ঢাকা, বুধবার   ০৯ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ২৩ ১৪৩১

ইজানকে খুঁজে পাওরা যাচ্ছে না

রুহুল আমিন বাচ্চু

প্রকাশিত : ০৪:০০ পিএম, ১০ ডিসেম্বর ২০২২ শনিবার

ইজানকে মা খুঁজে পাচ্ছেন না। কোথায় গেল সে! ওর মা বলছেন, একটু আগেও বইয়ের পাতা ওল্টিয়ে ছবি দেখছিল ড্রইংরুমে বসে। মা রান্নাঘরে গেল মিনিট পাঁচেক হবে। ইজান ঘরে নেই শুনে ওর দাদি অস্থির হয়ে খুঁজছেন আলমারি, আলনা, সোফার পাশে, নিচে, নেই কোথাও নেই। দোতলায় খুঁজে শেষে দাদি নিচতলায় খুঁজছেন, রান্নাঘর তারপর ড্রইংরুমে। বাথরুমগুলোও খোঁজা শেষ।

ওর বয়স সবে তিন বছর। কুট কুট করে হাঁটে, আবার দৌড়ায়, মার সাথে খাবার সময় লুকোচুরি খেলে। মা বলেছেন, আগামী বছর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবেন। 

দাদুর এক কথা আমার নাতির মাথায় লেখাপড়ার কোন বোঝা চাপিয়ে দিবে না। ও ভালো করে কথা বলা শিখুক, বইয়ের ছবি দেখে হরফগুলো শিখে নিক। কোন রুটিন নয়, লেখাপড়ার কোন চাপ নয়। হাঁটতে খেলতে যা পারে তাই। এখন গ্রামে এসেছে আমি ওকে প্রকৃতির নানান কিছু যেমন গাছ-পালা, পাখ-পাখালি, ফুল-ফলাদি দেখাবো আর নাম শিখাবো। ছয় বছর না হলে ওর কাঁধে কোন স্কুল ব্যাগ চাপাবে না। ইজানের বাবারও সেই একই কথা।

মার কথা প্লে গ্রুপে পড়বে। প্লে মানে তো খেলা করা। এখুনি স্কুলে ভর্তি না হলে পিছিয়ে পড়বে। দাদা এসব মানতে রাজি না, প্লে হোক আর নার্সারি হোক বইয়ের বোঝাতো টানতে হয়; ওসব চলবে না। কোনো রুটিনের বেড়াজালে ওকে ফেলবে না। ওর এখন খেলাধুলার বয়স, চাপমুক্ত থাকবে, প্রকৃতির কাছ থেকে যা শিখার শিখবে।

ইজানের দাদি সকাল সকাল নাশতা বানিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বসেন তারপর আল্লাহ, লাইলাহা ইল্লালাহ্ শিখিয়ে খুব খুশি। শীতের রোদ যখন কুয়াশা ভেদ করে ঘাসের ওপর চিক চিক করে ওঠে তখন দাদার সাথে বের হয়। 

দাদি একটু এগিয়ে দিয়ে ‘ফি আমানিল্লাহ্’ বলে কপালে একটা চুমু খেয়ে নেন। দাদার হাত ধরে পূর্বের আড়া, পুকুরঘাট হেঁটে ঘরে ফিরে নাশ্তা খায় মায়ের হাতে। আজ সকালেও ইজান দাদির কোলে ঢুলে ঢুলে দোয়া শিখে ড্রইং রুমের দিকে যায়। দাদি পূবের আড়ার মাচা থেকে একটা কচি লাউ আর লাউশাক আনতে ইজানের দাদুর হাতে কাঁচিটা ধরিয়ে দেন। লাউ দিয়ে রুইমাছের মাথা আর লাউ শাক দিয়ে শোল মাছ রাঁধবেন। ইজানের আব্বুর খুব পছন্দের খাবার। 

