ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

লুলার মতো ফিরবে ব্রাজিল?

সোহাগ আশরাফ

প্রকাশিত : ১২:৩২ পিএম, ২১ নভেম্বর ২০২২ সোমবার | আপডেট: ০২:৫০ পিএম, ২১ নভেম্বর ২০২২ সোমবার

ব্রাজিলের বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে তারা এবার বিশ্বকাপ জিতবে। নেইমারের দলের বিশ্বাসের পক্ষে অনেক যুক্তিও রয়েছে। প্রথমত: ২০০২ সালে এশিয়াতেই শেষ বিশ্বকাপ জিতেছিল ব্রাজিল। ঠিক বিশ বছর পর একই মহাদেশে এবারের বিশ্বকাপ। একই সাথে বিশ্বাসটা আরও শক্ত হয়েছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রায় বিশ বছর পর তৃতীয়বারের মত রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভাকে ঘিরে। তার এ চমকপ্রদ বিজয় এবং আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসা ব্রাজিলবাসীর কাছে বড়ই আনন্দদায়ক। যা উজ্জীবিত করছে ব্রাজিল টিমকে। 

মরুর বুকে কারা উঁচিয়ে ধরবে শিরোপা? সেই বিতর্ক শুরু হয়েছে অনেক আগেই। ভক্ত থেকে শুরু করে ফুটবল বোদ্ধারাও ভব্যিষ্যৎবাণী করায় পিছিয়ে নেই। এ তালিকায় আছেন গণিতবিদরাও! সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সফল হতে চলেছে ব্রাজিলের ‘মিশন হেক্সা’ (ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জয়ের অভিযান)।

ইংল্যান্ডের বিখ্যাত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ডের গবেষক জশুয়া বুলের তৈরিকৃত গাণিতিক মডেলের সাহায্যে করা হয়েছে এই ভবিষ্যৎবাণী। প্রকাশিত গবেষণার ফলে অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়েছে, যা গ্রুপ পর্বের ১০ লাখ সিমুলেশনের (প্রতিলিপি) মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার আসা ফলকে বেছে নিয়েছে। আর নক-আউট পর্বের প্রতিটি ম্যাচের ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে এক লাখ বার সিমুলেশনের মাধ্যমে। 

সেমিফাইনালে দেখা মিলবে বহুল আকাঙ্ক্ষিত ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দ্বৈরথের। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ে নেইমারদের পক্ষে আসছে ফল। আরেক সেমিতে বিশ্বকাপের শিরোপাধারী ফরাসিরা হার মানবে বেলজিয়ানদের কাছে। এরপর ফাইনালে ষষ্ঠ শিরোপা জয়ের উল্লাসে মাতবে আসরের সফলতম দল ব্রাজিল, আরও একটি আক্ষেপ সঙ্গী হবে বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্মের। বুলের মডেলের ভবিষ্যৎবাণী কতখানি সত্যি হয়, সেটাই এখন দেখার।

লুলা এর আগে ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সে সময় তার রাষ্ট্র-পরিচালিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক নীতিসমূহ লক্ষ লক্ষ লোককে দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্ত করেছিল। এবারো তিনি সেই নীতিই অব্যাহত রাখবেন বলে মনে করা হচ্ছে। সাবেক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এবং ইস্পাত কারখানা শ্রমিক লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভার জন্ম এক দরিদ্র পরিবারে।

২০০৩ থেকে ২০১০ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকার সময় লুলার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া।

ব্রাজিল শুধু দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম দেশই নয়, ব্রিকস জোটেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এই দেশটি - যার আন্তর্জাতিক গুরুত্ব কম নয়।

একসময় মানুষের ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূরীকরণে বিশ্বে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ব্রাজিল। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও বিশ্ব ব্যাংকের এক সময়ের হিসাব অনুযায়ী, ব্রাজিলের অর্থনীতি ছিল দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ, বাজার বিনিময়ের ভিত্তিতে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম ও ক্রয়ক্ষমতা সমতার ভিত্তিতে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম অর্থনীতি ছিল দেশটির। ব্রাজিলের অর্থনীতি একটি মিশ্র অর্থনীতি। দেশটির যথেষ্ট পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যা এর অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।

