ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৮ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ২২ ১৪৩১

ওদের ভিটামিন ডি খাওয়া

রুহুল আমিন বাচ্চু

প্রকাশিত : ০১:১৭ পিএম, ৫ ডিসেম্বর ২০২২ সোমবার | আপডেট: ০৩:৫৫ পিএম, ৫ ডিসেম্বর ২০২২ সোমবার

সকাল বেলায় দাদুর কোলে চড়ে ইজান পুকুর পাড়ে যায়। সুহা, শাহানও নানার পিছু পিছু। পুকুরের ঘাটলায় দাদু ইজানকে কোলে নিয়ে বসে পড়েন। সুহা একটা মাটির ঢেলা তুলে পুকুরের পানিতে ছুড়ে মারে, দেখাদেখি শাহানও। ঢুপ শব্দ তোলে ঢেলা দুটি পানির নিচে তলিয়ে যায়। ঢেলা পড়ার স্থানে দুটি ঢেউ গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। একটু পরেই ঢেউগুলো মিলে যায়। 

সুহা আর শাহান হাততালি দেয়, ইজানও ওদের দেখাদেখি হাততালি দিয়ে দাদুর কোল ছেড়ে মাটিতে লাফাতে থাকে।

ওরা কেউ দাদু বাড়ি, কেউ নানু বাড়ি, এসেছে দুই দিন আগে। পরীক্ষা শেষে ওদের স্কুল ছুটি দুই সপ্তাহের জন্য। সাথে ওদের বাবা-মা এসেছেন। 

দাদু বাড়ির অনেকের সাথে দেখা হয়েছে,  আলাপ হয়েছে। বড়রা ওদের আদর করছে মাথায় হাত দিয়ে, ছোটরাও বন্ধুত্ব পাতার জন্য সুযোগ খুঁজছে। খুবই মজার মজার সময় কাটছে ওদের। গাছ-গাছালিতে ভরা দাদু বাড়ি। সবজিখেত, ধানখেত দেখা যাচ্ছে উঠোন থেকেই। সুহা পুকুর পাড়ে জোড়া তালগাছ দেখে আবৃত্তি করছে, ‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ, ঐ আমাদের গাঁ....’

এবার নিজে নিজেই বলে, ‘না-না হয়নি।’ পুকুরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সঠান হয়ে, তারপর বলে, ‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ, লিখেছেন কবি খান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন।’ এবার শাহানও তার সাথে যোগ দেয়, দু’জনে এক সাথে আবৃত্তি করে। আবৃত্তি শেষ হলে নানা হাততালি দেয় সাথে সাথে বাড়ির ছোট্ট শিশুরাও জড়ো হয়ে হাততালি দেয়। ওরা পেছন ফিরে অবাক হয়ে নিজেরাও হাততালি যোগ করে।

নানা তালি দেয়া শেষ করে বলেন, ‘ঠিক করেছে সুহামনি, আবৃত্তির আগে কবির নামটি বলতে হয়।’

সকালে নানা ঘরের সামনের পেঁপে গাছ থেকে দু’টি পাকা পেঁপে পেড়েছেন। পাকা পেঁপে সুহার দারুণ পছন্দ, শাহানও পছন্দ করে তবে চামচ দিয়ে কেটে দিলে একটু একটু খায়। ইজানতো খাওয়ার আগেই লোল ফেলে দেয়। এ নিয়ে দাদির কি হাসাহাসি। দাদু  পুকুরঘাট থেকে ডাকেন ‘কালু কালু’ বলে। কালু পুরান বাড়ির ছেলে। এ বাড়িতে দাদুকে এটা-ওটা কাজে সাহায্য করে, বাজার থেকে সদাইপাতি এনে দেয়।

কালু ‘জে’ বলে উচ্চস্বরে জবাব দেয় দাদু বলেন, ‘শীতলপাটিটা নিয়ে আয়-’

সুহা প্রশ্ন করে, ‘নানা, শীতলপাটি কি?’

‘আনলেই দেখতে পাবে। মোশতাকের বেত্তা দিয়ে গ্রামের বউ-ঝিরা অবসর সময়ে বসে বসে বানায়। এখন তোমাদের নানা তোমাদের একটা আল্লাহর নিয়ামত খাওয়াবে, শাহান চিৎকার করে বলে নানা আমিও খাব। ইজান লাফিয়ে বলে, ‘আমিও খাব দাদু।’

সুহা প্রশ্ন করে, ‘এখানে পুকুর পাড়ে কি খাওয়াবে দাদু, শীতলপাটি?’

হ্যাঁ, বলে দাদু হাসতে থাকেন। বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়েরা জড়ো হয়ে হাসতে হাসতে বলে, ‘শীতলপাটি খাবে ওরা। কি দারুণ মজা তাই না সুহার বয়েসী তাহেরা বলে, ‘শীতলপাটি খায় না ওতে বসা যায়।’ কালু গোল করে বাঁধা একটা শীতলপাটি নিয়ে আসে। নানা বলেন, ‘ওখানে বিছিয়ে দে।’

কালু ঘাসের ওপর শীতলপাটি বিছিয়ে দেয়। নানা বলেন, ‘দেখ দেখ ঘাসের সবুজ কার্পেটের ওপর বিছানো শীতলপাটিতে আমরা এখন বসবো।’

সুহা বসতে বসতে বলে, ‘দাদু বলো না আল্লাহর কি নেয়ামত খাওয়াবে?’