ইজানকে ঘরে না পেয়ে দাদি ছুটে যান ঘরের পিছনে। দাদুর সাথে ও প্রতিদিন সেখানে যায় কখনো লাল শাক তুলে, কখনো ধনিয়া পাতা, কখনো মুলা তুলে নিয়ে আসে দাদা নাতি। ইজানের আম্মুর চিৎকার শোনা যায়, ‘মা-মা পেয়েছেন ওকে!’ জবাব না পেয়ে ‘ইজান, ইজান’ বলে মা নিজেই ঘরের বের হয়। ইজানের দাদি এদিক-সেদিক তাকিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসেন।

ইজানের বাবা গেছেন তাদের পুরান বাড়িতে। তার চাচা ইউসুফ ক’দিন থেকে অসুস্থ। দাদি বলেছেন ‘দেখে এসো অবস্থা ভালো না। প্রায়ই তোমাদের কথা জিজ্ঞাসা করেন। তোমাকে দেখলে হয়তো ভালো বোধ করবেন। তাছাড়া রোগী দেখা সওয়াবের কাজ।’

ইজানের দাদি হঠাৎ উদভ্রান্তের মতো ফিরে আসেন। ঘরের পশ্চিম পাড় ঘেঁষে পুকুর। আল্লাহ্ আল্লাহ্ বলে তিনি পুকুর পাড়ে কলামূড়ার দিকে তাকান। একটা নারকেল গাছের পাতা ভেঙে পড়ে আছে, তিনি তা সরিয়ে পুকুরের পাড়ে চোখ রেখে গভীর দৃষ্টি দিয়ে খুঁজছেন।

আবার ছুটে যাচ্ছেন অন্যদিকে। সারি সারি সুপারি গাছের চারার আড়াল পেরিয়ে ‘লাইলাহা ইল্লা আন্তা ছোবহানাকা’ বলতে বলতে পুকুরের হাঁটু পানিতে নেমে পড়েছেন। ইজানের আম্মুও কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসেছে পুকুরপাড়ে। আবার দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে মোবাইল এনে ইজানের আব্বুকে কল দিচ্ছে। বার বার মোবাইলে এনগেজড পেয়ে এবার হাউ-মাউ করে কেঁদে বসে পড়েছে ঘাসের ওপর।

দাদি পুকুরের পূর্বপাড় প্রায় খুঁজে ফেলেছেন। মাঘ মাসের সকালের শীতে তাঁর শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে। তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তার হাত-পা কাঁপছে। থির থির করে থুতনি কাঁপছে, কথা বলতে পারছেন না। 

কালুকে দেখা গেল পুকুরের পশ্চিমপাড়ে ঝাকি জাল ফেলেছে। ইজানের দাদি কালু কালু বলে ভাঙাস্বরে তাকে ডাকছেন। কালু শুনতে পাচ্ছে না। দাদি এবার আর্তচিৎকার দিয়ে কালুরে বলে ডাক দিতেই কালুর চোখ পড়ে পূর্বপাড়ে হাঁটুজলে নামা দাদিকে। কালু দ্রুত জাল ফেলে দৌড়ে আসে দাদির কাছে।

ইজানের আম্মু কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ইজানকে পাওয়া যাচ্ছে না-তুই দেখেছিস্্? ওর বাবার সাথে গিয়েছে?’

‘না-কাকাতো একাই ও বাড়িতে গেছে, আমি ও কাকার সাথে ছিলাম। কাকা আমাকে বল্লেন, যা পুকুরে জাল ফেলে কিছু কাঁচকি মাছ....’

