ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

চুক্তি অনুযায়ী ফ্ল্যাট বুঝে না পেলে কী করবেন?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:১৬ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ রবিবার

বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা মোঃ মাসুম মোল্লা ঢাকার কলাবাগানে একটি নির্মাণাধীন ফ্ল্যাটের জন্য বুকিং দিয়েছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী, দুই বছর ধরে তিনি কয়েক ভাগে টাকা দেবেন, এরপর ডেভেলপার তাকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু বুকিং দেয়ার এক বছর পরে তিনি জানতে পারেন, এর মধ্যেই ডেভেলপার সেটি অন্য আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।

অন্যদিকে জিনাত আরার অভিজ্ঞতা আরেক রকম।

উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পাঁচ কাঠা জায়গায় দোতলা বাড়ি ভেঙ্গে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য তারা একটি আবাসন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। সাততলা ভবন নির্মাণের পর তাদের অর্ধেক ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা। কিন্তু তিন তলার ছাদ ঢালাই দেয়ার পরেই টাকাপয়সার সংকটের অজুহাত তুলে ডেভেলপার কোম্পানি কাজ বন্ধ করে দেয়। বহু দেন-দরবার, আলোচনার পরেও তারা পুরো ভবনের কাজ শেষ করেনি।  ফলে ঢাকায় নিজেদের বুকে জমি থাকার পরেও তাকে থাকতে হচ্ছে ভাড়া বাসায়।

ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে গিয়ে অথবা ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে বহুতল ভবন নির্মাণের চুক্তির পর এরকম বিপদে পড়ার নজির কম নেই।

শনিবারও ঢাকায় রিহ্যাবের মেলায় একটি কোম্পানি স্টলে একসঙ্গে গিয়ে জমির মালিকরা তাদের প্রকল্পের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়ার দাবি করেন।  আট বছরেও ওই প্রকল্পের ফ্ল্যাট জমির মালিকদের বুঝিয়ে দেয়নি ডেভেলপার কোম্পানি। 

এরকম সমস্যায় পড়লে কি করতে পারেন ভুক্তভোগীরা? প্রতিকারের জন্য কী পথ খোলা রয়েছে?

চুক্তি অনুযায়ী ফ্ল্যাট বুঝে না পেলে কী করতে পারেন ক্রেতা বা জমির মালিক?

আবাসন কোম্পানিগুলোর সমিতি রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি তানভীরুল হক প্রবাল বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’অনেকের জানা নেই যে, এ ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য রিহ্যাবে একটি বিশেষ সেল রয়েছে। রিহ্যাবের সদস্য, এমন কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ফ্ল্যাট নিয়ে সমস্যায় পড়লে রিহ্যাব মেডিয়েশন অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস সেলে আবেদন করে প্রতিকার পাওয়া যায়।‘’

তিনি জানান, ২০০৪ সাল থেকে রিহ্যাবে এই সেলটি কাজ করছে। মাসুম মোল্লা বা জিনাত আরার মতো যারা সমস্যায় পড়েন, তারা এই সেলে আবেদন করতে পারেন।

তখন রিহ্যাব উভয় পক্ষকে ডেকে, কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে আপোষ-সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে থাকে।

 তানভীরুল হক প্রবাল বলছেন, ‘’এত শতভাগ সাফল্য পাওয়া গেছে, এই দাবি করবো না। তবে প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান করা গেছে।‘’

সমস্যা সমাধান করতে না পারায় অতীতে ডেভেলপার কোম্পানির সদস্যপদ বাতিলের মতো উদাহরণও দেখা গেছে।

রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ ২০০৮’ আইন অনুযায়ী, ফ্ল্যাটের ক্রেতা সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের তিন মাসের মধ্যে দখল হস্তান্তর ও দলিল করে দেবে আবাসন কোম্পানি।

কিন্তু এই সুবিধা পেতে হলে ডেভেলপার বা আবাসন কোম্পানিকে রিহ্যাবের সদস্য হতে হবে। ফলে ফ্ল্যাট বুকিং দেয়া বা ভবন নির্মাণের চুক্তি করার আগে সেটি রিহ্যাবের সদস্য কিনা, তা খোঁজখবর করে নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন মি.হক।

‘’আমি বলবো, সতর্ক থাকলেই অনেক ঝামেলা এড়ানো যায়। যেমন বুকিং বা চুক্তি করার আগে খোঁজ নেয়া উচিত, এই কোম্পানি আগে কোথায় কোথায় ভবন তৈরি করেছে, তাদের অতীত রেকর্ড কেমন? সেখানে খোঁজ নিলেই তাদের সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। আবার অনেকে চুক্তির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ভালোমতো পড়েন না। সেটাও অভিজ্ঞ কাউকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নেয়া উচিত। এসব সতর্কতা নিলেও ভবিষ্যতে ঝামেলা অনেকটাই এড়ানো যেতে পারে,’’ বলছেন তানভীরুল হক।

