ঢাকা, বুধবার   ০৯ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ২৪ ১৪৩১

‘সবুজ লাল বৃত্তের পতাকা ৭১-এ প্রথম উত্তোলিত হয় এনায়েতপুরে’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৭:৩৮ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২ শুক্রবার

মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন সকালে সবুজের মাঝে বৃত্ত লাল পতাকা প্রথম তোলা হয় সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে। লাল-সবুজ পতাকা স্বাধীনের মাস খানেক পরে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির আগেই তৎকালীন এনায়েতপুর ইসলামীয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আবেগ তাড়িত হয়ে ভুল করে উত্তোলিত হয়। প্রথম উত্তোলন করা এ পতাকাই পরবর্তীকালে জাতীয় পতাকার মর্যাদা পায়।

এলাকার এক তাঁতীর বাড়ি থেকে আনা সবুজ লুঙ্গি কেটে এবং লাল সালু কাপড় দিয়ে মাঝখানে মানচিত্রহীনভাবে বৃত্তকার গোল কাপড় লাগিয়ে তৈরি করা পতাকাটি দেশের মধ্যে উত্তোলিত প্রথম জাতীয় পতাকা বলে দাবি করেছেন সেই পতাকা উত্তোলনের সাথে জড়িত বীর মুক্তিযোদ্ধা চলচিত্র নির্মাতা দেওয়ান নজরুল ইসলাম সহ তার সহযোগি এবং এলাকাবাসী। তারা দাবি তুলেছেন ইতিহাসের এ স্থানটিতে স্মৃতি সংরক্ষণের।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশকে পাকিস্থানের পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করতে ১৯৭১ সালে সিরাজগঞ্জের চৌহালী-এনায়েতপুরের কৃষক-তাঁতীদের প্রতিরোধ যুদ্ধ গুলো জেলার মধ্যে ছিল আলোচিত। মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি এলাকাবাসীর প্রতিরোধের ভুমিকা ছিল প্রশংসনীয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা এখানে রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন।

তেমনি এক বীর মুক্তিযোদ্ধা উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ ইউনিয়নের কৃষকগঞ্জ শ্রীবাড়ি গ্রামের প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা এবং গীতিকার দেওয়ান নজরুল (নজরুল ইসলাম)। তিনি জানান, যুদ্ধকালীন সময়ে পাক সেনা ও তাদের এ দেশিয় দোষররা বাঙালীদের উপর অমানবিক অত্যাচার করেছিল ও প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছে তা ধারন করেন চলচিত্রের প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক সিরাজগঞ্জের অরুন রায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জুলাই মাসের দিকে তার সহযোগী হিসেবে দেওয়ান নজরুল ভারতের শিলিগুড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ডকোমেন্টারী করতে সাথে যান। এরপর আগ্রহী হয়ে তিনিও স্বল্প সময়ে যুদ্ধ কৌশল রপ্ত করে নিজ এলাকায় ফিরে এসে তৎকালীন শাহজাদপুরের কমান্ডার সেরাজুল ইসলামের ৫২৯ নং দলে যোগ দেন ডিপুটি চিফ ইন কমান্ড হিসেবে।

দেওয়ান নজরুল জানান, তিনি এনায়েতপুরের খুকনী ক্যাম্প ও মালিপাড়া ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে শাহজাদপুরের কৈজুরীর টোপপাড়া, ধীতপুর, এনায়েতপুরের মালিপাড়ায় পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্বের সাথে অংশ নেন। তার সাথে মালিপাড়ার প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন মির্জা, গাজী মোজাম্মেল হক, রুহুল আমীন, বদিউজ্জামান, আব্দুল মতিন, ছাবেদ আলী, ফিরোজ ফেরদৌস, মাহবুবুল হক এসব যুদ্ধে অংশ নেন। এলাকা থেকে পাক সেনারা তাদের দোষরদের নিয়ে সব এলাকা থেকেই যখন পরাস্ত হতে থাকে তখন উল্লেখিত মুক্তিযোদ্ধারা ৭১-এর ১৫ ডিসেম্বর ছিল মালিপাড়া ক্যাম্পে। তখন হঠাৎ করে রাত ৮টার দিকে খবর আসে ক্যাম্পে আক্রোমন করবে পাকহানাদাররা। প্রতিহতের জন্য সবাই প্রস্তুতি নিয়ে ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এটি উড়ো খবর হিসেবে প্রকাশ পায়।

এরপর সকাল হলে চারিদিকে শোড়-গোল পড়ে যায় দেশ স্বাধীনের। মুহু-মুহু রাইফেলের গুলি ছুড়ে আনন্দে আত্বহারা হয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষেরা। তখন শাহজাদপুর এবং এনায়েতপুর অঞ্চলের কয়েকশ বীর সুর্য্য সন্তান সহ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সহদ্রাদিক মানুষ এনায়েতপুর ইসলামীয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে (বর্তমান খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের ইমারজেন্সী ফটক) এলাকায় সমবেত হতে থাকে।