দাদি চিৎকার করে বলেন, ‘কালু পানিতে নেমে যা, তাড়াতাড়ি কর। আমার দাদুর কি হলোরে- ইয়া আল্লাহ্ তুমি দয়ার সাগর, তুমি রহমানুর রাহিম। দয়া করো আমার দাদু....’। আর বলতে পারছেন না তিনি। ইজানের দাদির গলার স্বর ভেঙে গেছে, মাথা নুইয়ে তিনি বসে পড়েন।

ইজানের আম্মু মোবাইলে লাইন পেয়ে যায়। কিন্তু কান্নার জন্য কিছুই বলতে পারছেন না। ইজান, ইজান বলে কান্নার ঢেউ ছড়িয়ে দিচ্ছেন শুধু।

কালু কোমর পানিতে নেমে হেঁটে হেঁটে আবার হাত দিয়ে এদিক-ওদিক খুঁজে ফিরছে। কিন্তু সে হতাশ এবং আতংকগ্রস্ত।

ইজানের আব্বু ছুটে আসে পুরাতন বাড়ি থেকে তার পেছন পেছন ছুটে আসছে ফরিদুল আর বাবুল। ওরা খবরটা শুনেই নেমে যায় পানিতে। কালু এবার উপরে উঠে এসে পশ্চিম পাড়ে রেখে আসা ঝাকি জালটা নিয়ে দ্রুত ফিরে যায়। ফরিদুলের পরামর্শ মতো জাল ফেলে আল্লাহ্র নাম নিয়ে রশি ধরে টানতে থাকে।

কালুর জালের রশিতে টান টান উত্তেজনা, এরিমধ্যে ভারী কিছু আটকা পড়েছে তার মনে হয়। ফরিদুল ওর দিকে তাকিয়ে ওর চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করে। দু’জনেই জালের মাঝখানে ডুব দিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছে। ফরিদুল ডুব মেরে দীর্ঘক্ষণ পানির নীচে।

ইজানের আব্বুও পরনের কাপড় না বদলিয়ে পানিতে নেমে গেছে এরিমধ্যে। পুকুর পাড়ে রেনট্রির মগডালে বসে একটা কুরুয়া কু-আ-আ-আ চিৎকার দিতে থাকে। বাড়ির কালা আর ধলা কুকুর দু’টা ঘে উউউ ডাক ছাড়ছে।

ইজানের দাদি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি হিস্ হিস্ করে হাঁক ডাকছেন। বুঝতে পারছেন না তিনি কি অপয়া কুকুরের ডাক তাড়াচ্ছেন না কুরুয়াকে। ইজানের আম্মু-আমার ইজান আমার ইজান বলে হুঁশ হারিয়ে ফেলেছে। ফরিদুলের স্ত্রী ছুটে এসে ইজানের আম্মুকে ধরে বসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কারো সাহায্য চাইছেন।

পুকুরের পশ্চিম পাড়ে দেখা যাচ্ছে মাহমুদ দৌড়ে আসছে তার পেছন পেছন জেলে অধীরের দল জাল কাঁধে নিয়ে ছুটে আসছে। বোঝাই যাচ্ছে এ খবর চতুর্দিক ছড়িয়ে পড়েছে। 

অধীরের জাল ফেলে ওরা ইজানকে খুঁজবে- উদ্দেশ্য পরিষ্কার। ফরিদুল প্রায় দেড় মিনিট পর একবার ভেসে ওঠে। লম্বা দম নিয়ে গো-গো করে কি বলে আবার ডুব দেয়। উপস্থিত সকলের মনে আতঙ্ক মেঘের ছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে।

‘আমার দাদু, আমার দাদু’ বলে ইজানের দাদি মাটিতে হাত চাপড়াতে চাপড়াতে উচ্চস্বরে কাঁদছেন।
মাহমুদ জেলে অধীরের দলকে পুকুরের পূর্ব পাড়ে জাল ফেলার নির্দেশ দিয়ে নিজেও পানিতে নেমে পড়ে।

