বিলুপ্তির পথে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:১৮ পিএম, ১১ নভেম্বর ২০২২ শুক্রবার
পূর্ব আকাশে যখন সূর্য ওঠে মেঘের আড়াল থেকে, তার রঙ হয় করঞ্জা রঙিন। নীল আকাশে পাখির উড়াউড়ি আর বাঁশ বাগানের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়া রোদেলা রশ্মি চিনিয়ে দেয় অপূর্ব গ্রামকে। সকালে পাখির কিচির-মিচির শব্দে ঘুম ভাঙে খোকা-খুকিদের। সকালের মিষ্টি মৃদু বাতাশে আনন্দের ঢেউ খেলে যায় পুরো শরীরজুড়ে।
সবুজ, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি। প্রকৃতির সৌন্দর্যের এমন লীলাভূমি কোথাও নেই আর। অসংখ্য বৃক্ষ-গুল্ম ছড়িয়ে আছে এদেশের জনপদ অরণ্যে। মধুকুপি কাঁঠাল, পশুর, বট তাদেরই কোনও কোনওটির নাম।
এ দেশের প্রতিটি নদ-নদী ভরে থাকে স্বচ্ছ জলে। প্রকৃতি আর প্রাণীকুলের বন্ধনে গড়ে উঠেছে চির-অবিচ্ছেদ্য এক সংহতি। তাই হাওয়া যখন প্রাণের চঞ্চলতা জাগায়, তখন ভোর আকাশের শঙ্খচিল যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে। আর ধানের গন্ধের অস্পষ্ট লক্ষ্মী প্যাঁচাও মিশে থাকে প্রকৃতির গভীরে। অন্ধকারের বিচিত্র রূপ এই দেশ।
নীল-সবুজে মেশা বাংলার ভূ-প্রকৃতির মধ্যেই এই অনুপম সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে। সবুজ ফসলের ক্ষেতে সোনালী আভা চোখ জুড়ানো আর তপ্ত রোদে গরুর বিশাল পাল নিয়ে রাখালের ছুটে চলা। গ্রামের সরু পথে ফসল ভর্তি গরুর গাড়ির গড়িয়ে চলা।
রূপসী গ্রাম বাংলায় এই ঐতিহ্য ও শৈশবের স্মৃতি আর আগের মত চোখে পড়ে না। দেখা মিলছে না সেই আগের মত দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে রাতের অন্ধকারের ছায়া নামাতে গ্রাম-বাংলায় অন্যতম ভরসা কেরোসিনে জ্বালানো হারিকেন বা কুপি বাতি।
চলচ্চিত্রে জহির রায়হানের উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’সহ এরকম হাজারো পুরাতন সেই সিনেমাগুলোতে দেখা যায় ডিঙি নৌকায় অন্ধকার রাতে নদীর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া হারিকেনের আলোতে নৌকার মাঝিরা। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ‘ডাক হরকরা’ গল্পের নায়ক এক হাতে হারিকেন অন্য হাতে বল্লম নিয়ে রাতের আঁধারে ছুটে চলেছেন কোনও একদিকে।
সন্ধ্যা চারিদিকে ঘনিয়ে এলেই সবার আগে মনে পড়ত সেই ঘরের কোনে রাখা বাহারি ধরনের কুপি ও হারিকেনের কথা। হারিকেনের স্বচ্ছ কাঁচ পরিস্কার করে কেরোসিন ভরে জ্বালিয়ে দেওয়া হত প্রতিটি ঘরে ঘরে। গ্রামীণ জনপদে প্রতিটি বাড়িতেই এক বা একাধিক কুপি বাতি বা হারিকেন ছিল মানুষের অন্ধকার নিবারণের একমাত্র অবলম্বন।
অন্ধকার হওয়ার পূর্বেই সবার বাড়িতে শোভা পেত হারিকেনের আলো। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে রাতের যাবতীয় কাজকর্ম চলত এই কুপির আলোতে। কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বৈদ্যুতিক অথবা ব্যটারি চালিত লাইটের সুইচে টিপ দেয়া মাত্রই ঘর ভরে ওঠে আলোয় আলোকিত।
যার ফলস্বরূপ কেরোসিনের কুপিবাতি ও হারিকেনের চাহিদা কমে গেছে। গ্রামের কিছু কিছু বাড়িতে এখনও কুপি বাতি, হারিকেন দেখা মিললেও এখন আর সেগুলো জলে না!
একসময় গ্রামে গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ চোখে পড়ত। যুগোপযোগী বিবর্তনের ফলে গ্রাম এখন হয়ে উঠছে অপরিকল্পিত নগরায়ণের স্থান। গ্রামে গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা। পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। সংকুচিত হয়ে আসছে আবাদি জমি, পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ জনপদ। আর এতে করে পাল্টে যাচ্ছে ছন, মাটি বা টিনের ঘর। নতুন করে সেখানে স্থান নিচ্ছে পাকা দালান বাড়ি। সেখানে নীরবেই চলছে যেন এক নতুন পরিবর্তন।
খেয়াল করলেই মনে হবে বেশ, গ্রামে উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু আবার মনে হবে- আমাদের সেই শৈশবের সময়টা-ই তো ভালো ছিল! উন্নয়ন তো আমরা সকলেই চাই। সেই সাথে চাই গ্রামীণ পরিবেশও। শহরের মতো অপরিকল্পিত নগরায়ণ যেন ঢুকে না পড়ে কোনো গ্রামে। কালের বিবর্তনে যেন হারিয়ে না যায় গ্রামের সরল পরিবেশ। উদ্যমী ভাবনাহীন শিশুকালীন সময়গুলো আজ যে বড্ড মনে পড়ে।
লেখক- মো.ইব্রাহীম প্রামানিক,
শিক্ষানবীশ সাংবাদিক ও সাংগঠনিক সম্পাদক,
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সাংবাদিক সমিতি (ডিআইইউসাস)।
এনএস//