গভীর সমুদ্রে শ্বাসরুদ্ধকর রাত কাটলো হাজারও পর্যটকের
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৮:০৬ পিএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২২ বুধবার
সেন্টমার্টিন থেকে কক্সবাজার আসার পথে গভীর সমুদ্রে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে রাত কাটিয়েছে অন্তত এক হাজারেরও বেশি পর্যটকের। এসময় গভীর সমুদ্রে পর্যটকদের কান্নার রুল পড়ে যায়। ভয়ে আতকে উঠে শিশু ও নারী পর্যটকরা।
জানা গেছে, সেন্টমার্টিন থেকে মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে তিনটায় ছেড়ে আসা পর্যটকবাহী জাহাজ এফভি বে-ওয়ান কক্সবাজারে পৌঁছেছে বুধবার সকাল সাড়ে ৬টায়। প্রায় সাড়ে ১৪ ঘন্টা গভীর সমুদ্রে অন্তত তিনটি জাহাজ বদলের পর সকালে কক্সবাজার উপকূলে পৌঁছে জানিয়েছেন শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতার কথা। যাত্রীদের অভিযোগ এফভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস এবং এফভি বার আউলিয়ার টিকেটের টাকা নিয়ে বে-ওয়ানে উঠানোর কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আসেন দিনাজপুর জেলার হাকিমপুরের মোহাম্মদ বিদ্যুৎ। তিনি জানান,‘গত সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোর সকালে এফভি বার আউলিয়া জাহাজের টিকেট কেটে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যান। এক রাত অবকাশ যাপনের পর মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সেন্টমার্টিন থেকে কক্সবাজারগামী এফভি বে-ওয়ানে উঠেন। ওইদিন রাত ৮টার মধ্যে কক্সবাজার পৌছার কথা থাকলেও তা আর সম্ভব হয়নি। কারণ, অতিরিক্ত যাত্রীবহন করার কারণে গভীর সমুদ্রে তিনবার জাহাজ বদল করেন কর্তৃপক্ষ। এফভি বে-ওয়ান থেকে এফভি বার আউলিয়ায়, এভাবে পুরো রাত গভীর সমুদ্রে কেটে যায়। পরের দিন সকাল সাড়ে ৬টার দিকে কক্সবাজার জেটিঘাটে পৌঁছানো হয়।’
একই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন দিনাজপুর থেকে আসা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ লিটন। তিনি বলেন, ‘মাঝ সমুদ্রে বে-ওয়ান জাহাজ থেকে বার আউলিয়া জাহাজে পার করার সময় দুটি সিড়ি ব্যবহার করেন জাহাজ কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে একটি সিটি ভেঙ্গে গেলে আমার দুই সন্তান ভয়ে আঁতকে উঠে। কারণ, আমার স্ত্রী ও বড় সন্তান এক জাহাজে আর আমি ও আমার ছোট সন্তান অন্য জাহাজে হয়ে গেছি। পুরো রাত পার হয়েছে ভয় ও আতংকে। সকালে কক্সবাজার পৌছলে স্বস্তি ফিরে আসে।’
সালাহ উদ্দিন বকুল নামের এক পর্যটক বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে গিয়ে একটি বাজে অভিজ্ঞতার হল। জাহাজ কর্তৃপক্ষের চরম অব্যবস্থাপনা এর জন্য দায়ী। জাহাজে এক সিট তিনজনকে বিক্রি করছে টাকার লোভে। আর যাত্রীরা যে সিট ভাড়া করে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার কথা, সিট তো দূরের কথা দাড়িয়েও থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে। কারণ, পুরো জাহাজ জুড়ে মানুষ আর মানুষ। জাহাজের ভেতর মানুষের ঠাসাঠাসিতে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।’
তার স্ত্রী মাহবুবা জ্যোতি বলেন, ‘রাতভর জাহাজে মানুষের অস্বাভাবিক ভিড়, চিৎকার ও কান্নায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির তৈরি হয়। এতে করে আমার দুই সন্তান সোয়াইব ও রায়ান ভয় পায়। এসময় জাহাজ কর্তৃপক্ষ মাইকে ঘোষণা দেন সাগর উত্তালের কারণে কুলে জাহাজ ভিড়তে সময় লাগবে। এতে করে পুরো রাত পার করে দিল তারা। জাহাজে খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়ে শত শত পর্যটক।’
এদিকে, প্রতিবছর টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করলেও চলতি পর্যটন মৌসুমে নাফ নদীতে নাব্যতা হ্রাসের কথা বলে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। তবে গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের দিকে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে এফভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস নামের জাহাজটি চলাচলের অনুমতি পান। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬ থেকে ৭টার মধ্যে কক্সবাজার জেটিঘাট থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আবার একইদিন বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে সেন্টমার্টিন থেকে কক্সবাজার ফিরে আসে। এতে করে সেন্টমার্টিন ভ্রমণের আর কোন বিকল্প নৌযান না থাকায় কর্ণফুলী এক্সপ্রেসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে পর্যটকরা। ইতিমধ্যে সেন্টমাটিন যাওয়া-আসার সময় একাধিকবার ইঞ্জিল বিকলসহ নানা কারণে দুর্ভোগে পড়তে হয় পর্যটকদের। অতিরিক্ত যাত্রীবহনের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ পর্যটকদের।
যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (স্কোয়াব) এর সাধারণ সম্পাদক ও কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের কক্সবাজারের ব্যবস্থাপক হোসাইনুল ইসলাম বাহাদুর বলেন, বেশকিছু দিন ধরে এফবি কর্ণফুলী এক্সপ্রেসে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। একারণে কর্ণফুলী জাহাজটি মেরামতের জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। ফলে সেন্টমার্টিনে জাহাজ বিক্রি বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু, ট্যুর অপারেটর ওনার্স এসোসিয়েশন অফ কক্সবাজার (টুয়াক) এর সদস্যরা চট্টগ্রাম থেকে সেন্টমার্টিনগামী জাহাজ টিকেট চালু রাখে। তাদেরকে টিকেটের টাকা যাত্রীদের ফেরত দিতে বললেও তারা কথা শুনেনি। যার কারণে, চট্টগ্রামে থেকে সেন্টমার্টিনগামী জাহাজ বে-ওয়ানের মাধ্যমে যাত্রীদের কক্সবাজারে আনা হয়েছে।
ট্যুর অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) এর সভাপতি আনোয়ার কামাল বলেন, ‘কর্ণফুলী এক্সপ্রেস এক মাস আগে থেকে টিকেট বিক্রি করেছে। সেখানে টুয়াকের কোন হাত নেই। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন সব জাহাজ বন্ধ করে দিয়ে কক্সবাজার থেকে কর্ণফুলী এক্সপ্রেস একাই ব্যবসা করছে। তারা অনেক ক্ষমতাধর। স্থানীয় প্রশাসনের কথাও মানছে না কর্ণফুলী কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি আমরা পর্যটন সচিব স্যারকেও বলেছি। কিন্তু, কোন কাজে আসেনি। জেটিঘাট থেকে এত রাতে পর্যটক কক্সবাজার শহরে আসছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য কোন যানবাহনও দেননি। এসব পর্যটকের দায়িত্ব কে নিবে প্রশ্ন আমার।’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে একটি জাহাজের অনুমতি আছে। রাতভর পর্যটকরা সমুদ্রে থাকার বিষয়টি জানা নেই। আর অতিরিক্ত যাত্রী নিলে কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কেআই//