ফরিদুল আবার ভেসে ওঠে তার সাথে কালু। দু’জনে মিলে ঝাকি জালের একটা অংশ টেনে কিছু একটা বের করার চেষ্টা করছে। পানির গভীরতায় ওদের সাঁতারে ভেসে থাকাটা কষ্টকর হচ্ছে। সবার দৃষ্টি ফরিদুল আর কালুর প্যাঁচানো জালের বস্তুর দিকে। শেষাবধি ওরা বের করে আনে একটা সুপারি গাছের গুড়ি।

‘আল্লাহ্ আল্লাহ্’ বলে দাদি দু’হাত তুলে মোনাজাত দিচ্ছেন। ইজানের আম্মুর মুখে পানি ছিটা দিতেই হুঁশ ফিরে আসে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমার ইজান, আমার ইজান বলে আবার ঢলে পড়ে ফরিদুলের বৌয়ের কোলে।

সারা বাড়ির ছেলে-মেয়ে বৌ-ঝি সবাই পুকুর পাড়ে জড়ো হয়েছে। বউ-ঝিরা মুখে কাপড়ের আঁচল কামড়ে দম বন্ধ করে আছে। ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েদের মুখে রা নেই। কুকুরগুলো তখনো কবরস্থানের পাশে বাগানে ঘে উ-উ-উ ডাকে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে যেন।

হঠাৎ দেখা যায় পূবের আড়া থেকে ফিরে আসছেন ইজানের দাদা। হাতে একটা লাউ আর লাউপাতার কুন্ডুলী। রাস্তার মোড় পার হলেই দেখা যায় তাঁর পেছনে পূবের বাড়ির মানিক তার কোলে একটা ছাগলের বাচ্চা। দু’জনের মাঝখানে ইজান হেঁটে আসছে। এরিমধ্যে কুকুরের ঘে-উ-উ-ডাক থেমে গেছে, কালা-আর ধলা দাদুর পায়ের কাছে ছুটে এসে কু, ক্যাঁ করছে। ইজানকে দেখে মাহমুদের ছেলে সিয়াম চিৎকার করে উঠে। ঐ যে ইজান আসছে, ইজান আসছে। তার চিৎকার শুনে সবাই তাকায় রাস্তার পূর্ব দিকে। ইজানের দাদা তখনো বুঝতে পারেননি কি হচ্ছে সেখানে। অধীদের জাল দেখে তিনি ভাবলেন পুকুরে মাছ ধরার জন্য জাল ফেলার প্রস্তুতি।

ইজানের দাদি ছুটে গিয়ে তাকে কোলে তুলে চুমো খেতে থাকে। ‘দাদুরে দাদু আমার, তুই কোথায় ছিলিরে দাদু! তিনি কাঁদতে থাকেন ভাঙা গলায়।

পরিস্থিতি শান্ত হলে দাদাই সবার চোখে মুখে উদ্ভাসিত প্রশ্নের জবাব দেন। ‘আমি তো গেলাম পূবের আড়ায়, লাউ আর লাউপাতা আনতে। একটু পর দেখি মানিকের ছাগল ছানাটির পেছন পেছন ছুটছে ইজান। ছাগল ছানাটি কি আর ধরা দেয়। ওটা তিরিং বিরিং নাচতে নাচতে একদম পূবের আড়ায় লাউ মাচার নিচে। ছানাটির মা পাশেই বাঁধা ছিল। আমি তো অবাক, ভাবলাম তোমরা কেউ আমার পেছনে ইজানকে দিয়ে গেছ।  আমার কাজতো শেষ কখন, কিন্ত ও তো ছাগল ছানা না নিয়ে কিছুতেই ফিরবে না। পরে মানিককে ডেকে নিলাম।’

দাদা আল্লাহ্ শোকর গুজার করে বল্লেন, ‘আল্লাহ্ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। কইরে কালু, ফরিদ বাবুলের মূড়া থেকে তিনটা বাঁশ কেটে নিয়ে আয়। এক্ষুনি পুকুর পাড়ে বেড়া দিতে হবে।’

এএইচ