ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১০ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ২৪ ১৪৩১

প্রাতঃস্মরণীয় শিক্ষক অধ্যক্ষ অপূর্ব কৃষ্ণ ঘোষ

ড. গোলাম সোবহানী চৌধুরী (ড. রানা চৌধুরী)

প্রকাশিত : ০৩:৫৬ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২ মঙ্গলবার

১৯৭৪ সাল, জুলাই ২৯। আমার জীবনের পরম স্মরণীয় দিন। সেদিন আমি শিক্ষকতায় যোগ দেই। ওই বছর মে, জুন ও জুলাই এই তিনমাসে আমরা একঝাঁক তরুণ শিক্ষকতাকে ভালোবেসে ফরিদপুর সরকারী রাজেন্দ্র কলেজে যোগদান করি। অবশ্য তার কয়েকমাস আগে আমাদের তিন বন্ধু যোগ দিয়েছেন। তখন সবচেয়ে সিনিয়র যে পাঁচজন শিক্ষক রাজেন্দ্র কলেজে কর্মরত ছিলেন তারা হলেন জনাব কবীর উদ্দিন খান, শ্রী অপূর্ব কৃষ্ণ ঘোষ, জনাব আবুল হাশেম, জনাব এহিয়া ইসলাম মিয়া এবং শ্রী অনিল কৃষ্ণ ঘোষ। অধ্যাপক অপূর্ব কৃষ্ণ ঘোষ এবং অনিল কৃষ্ণ ঘোষ ছিলেন দুই সহোদর ভ্রাতা।

পঞ্চাশের দশকে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ ছিল বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলেজ। আর সেই কলেজে আপদমস্তক শিক্ষক ছিলেন শিক্ষক পিতার দুই কৃতি সন্তান অর্থনীতির অপূর্ব কৃষ্ণ ঘোষ এবং গণিতের অনিল কৃষ্ণ ঘোষ। তখনকার দিনের প্রথা অনুসারে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাধারণত নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর দিয়ে রুটিনে প্রকাশ করা হতো এবং ডাকাও হতো। তাই দুই ভাইয়েরই নামের আদ্যক্ষর অনুসারে তাদের নাম হয় এ.কে.জি বা এ.কে ঘোষ ।

আজ অধ্যক্ষ প্রফেসর অপূর্ব কৃষ্ণ ঘোষ এর ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। যেহেতু ঘোষ ভাতৃদ্বয়ের মধ্যে তিনি বড়, তাই বড় ঘোষ স্যার হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন তার হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এবং ফরিদপুর শহরের ছোট-বড় সকল বয়েসী এবং পেশার মানুষের কাছে।

এখনকার ছাত্র শিক্ষকরা কল্পনা করতে পারবেন না, কী অসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা তারা পেয়েছেন তাদের শিক্ষকতা জীবনে। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কোনোদিন তাদের ধমক দিতে হয়নি। তাদের শান্ত, সৌম্য চেহারা আর ব্যক্তিত্ব দর্শনেই সম্মোহিত হয়ে যেত বাঘা বাঘা ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে দুষ্টু ছেলেরা পর্যন্ত। আমরা আমাদের ছাত্রজীবনে বইপত্রে শিক্ষকের যে চরিত্র ও চিত্র পেতাম, ঘোষ স্যারদের মতো স্যারদের দেখেই বোধ হয় তা চিত্রিত করা হতো । 

আমরা স্কুল কলেজ জীবনে যে দুই-একজন সত্যিকারের শিক্ষকের দেখা পেয়েছি, বড় ঘোষ স্যার ছিলেন তাদের অন্যতম। আমার সৌভাগ্য হয়নি তার ছাত্র হওয়ার, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে হয়ে গিয়েছিলাম সহকর্মী। ১৯৭৪ সালে আমি যখন সরকারী রাজেন্দ্র কলেজে সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই, তখন তিনি ছিলেন ঐ কলেজের সবচেয়ে সিনিয়র শিক্ষক। অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। বয়সে, জ্ঞানে, মেধায় ও কর্মে আমি ছিলাম তার ছাত্রস্য ছাত্রসম।তিনি তার নিজ গুণে, আদর, সোহাগ, ভালবাসা দিয়ে পিতার মতো কাছে টেনে নিয়েছিলেন। দুই ঘোষ স্যার হাতেকলমে কাজ শিখিয়েছেন আমাদের। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠি, অসম্ভব জনপ্রিয় গণিতের শিক্ষক অকাল প্রয়াত সাদত হোসেন ছিলেন রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র । তাকে তিনিসহ তার শিক্ষকরা স্বাভাবিকভাবেই তুমি সম্বোধন করতেন। আমার বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও ঘোষ স্যারসহ সিনিয়র স্যাররা কখনো তুমি ডাকেননি। নামের শেষে সাহেব লাগিয়ে সম্বোধন করতেন। এমনি ছিল তখনকার সিনিয়র শিক্ষকদের সৌজন্যবোধ। 

সার্টিফিকেট অনুসারে স্যারের জন্ম ১৯২৯ সালের ১ জানুয়ারি। কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন ১৯৫০ সালে জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে । ১৯৫৭ সালে রাজেন্দ্র কলেজে যোগদান করেন সর্বজন প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় এই স্যার। নিজ জেলা পাবনা হলেও ফরিদপুরের মাটি  ও মানুষকে ভালোবেসে এবং ফরিদপুরবাসীর ভালোবাসা পেয়ে স্থায়ী হয়ে যান ফরিদপুরে। ১৯৭৯ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে তার অতিপ্রিয় রাজেন্দ্র কলেজ থেকে বিদায় নেন। এরপর মাগুরা সরকারী হোসেন শহীদ সরোওয়ার্দী কলেজ, শরিয়তপুর সরকারী কলেজ ও ফরিদপুর সরকারী সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ১৯৮৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবসর গ্রহণ করেন। তার অজস্র ছাত্র ও ফরিদপুরের আপামর জনসাধারণের প্রিয় বড় ঘোষ স্যার ১৯৯৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর পরলোকগমন করেন। 

তার একজন একনিষ্ঠ গুণগ্রাহী ও স্নেহধন্য হিসেবে তার আত্মার শান্তি কামনা করি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি তার মতো ন্যায়পরায়ণ, সত্য ও কর্তব্যনিষ্ঠ শিক্ষক যদি আমাদের কলেজগুলোতে দুই একজন করে থাকতেন, তাহলে আমাদের শিক্ষার এবং নৈতিকতার মান অনেক উন্নত হতো ।

লেখক: ফরিদুর সরকারী রাজেন্দ্র কলেজ ও ইডেন কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের সাবেক শিক্ষক।