তের দৃষ্টি যাদের একচেটিয়া রাজত্ব দখলের প্রয়াসকে ধ্বংস করে দিয়ে দেশের মজলুম জনতাকে টেনে তুলে আনা। দল থেকে, সরকার থেকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পার্লামেন্টের প্রতিনিধিত্ব থেকে মধ্যবিত্তের মনোপলি দুর করে কৃষক শ্রমিক মধ্যবিত্তের সমাজতন্ত্রীদের স্থান করে দিতে হবে। এবং সেটাই হবে সাচ্চা মুজিববাদী সরকার। সব রকমের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবিপ্লবী তৎপরতার বিরুদ্ধে যেটা হবে সব চাইতে বড় বর্ম। তাই শহুরে মধ্যবিত্তের প্রস্তাবিত তথাকথিত বিপ্লবী সরকারের প্রতিবিপ্লবী দাবির মুখে পদাঘাত করে বঙ্গবন্ধুর আকাক্ষিত শতকারা নব্বই জনের গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করতে পারলেই বাংলাদেশ টিকে যাবে।” (বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবে!- দূরবীণে দূরদর্শী, পৃ: ১০০, ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)

সদ্য স্বাধীন দেশে একমাত্র দল আওয়ামীলীগ। বিকল্প কোন সংগঠন নেই যারা সরকার চালাতে পারে। শেখ মণি মনে করেন- আওয়ামী লীগের উপর থেকে যদি জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলেন, তাহলে মারামারি, হানাহানির মত ঘটনা ঘটবে। সমাধানও শেখ মণি দিয়েছেন। দলের স্বার্থের উর্দ্ধে উঠে বাংলাদেশের স্বার্থে পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সরকার পরিচালনার কথা তিনি বলেছেন। সাথে সাথে ব্যক্তিগত লোভ লালসা ত্যাগ করে জনগনের সমস্যার দ্রুত সমাধানের দিকে জোর দিতে বলেছেন তিনি। আর এক্ষেত্রে যদি কোন অপশক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাদের কঠোর হস্তে দমনের কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকার ক্ষমতায়। রাষ্ট্র পরিচারনার দায়িত্ব যেহেতু আওয়ামী লীগ নিয়েছে, সুতরাং দায়িত্বের ক্ষেত্রে কোন হেলাফেলা কাম্য নয় বলে মনে করেন শেখ মণি। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সর্বদা গ্রামের আশি ভাগ মানুষকে সাথে পাবে। 

প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে। এজন্য যতদ্রুত ক্ষমতা জনগণের দিকে বিকেন্দ্রীকরণ হবে ততই মঙ্গল। শেখ মণি আরো মনে করেন মধ্যবিত্তের উচ্চাভিলাষকে ধ্বংস করে মজলুম জনতাকে প্রান্তিক অবস্থা থেকে টেনে তুলে আনা। দলে ও সংসদে মধ্যবিত্তের মনোপলি অবস্থা থেকে সরে এসে কৃষক শ্রমিক মধ্যবিত্তের সমাজতন্ত্রীদের স্থান দেয়ার উপর জোর দিয়েছেন তিনি। এটা করতে পারলে তা হবে যথার্থ মুজিববাদী সরকার। মুজিবাদী সরকার সফল হলে সকল প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা বন্ধ হবে। এ সকল কর্মপন্থা বাস্তবে রূপ দিতে পারলে বঙ্গবন্ধুর আকাঙ্খিত শতকরা নব্বই জনের গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম হবে, বাংলাদেশ বীরদর্পে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াবে বিশে^র বুকে। শেখ মণি’র ভাবনাও এটাই।

পরিশেষে বলা যায় যে, ‘দূরবীনে দূরদর্শী' গ্রন্থটিতে শেখ ফজলুল হক মণি’র যে লেখাগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তার মধ্যে সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, “বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব আসবে!”। কারণ তাঁর এ লেখাটিতে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শন রয়েছে। শেখ মণি প্রতিবিপ্লবীদের সকল চক্রান্ত রুখে দিতে গণমানুষের দল আওয়ামী লীগকে মুজিববাদী দর্শন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মাণের কথা বলেন। শেখ ফজলুল হক মণি এমন একজন রাজনৈতিক দার্শনিক, যিনি জগৎ জীবনের যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে অতীত ও বর্তমানের উপর অনুমান করে ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে  অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। 

বুক রেফারেন্স 
ক্লাস স্ট্রাগল্স ইন ফ্রান্স: কার্ল মার্কস
টম বটোমর, মার্কসীয় সমাজতত্ত¡, হিমাংশু ঘোষ অনূদিত, কে পি বাগচী এন্ড কোম্পানী, কলকাতা, ১৯৯৩
মার্কস এঙ্গেলস, জার্মান ভাবাদর্শ, ১৮৪৫, গৌতম দাস অনূদিত, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ফেব্রæয়ারি ২০০৯, পৃ: ১৫১ 

দূরবীণে দূরদর্শী: শেখ ফজলুল হক মণি
দ্য ন্যাচার অব ডেমোক্রেসি ফ্রিডম এন্ড রেভুলেশন: হারবার্ট অপ্থাকার)
বিবিসি অনলাইন
সূত্রঃ নিউজজি২৪)
দৈনিক পূর্বকোণ)
(মহাজ্ঞানী.কম)
‘বাংলাদেশ কোন্ পথে যাবে?’ শাহরিয়ার কবির

লেখক: কবি ও শেখ মণি গবেষক, গ্রন্থনা ও প্রকাশনা বিষয়ক উপ সম্পাদক বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।

এসি