কিন্তু তিনি স্বীকার করেন, দায়ী বা দোষী প্রমাণিত হলে আবাসন কোম্পানির সদস্যপদ বাতিল করা ছাড়া রিহ্যাবের আসলে খুব বেশি কিছু করার থাকে না।

তবে আবাসন কোম্পানি কর্মকর্তারা বলছেন, আপোষ-সমঝোতার বৈঠক করতে গিয়ে তারা দেখেছেন, অনেক সময় জমির মালিক বা ফ্ল্যাটের যারা বুকিং দিয়েছেন, তাদের কারণেও এরকম সমস্যার তৈরি হয়। যেমন চুক্তিতে যেভাবে বুকিংয়ের টাকা নির্দিষ্ট সময়ে দেয়ার কথা থাকে, অনেক সময় সেটা দেয়া হয় না। এসব কারণে আবাসন কোম্পানি সেটা বুঝিয়ে দিতে দেরি করে। আবার জমি সংক্রান্ত মামলা বা জটিলতা থাকলেও ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হতে সময় লাগে।

আবার অনেক সময় আবাসন কোম্পানি সমস্যা করলেও অন্য পক্ষ অভিযোগ করতে চান না। তাদের আশঙ্কা, তাহলে হয়তো তাদের ফ্ল্যাট বুঝে পেতে আরও সময় লাগবে।

‘’আমি বলবো, এটা অমূলক ধারণা। বরং রিহ্যাবে আবেদন করলেই অনেক দ্রুত সমাধান হয়ে যায়,’’ তিনি বলছেন।

রিহ্যাব সমাধান দিতে না পারলে গন্তব্য কোথায়?
রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি তানভীরুল হক প্রবাল স্বীকার করেছেন, বেশিরভাগ অভিযোগে নিষ্পত্তি করতে পারলেও ৩০-৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে আপোষ-সমঝোতায় সমাধান হয় না।

অনেকে রাজনৈতিক বা স্থানীয় নানা সহায়তায় নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে সমাধান না হলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন ভুক্তভোগী।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলছেন, ‘’সালিস আইন ২০০১ অনুযায়ী ক্রেতা বা জমির মালিক সালিসি ট্রাইব্যুনালের আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু উভয় পক্ষ যদি ৩০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠনে ব্যর্থ হয়, তাহলে যেকোনো পক্ষ আদালতে মামলা করতে পারেন।‘’

তখন ভুক্তভোগী ব্যক্তি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ‘রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ ২০০৮’ আইনের আওতায় মামলা করতে পারেন ভুক্তভোগী। সেখানে যদি দেখা যায় যে, আইনের বিধিবিধান ভঙ্গ হয়েছে, তাহলে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা তিন বছর কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

আইনে ক্রেতার যেসব অধিকার দেয়া হয়েছে
রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ ২০০৮’ আইন অনুযায়ী, ফ্ল্যাটের ক্রেতা সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের তিন মাসের মধ্যে দখল হস্তান্তর ও দলিল করে দেবে আবাসন কোম্পানি। সেই সময় চুক্তির কোন রকমফের হলে, ফ্ল্যাটের আয়তন কম বা বেশি হলে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে তা সমন্বয় করতে হবে।

আবাসন কোম্পানি যদি নির্ধারিত সময়ে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করতে না পারে, তাহলে চুক্তিতে নির্ধারিত ক্ষতিপূরণসহ সব অর্থ ফ্ল্যাট ক্রেতাকে ছয় মাসের মধ্যে ফেরত দিতে হবে।  ক্ষতিপূরণের হার উল্লেখ না থাকলে ১৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে।

তবে ক্রেতা যদি তার বুকিং বাতিল করতে চান, তাহলে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধিত ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে বাকি টাকা তিন মাসের মধ্যে এককালীন চেক বা পে-অর্ডারের মাধ্যমে ফেরত দিতে হবে।  কিন্তু কিস্তির অর্থ বা এককালীন মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হলে দুই মাসের নোটিশ ছাড়া বরাদ্দ বাতিল করা যাবে না। ক্রেতা তিন কিস্তির অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে আবাসন কোম্পানি বরাদ্দ বাতিল করতে পারবে।

নোটিশ ছাড়া কোন আবাসন কোম্পানি বরাদ্দ বাতিল  করলে এক বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হতে পারে।

চুক্তির শর্তের বাইরে অতিরিক্ত কোন টাকা নিতে পারবে না আবাসন কোম্পানি। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সংযোগসহ দখল হস্তান্তর উপযোগী না হওয়া পর্যন্ত কিস্তির বাইরে কোন সুদ নেয়া যাবে না।

আবাসন কোম্পানি যদি চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি দেয়া উপকরণের পরিবর্তে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করে, তাহলে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

কোন আবাসন কোম্পানি চুক্তি করার পরে কাজ না করে বা আংশিক কাজ করে ফেলে রাখে, কিন্তু ক্রেতাকে কোন সুবিধা না দেয়, তাহলে তা প্রতারণামূলক কাজ বলে গণ্য হবে। সেজন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। ভূমি মালিকের অংশ বুঝিয়ে না দিলেও একই সাজা হতে পারে।

এসবি/