অথচ সেই লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে এখন খাদ্যসংকট প্রতি বছরই বাড়ছে। জনগণের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির সরকার।  ২০০৪ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ব্রাজিলে ক্ষুধার্ত মানুষের হার ৯.৫ শতাংশ থেকে নেমে ৪.২ শতাংশ হয়। তবে গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিক মন্দা, করোনাভাইরাস মহামারী ও ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি দেশটির অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রাজিলের জনসংখ্যার ১৫.৫ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে।

এ অবস্থায় অনেকে বলছেন, ব্রাজিলে লুলার জয়ের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় একটা ‘গোলাপী ঢেউ’ জোরদার হয়েছে। যে ঢেউ এখন কাতারে পৌঁছে গেছে। কারণ এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট ব্রাজিল। তারকায় ঠাসা দলটিকে ঘিরে ভক্তদের আশার পারদ আকাশচুম্বী।

দলের নিউক্লিয়াস নেইমার এবার পাদপ্রদীপের আলোয়। এবার চ্যাম্পিয়ন হলে ব্রাজিলের হেক্সা মিশন পূর্ণ হবে। ছয়বারের মতো ট্রফি বগলদাবা করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে ব্রাজিলের।

ব্রাজিল দলের সাম্প্রতিক পারফরমেন্স চোখ ধাধানো। কোচ তিতের অধীনে ব্রাজিল গত ২৯ ম্যাচে হারেনি, শেষ ১৭ ম্যাচের ১৩টিতে কোন গোলও হজম করেনি। একই সঙ্গে এই ২৯ ম্যাচে ব্রাজিল গড়ে আড়াইটি করে গোল দিয়েছে প্রতিপক্ষের জালে।

ফিফা বিশ্বকাপে ব্রাজিল এখনও পর্যন্ত সবার ওপরে আছে পাঁচটি বিশ্বকাপ নিয়ে, ২০ বছর আগে শেষ বিশ্বকাপ জিতলেও এখনও প্রতি বিশ্বকাপের আগেই ব্রাজিলকে ধরা হয় ফেভারিট দল। এটা দলটার ঐতিহ্য ও পরিচিতির কারণে।

ফুটবলের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট দ্য অ্যাথলেটিক তাদের বিশ্লেষণে লিখেছে, ব্রাজিলের ছয় নম্বর শিরোপা, যাকে ‘হেক্সা’ বলা হচ্ছে সেটা অর্জনের সামর্থ্য এই স্কোয়াডের আছে। দ্য অ্যাথলেটিকে বলা হচ্ছে ব্রাজিলের স্কোয়াডের গভীরতা যে কোনও দলের জন্য ঈর্ষণীয়।

ফুটবল লেখক জেমস হর্নক্যাসলের মতে, “ব্রাজিলের এই দলটিতে নেইমারের সামর্থ্যের সবটুকু ব্যবহার করা গেলে এবার ব্রাজিল ছয় নম্বর বিশ্বকাপ জিততেও পারে।”

এদিকে প্রায় ছয় বছর ধরে ব্রাজিল দলের দায়িত্বে আছেন তিতে। তিনি এই বিশ্বকাপের পর আর দায়িত্বে থাকছেন না।

২০১৮ সালের বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে হারের পর তিনি দায়িত্ব ছাড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত থেকে গেছেন এবং ব্রাজিলকে টানা দুই কোপা আমেরিকা ফাইনাল খেলিয়েছেন, যার মধ্যে একবার চ্যাম্পিয়ন ও একবার রানার আপ হয়েছে দলটি।

তিতে খুব কঠিন একটা সময়ে দলটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন, একে তো ২০১৪ সালের সেই সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে সাত গোল হজম, এরপরে কোপা আমেরিকার গ্রুপ পর্বে বাদ পড়া একটি দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি।

সব কথার শেষ কথা, কাতার বিশ্বকাপের আগে চলতি বছরের মার্চে বেলজিয়ামের কাছ থেকে র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থান দখলে নেয় ব্রাজিল। নেইমার, ভিনিসিয়াস, রদ্রিগো, গ্যাব্রিয়েল জেসুসদের নিয়ে দারুণ আক্রমণভাগ ব্রাজিলের। মধ্যমাঠ ও রক্ষণেও সমীহ জাগানোর মতো খেলোয়াড় দলটিতে। অধিকাংশ ফুটবল পণ্ডিত ও সাবেক ফুটবলারদের চোখেই এবার শিরোপার সবচেয়ে বড় দাবিদার জোগো বনিতোর উত্তরসূরিরাই।
এসএ/