ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

বিজয়ের ৫১ বছরেও অবহেলিত বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের স্মৃতিস্তম্ভ 

জামাল হোসেন, বেনাপোল থেকে

প্রকাশিত : ১০:০০ এএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২ শুক্রবার

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘বীর শ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। 

স্বাধীনতার ৫১ বছরেও সংস্কার হয়নি যশোরের শার্শার কাশিপুর সীমান্তে ঘুমিয়ে থাকা শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদসহ আরও ছয় শহীদের স্মৃতিসৌধ।

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের মহেশখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম আমানত শেখ। নূর মোহাম্মদ শেখ ১৯৫৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) যোগ দেন। বর্তমানে যা ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ (বিজিবি) নামে প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘদিন দিনাজপুর সীমান্তে চাকরি করে ১৯৭০ সালের ১০ জুলাই যশোর সেক্টরে বদলি হন। পরে নূর মোহাম্মদ ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি পান।

১৯৭১ সালে যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে যশোরের শার্শা থানার কাশিপুর সীমান্তের বয়রা অঞ্চলে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতৃত্বে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন তিনি। ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যশোরের গোয়ালহাটি ও ছুটিপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে নূর মোহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেন। 
উপজেলার ডিহি ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামে তাকে সমাহিত করা হয়।

স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের স্মৃতিস্তম্ভ সংরক্ষণ হয়নি। এই বীরশ্রেষ্ঠ ছাড়াও এখানে শায়িত আছেন শহীদ আব্দুল আহাদ, শহীদ সুবেদার মনিরুজ্জামান (প্রাক্তন ইপিআর), শহীদ সৈয়দ আতর আলী (তদানিন্তন গণপরিষদ সদস্য), শহীদ বাহাদুর আলী, শহীদ সিপাহী আব্দুস ছাত্তার বীরবিক্রম (প্রাক্তন ইপিআর) ও শহীদ সিপাহী এনামুল হক বীরপ্রতীক (প্রাক্তন ইপিআর)।

বিশেষ কোনো দিবস ছাড়া স্মৃতিস্তম্ভটি সারা বছরই অযত্ন-অবহেলায় থাকে। এখানে নেই কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী। অতিথিদের বসার বা বিশ্রাম করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই এখানে। যার ফলে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিদিন দেখতে আসা শিক্ষার্থীসহ দর্শনার্থীদের অভিযোগের শেষ নেই। 

আগামীর প্রজন্ম বাংলাদেশের ৭১-এর ইতিহাস জানবে বা ঐতিহ্য ধরে রাখবে এই ধরনের পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করলেও সেটার দৃশ্য বা নমুনা এখানে নেই।

স্মৃতিসৌধের চারদিকে বনজঙ্গলে ভরে গেছে, স্মৃতি সৌধের একপাশ দিয়ে রাস্তা হওয়ার কথা থাকলেও স্মৃতিসৌধের মধ্য দিয়ে সবাই অনায়াসে যাতায়াত করছে। গরুর গাড়ি, ট্রলি, ভ্যান, সাইকেল, গরু-ছাগল ইত্যাদি সবই যাওয়া আসা করছে। 

নিহতের স্বজনরাসহ দূরদূরান্ত থেকে অনেক পর্যটক আসেন এখানে। তাদের থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো বাথরুম। অডিটোরিয়াম, ক্লিনিক করার কথা থাকলেও কিছুই হয়নি।

তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের স্মৃতিসৌধ সংস্করণসহ উন্নয়নের আশ্বাস দিয়েছেন।

দর্শনার্থী ও স্থানীয়দের দাবি, শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের স্মৃতিস্তম্ভ বিশেষ কোনো দিবস ছাড়া সারাবছরই অযত্ন-অবহেলায় থাকে। বসার বা বিশ্রামের করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। এছাড়াও শিশুসহ শিক্ষার্থীদের জন্য এখানেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক কিছু বিষয়ে তুলে ধরার ব্যবস্থা গ্রহণ করে ক্ষুদ্র জাদুঘর নির্মাণের দাবি জানান অনেকে। 

তাছাড়া বীরশ্রেষ্ঠের এ সমাধি স্থানটির মাঝখান দিয়েই চলে গেছে পাকা পিচের সড়ক। সেই সড়কটি বিকল্প পাশ দিয়ে নির্মাণ করে সমাধি স্থানটির সৌন্দর্য বাড়াতেও দাবি জানান অনেকেই। 

স্মৃতিসৌধে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থী মিনানুর রহমান জানান, বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের নানা পটভূমি পড়েছি। ইতিহাসে বীরশ্রেষ্ঠের নাম শুনেছি। কিন্তু তাদের সমাহিত করার স্থানটি (স্মৃতিসৌধ) যে এভাবে থাকবে কখনোই আশা করিনি। এখানে এসে ভেবেছিলাম হয়তো মৃক্তিযুদ্ধের নানা বিষয়ে ধারণাটা বাড়বে। কিন্তু এখানে সেই ধরনের কিছুই নেই। এখানে জাদুঘর নির্মাণের দাবি জানায় তিনি। 

স্মৃতিস্তম্ভটি সংরক্ষণের বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য (ওয়ার্ডের মেম্বার) সিদ্দীক জামান লাল্টু বলেন, কয়েকটি দপ্তরে স্মৃতিসৌধ স্থানটি পূর্ণ সংরক্ষণ করার আবেদন করা হয়েছে। দ্রুত আধুনিকভাবে স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ প্রয়োজন।

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কওমি মাদ্রাসা ও এতিমখানার সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ আশাদুল ইসলাম বলেন, শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের স্মৃতিসৌধ অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। এখানে বিজিবিসহ উপজেলা প্রশাসন বছরের বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠান করে থাকেন। তবুও কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি স্মৃতিসৌধে। 

স্থানীয় ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুর ইসলাম মল্লিক জানান, স্মৃতিসৌধ স্থানটির পরিবেশ উন্নয়নের প্রয়োজন। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসলে বিশ্রাম নেওয়া দূরে থাক বসার জায়গাটাও এখানে নেই। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে দ্রুত এই স্মৃতিস্তম্ভসহ জায়গা সরকারের সংরক্ষণের প্রয়োজন বলে মনে করছি।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নারায়ণ চন্দ্র পাল বলেন, কাশিপুর বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের স্মৃতিসৌধে স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দাবিতে একটা ওয়াশরুম করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে এবং অচিরেই এটার কাজ শুরু হবে। সে ব্যাপারে আমরা ডিজাইন অনুমোদন দিয়েছি। 

এছাড়া স্মৃতিসৌধটি রক্ষণাবেক্ষণ করার বিষয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) এর সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান নির্বাহী কর্মকর্তা।

এএইচ