গনিম আল মুফতাহ:
অপূর্ণতাকে জয় করা এক পূর্ণাঙ্গ গল্পকার
নাজমুশ শাহাদাৎ
প্রকাশিত : ০৪:১৯ পিএম, ২৫ নভেম্বর ২০২২ শুক্রবার
গনিম আল মুফতাহ
চেষ্টা আর ইচ্ছে থাকলে জীবনে যত প্রতিবন্ধকতাই আসুক না কেন, এই জগত সংসার একদিন ঠিক তাকে সফলতার মুকুট পরিয়ে দেয়। সুস্থ ও স্বাভাবিক দেহখানা নিয়ে অনেকে যখন আক্ষেপের সুরে ব্যর্থতার গান গাইছেন, তখন শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে কিছু মানুষ নিজেকে নিয়ে গেছেন সফলতা ও গ্রহণযোগ্যতার শীর্ষে। ইতিহাস তার পাতার সোনালী ফ্রেমে এমন অনেক ব্যক্তিকেই বন্দি করেছে।
অ্যামিওট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিসে আক্রান্ত হয়ে কথা বলা ও চলার শক্তি হারিয়েও অদম্য মনোবল আর চেষ্টার ফলে স্টিফেন হকিং হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত একজন পদার্থ বিজ্ঞানী।
বিখ্যাত আইরিশ লেখক ক্রিস্টি ব্রাউন সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হওয়ার পর হাত দুটো অসাড় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি, কাজের প্রতি ভালোবাসা আর নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি একসময় শুরু করলেন পা দিয়ে টাইপ করে লেখা।
দৃষ্টিহীনতা ও বধিরতা নিয়েও কেবলমাত্র নিজ কর্মের গুণে যে বিশ্ব সমাদৃত হওয়া যায় তার অনন্য উদাহরণ আমেরিকার বিখ্যাত লেখক ও সমাজসেবী হেলেন কিলার।
এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, যারা নানা রকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও বিভিন্ন রকম প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছেন। এমনই একজন হচ্ছেন এবারের বিশ্বকাপে ফিফার শুভেচ্ছা দূত গনিম আল মুফতাহ। ২০ বছর বয়সী এই তরুণের কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে কাতারে শুরু হয় ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ২০২২-এর যাত্রা।
গনিম কাতারের অধিবাসী হলেও সমগ্র আরবসহ পুরো বিশ্বের কাছে এক অনুকরণীয় ব্যক্তি। তিনি কাতারের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিও বটে। জন্মগতভাবে শারীরিক অপূর্ণতা নিয়ে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ আরব বিশ্বের একজন জনপ্রিয় ও সমাদৃত মোটিভেশনাল স্পিকার ও ইউটিউবার হয়ে ওঠার গল্পটা মোটেও সহজ ছিল না।
মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই কডাল রিগ্রেশন সিনড্রোম নামে এক বিরল রোগে আক্রান্ত হন গনিম। যার ফলে ভ্রূণ থেকে পরিপূর্ণ মানবশিশু গঠনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে তার শরীরের নীচের অংশের গঠন অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। শরীরের নিম্নাংশ ছাড়াই তিনি ২০০২ সালের ৫ মে জন্মগ্রহণ করেন।
যদিও এই রোগ সম্পর্কে জানার পর তার জন্মের আগেই প্রায় বেশিরভাগ মানুষ তাকে গর্ভাবস্থায় মেরে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার বাবা-মা নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থেকে সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছেন এবং সর্বদা তার পাশে থাকার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন।
এমন শারীরিক অপূর্ণতাসম্পন্ন মানুষটি হুইল চেয়ারকে তার জীবনের সঙ্গী করে তুলবেন এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন যে সৃষ্টিকর্তা তাকে কী কী দেননি সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে বরং তাকে যা যা দিয়েছেন সেগুলোরই সদ্ব্যবহার করা উচিৎ। আর তাই তিনি শুরু থেকেই নিজের দুই হাতের ওপর ভর করে চলাফেরা করতেন।
ছোটবেলা থেকেই তিনি অদম্য সাহস আর মনোবল নিয়ে জীবনযুদ্ধে লড়াই করা এক সৈনিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। তাকে যখন স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল, সহপাঠীদের তিরষ্কার ও লাঞ্চনার কারণে তিনি একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে তার মা তাকে বুঝিয়েছিলেন এবং সাহস জুগিয়েছিলেন।
সময়ের সাথে সাথে তিনি মানুষকে তার অবস্থার কথা বোঝাতে লাগলেন এবং সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করে যেতে থাকলেন। বর্তমানে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়নরত।
গনিম ফুটবল খেলতে পছন্দ করেন। তার শারীরিক জটিলতা সত্ত্বেও তিনি স্কুবা ডাইভিং, স্কেট বোর্ডিং এবং রক ক্লাইম্বিং-এ অংশ নিয়ে থাকেন এবং বেশ উপভোগ করেন। তিনি গাড়িও চালাতে পারদর্শী।
আরব বিশ্বে মুফতাহ একজন জনপ্রিয় মোটিভেশনাল স্পিকার ও ইউটিউবার। কিন্তু এর পাশাপাশি তার আরও একটা পরিচয় আছে। তিনি একজন উদ্যোক্তা। ঘারিসা আইসক্রিম নামে তার একটি নিজস্ব আইসক্রিম ফ্যাক্টরিও বিদ্যমান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ফলোয়ার সংখ্যা লক্ষাধিক। তিনি পুরো বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও জীবনে সফল হওয়া যায়। তার মতে, ইতিবাচকতা, বিশ্বাস, প্রতিশ্রুতি, নেতৃত্ব ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।
গনিম তার শারীরিক অনেক জটিলতাকে জয় করতে পারলেও, নিয়মিত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে হয় তাকে এবং বিভিন্ন সার্জারির মধ্য দিয়ে সুস্থ থাকতে হয়।
পরিশেষে, কাতার বিশ্বকাপটি ইতিহাস হয়ে থাকবে কয়েকটি কারণে। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো একজন কৃষ্ণাঙ্গ ও একজন শারীরিক প্রতিবন্ধীকে দিয়েই বিশ্বকাপ উদ্বোধন করা।
এনএস//