এরপর খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রঃ) মাজার জিয়ারত শেষে বিজয় পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত হয়। এর দায়িত্ব পান দেওয়ান নজরুল, এনায়েতপুর প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি প্রয়াত করিম বাবু, পরিচালক প্রয়াত জাহাঙ্গির হোসেন, সদস্য হাজী সামচুল হক নুন্নু, প্রয়াত আব্দুল মজিদ শেখ। তখন আশপাশে কারো কাছে পতাকা ছিলনা। তারা গ্রামের তাঁতী আলাউদ্দিন দালালের বাড়ি থেকে গাঢ় সবুজ লুঙ্গী এনে এনায়েতপুর বাজারের দর্জি মিজানুর রহমানের দোকানে যান। সেখানে লাল-সালু কাপড় দিয়ে লাল গোল বৃত্ত কাটার জন্য চেষ্টা করেন। ৩/৪ বার কাটলে তা ৩ কোনা ৪ কোনা হয়।

এরপর পীর বাড়ি থেকে একটি স্যাংকি এনে কাপড়ের উপর চাপ দিয়ে গোল দাগ করে লাল সুর্য্য কাটা হয়। তা সেলাই করে তৈরী করা হয় লাল-সবুজ পতাকা। পতাকার জন্য কাপড়, পারিশ্রমিক ও লুঙ্গীর দাম নেননি তারা। পরে পতাকার মাঝখানে হলুদের মানচিত্র না দিয়েই আনা হয় অনুষ্ঠান স্থলে। এরপর অনুষ্ঠানে আসেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক পাকিস্থান জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল মোমিন তালুকদার।

এ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এনায়েতপুর মাজার শরীফের বর্তমান গদ্দিনশীন পীর খাজা কামাল উদ্দিন (নুহু মিয়া), আবুল কাশেম মাল, দেওয়ান নজরুল ইসলাম। এরপর পতাকা উত্তোলনের সময় বাধে বিপত্তি। পতাকার লাল বৃত্তের মধ্যে মানচিত্র খচিত না থাকায় উত্তোলন থামিয়ে দেন মোমিন তালুকদার। তিনি বলেন, এ পতাকা উত্তোলন করা যাবেনা। এসময় দেওয়ান নজরুল তার কথার জবাবে আবেগ তাড়িত হয়ে জোড় গলায় বলেন, আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমরা বাংলার মানচিত্রের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবোনা। মানচিত্র আরো বাড়তে পারে। আমাদের পরিচয় থাকবে সাড়া বিশ্বে। এখন আমরা পশ্চিম পাকিস্থান দখল করবো। তখন তার কথা শুনে অনেকটা অবাক হয়েই পতাকাটি উত্তোলন করা হয়।

এসময় অনেকে বলতে না পারলেও দেওয়ান নজরুল, মোমিন তালুকদার সহ কয়েকজন আমার সোনার বাংলা গান গাইতে থাকেন। আর এভাবেই দেশে প্রথম সবুজের মাঝে প্রথম লাল বৃত্ত পতাকা এনায়েতপুরে উত্তোলন করা হয়।

এ ব্যাপারে চলচিত্র নির্মাতা দেওয়ান নজরুল বলেন, আমাদের হঠাৎ উত্তোলিত পতাকার আদলে পতাকাটি ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারী জাতীয় পতাকা হবে কখনো কল্পনা করিনি। এজন্য আমি সহ এনায়েতপুরে পতাকা উত্তোলন করা সহস্রাধিক মানুষ কৃতজ্ঞ। আমরা বিজয়ে যেমন আত্বতৃপ্ত হয়েছি। তেমনী একই রকম পতাকা রাষ্ট্র পরে জাতীয় পতাকার মর্যাদা দেয়ায় আমাদের বীরত্বকে আরও উৎসাহিত করেছে। যা প্রতি পদে আমাকে নাড়া দেয়। এখানে অবশ্যই স্মৃতি সংরক্ষণ হওয়া উচিৎ।

এদিকে পতাকা তৈরীর সাথে জড়িত হাজী শামচুল হক নুন্নু, অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী মোজাম্মেল হক, গাজী রুহুল আমীন, জানান, এ ঘটনাটি আমাদের স্মৃতিতে অম্লান থাকবে চিরকাল। আমরাই প্রথম বৃত্ত লাল পতাকা উত্তোলন করেছি। অনেক দিন পরে হলেও বিষয়টি চির সত্য। আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক এ স্মৃতিটুকু যেন যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করা হয়। নতুন প্রজন্ম যেন জানতে পারে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করে এখানে প্রথম জাতীয় পতাকার আদলের পতাকা ভুল করে হলেও উঠেছিল।

এ ব্যাপারে এনায়েতপুরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব হামিদুল হক, একুশে ফোরামের সভাপতি আকতারুজ্জামান তালুকদার জানান, মুক্তিযুদ্ধ সমকালীন ইতিহাসকে আমরা যদি খুঁজে বের করে সংরক্ষন ও সম্মান জানাতে না পারি, তাহলে দেশ মাতৃকায় শহীদ ও বীর যোদ্ধাদের অসম্মান করা হবে। তাই এনায়েতপুরে প্রথম উত্তোলন করা সবুজ লুঙ্গি দিয়ে তৈরি লাল গোল বৃত্তের পতাকাটিও আমাদের জন্য ইতিহাস। এটা আমাদের সবার জন্য গৌরবের। আশা করবো পতাকা উত্তোলনকারীদের সাথে নিয়ে সরকার ইতিহাসের মর্যাদা রক্ষায় কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করুক।
কেআই//