ইজান দাদুর গলা ধরে বলে‘ ‘দাদু আমিও খাব।’  

দাদু বলেন, ‘তোমরা সবাই খাবে। এখন শীতলপাটিতে বসে পড়। দেখছ না কি সুন্দর সূর্যের আলো ছিটিয়ে পড়েছে পাটিতে। এবার সূর্যালোর ভিটামিন ডি খাও, হাসতে হাসতে বলেন।’

‘তাই দাদু, আমার পরিবেশ বিজ্ঞান বইতে ভিটামিন ডি ও সূর্যের আলোর চ্যাপ্টার আছে। ভিটামিন ডি শরীরের জন্য উপকারী। আমাদের শরীরে যে সকল ভিটামিন দরকার তার মধ্যে ভিটামিন ডি প্রথম সারিতে। ভিটামিন ডি ক্যালাসিয়ামের পরিমাণ বাড়ায়, চোখের সমস্যা, শরীরের পেশীর সমস্যা দূর করে।’

‘এবার বুঝেছ তোমরা? সূর্যের আলো যেমন আমাদের জন্য উপকারী তেমনি গাছ-গাছালির জন্যও। ইজানকে আদর করতে করতে নানা বলেন, ‘এটা আল্লাহর অপূর্ব এক নেয়ামত।’

সুহা পুকুরের পানিতে তাকিয়ে দেখে এক ঝাঁক মাছ থুঁতনি উঁচু করে খাবি খাচ্ছে। ও চিৎকার করে বলে ‘নানা, নানা কত কত মাছ। ওরা এমন করছে কেন?’

শাহানও পুকুর পাড়ে এগিয়ে যায়, বলে, ‘নানা আমিও দেখেছি। কতো কতো মাছ, বড় বড় মাছ। নানা আমি মাছ ধরবো।’ নানা বলেন, ‘ঠিক আছে। কাল সকালে জেলে আসবে বলে দিয়েছি। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবে কিন্তু।’ 

সুহা প্রশ্ন করে, ‘নানা ওরা মুখ ভাসিয়ে এমন করছে কেন? মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়? তাই না শাহান?’ দাদু বল্লেন, ‘তোমরাতো বেড়াতে এসেছো, তোমাদের দেখতে চায় ওরাও দাদু হেসে এবার বলেন, শোন তোমাদের জানতে হবে, দাদুমনিরা, পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে ওরা ভেসে ওঠে, বাতাস থেকে অক্সিজেন ধার করে।’

সুহা বলে ‘হ্যাঁ নানা আমি জানি অক্সিজেন ছাড়া কোনো প্রাণী বাঁচতে পারে না।’

‘আচ্ছা তোমরা বলতো পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা জিনিস কোন্টি? এবং সবচেয়ে দরকারিও...’

শাহান চট্ করে হাত তুলে জবাব দেয়, ‘নানা, আমি জানি, সুহা একটু ভেবে বলে, ‘পানি?’

ইজান কিছু বলতে না পেরে শুধু বলে, ‘আমি পালি, আমি পালি-’

নানা এবার ওদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘দেখ দেখ তিনটে শালিক ঘাসের ওপর কি যেন খুঁজছে আসলে ওরা খুঁজছে পোকা মাকড়, ফড়িং জাতীয় খাবার। ঐ দেখ একটা দোয়েল আমগাছে বসে শীষ দিচ্ছে, মানে ওর সাথীকে ডাকছে। তোমরা হাত নাড়াচাড়া করবে না, তাহলে উড়ে যাবে।’

এবার শোন, ‘সবচেয়ে সস্তা জিনিস হলো বাতাস। যা ছাড়া আমরা এক মুহ‚র্ত বাঁচতে পারি না। বাতাসের অক্সিজেন আমাদের নাক দিয়ে ফুসফুসে চলে যায়। ফুসফুস রক্ত পরিশোধন করে। আমাদের হার্টে পাঠায় হার্ট পাম্প করে সারা শরীরে সঞ্চালন করে তা না হলে আমরা বাঁচতে পারতাম না। জানতো কোনো প্রাণীই অক্সিজেন ছাড়া বাঁচে না।’

‘অথচ, আমরা দম নেই হিসেব করে। জোরে জোরে দম নাও। শরীর ফুরফুরে হয়ে যাবে। আর এই অক্সিজেন পাই আমরা গাছ-গাছালি থেকে। গাছ-গাছালি বাংলাদেশের প্রতিটি গাঁয়ের সজীব-সবুজ অলংকার। বলতে পার অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। তোমরা শহরে থাক গাছ-গাছালি ক’টা দেখছ? খালি দালান আর দালান। আর আমাদের গাঁয়ে দেখছ গাছ-গাছালি আর সবুজে সবুজে ভরা। আমাদের গাঁয়ের অক্সিজেন ফ্যাক্টরির অক্সিজেন দিয়েই তোমরা শহরের মানুষ বেঁচে আছ। তাই নয়কি! এ সবই আল্লাহর নিয়ামত। আমরা এখানে পুকুর পাড়ে বসে আছি, চারদিকে অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। ধরে নাও ধুলা-ময়লা পুকুরের পানিতে ফিল্টার হয়ে আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করছে নাক দিয়ে। কি বল- লম্বা করে দম নাও সবাই।’

শাহান নানার দেখাদেখি লম্বা করে দম নিতে নিতে দু’তিনটা কাশি দিয়ে ফেলে। শাহান ডান হাত মুখে চেপে ধরে। নানা হাসতে হাসতে বলেন, ‘কেশে যাও, অসুবিধা নাই।’

এএইচ