ঢাকায় কাল থেকে মেট্রো, কলকাতার শুভেচ্ছা
অমল সরকার
প্রকাশিত : ০৭:০২ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২ মঙ্গলবার
২০২২ বিদায় নিতে চলল। বাংলাদেশের মানুষ সত্যিই ভাগ্যবান। করোনা মহামারী পরবর্তী এই বছরটিতে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলি টানেলের পর আগামীকাল প্রথম মেট্রো রেল পেতে চলেছেন তারা। স্বাধীনতার সুবর্জয়ন্তী এবং শেখ মুজিবুরের জন্ম শতবর্ষ উদযাপনের রেশ এখনও কাটেনি। এই সন্ধিক্ষণে এমন তিন প্রাপ্তি সত্যিই ঈর্ষণীয়।
পদ্মা সেতুর পর ঢাকায় মেট্রো রেল শুরু হওয়া নিয়েও এপারে বেশ কৌতুহল আছে। গত জুনে উদ্ধোধনের আগে থেকেই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে পদ্মা সেতু নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ওই সেতু নির্মাণকে ঘিরে কু-রাজনীতি উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রকল্প নিয়ে সাহস করে এগিয়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে অত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন ভারতবাসীকেও স্পর্শ করে। পদ্মা সেতু নিয়ে লেখালেখি, টিভি কভারেজ শুধু পশ্চিমবঙ্গের সংবাদ মাধ্যম নয়, তামাম ভারতের মিডিয়ায় ইতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে আর কোনও বিষয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ার এতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি।
ঢাকার মেট্রো রেল নিয়েও এপারে বেশ কৌতুহল আছে। সেটা টের পেলাম ঘরোয়া এক আডডায়। সব মানুষের মধ্যেই তার চারপাশের যানবাহন ঘিরে একটা নস্টালজিয়া কাজ করে। কলকাতার হাতে টানা রিকশ কালের নিয়মে হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে কোনও নাগরিক ওই যানটি নিয়ে বলতে শুরু করলে থামতে চাইবেন না।
ঢাকার রিকশা সম্পর্কেও আমি একই কথা বলব। ঢাকার রিকশা চালক বন্ধুদের আন্তরিকতার পাশাপাশি তাদের রাজনীতি সচেতনতা, দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখে আমি মুগ্ধ ও অবাক হয়েছি। অভিজাত ঢাকা ক্লাবের সামনে এক রিকশা চালকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল যিনি আমাকে পদ্মা সেতু নিয়ে গর্ব করে বলেছেন, আমি দ্বিতীয় স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। আমি জানতে চাইলাম, কী সেটা। তিনি বললেন, রিকশা নিয়ে পদ্মা সেতু পেরনো। পরে নিজেই হাসতে হাসতে বললেন, 'জানি সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু পরাণ যা চায় তা আপনারে বললাম।' বাংলাদেশে বিরোধী নেতানেত্রীরা যখন বর্তমান সরকারের বিদায়কে দ্বিতীয় স্বাধীনতা প্রাপ্তি বলে প্রচার শুরু করেছেন, তখন ওই গরিব রিকশা চালকের দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, স্বাভাবিকভাবে আমাকে অবাক করেছে। একটা সেতু ঘিরে গরিব মানুষের দেশের সঙ্গে সেতুবন্ধনের নজির আমি কমই প্রত্যক্ষ করেছি।
ঢাকায় মেট্রো চালু হতে যাচ্ছে শুনে এপারে অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন ৩৮ বছর আগে কলকাতা তথা ভারতের প্রথম মেট্রো চালুর দিনগুলিতে। কাকতালীয়ভাবে এ মাসেই, ৩০ ডিসেম্বর কলকাতায় নতুন একটি মেট্রো লাইনের সূচনা করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার দক্ষিণতম প্রান্ত জোকা থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্র এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত চালু হবে মেট্রো।
১৯৮৪-র ২৪ অক্টোবর কলকাতায় এসপ্ল্যানেড থেকে ভবানীপুর (এখন যেটা নেতাজি ভবন স্টেশন) পর্যন্ত তিন-চার কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে প্রথম মেট্রো চালু হয়েছিল। নাহ্, সেদিন দেশের প্রথম মেট্রো চালু করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, রেলমন্ত্রী এবিএ গনিখান চৌধুরী, এমনকী পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকেও ডাকা যায়নি। কারণ, মেট্রো কর্তৃপক্ষ ঠিক নিশ্চিত ছিলেন না, শেষ পর্যন্ত ওই স্বল্প দূরত্বেও যাত্রা সফল করে তোলা যাবে কি না।
ঠিক হয়েছিল প্রকল্পের কাজ আরও কিছুটা এগিয়ে নিয়ে বড় আকারে উদ্বোধন করা হবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে দিয়ে। কলকাতা তথা ভারতের প্রথম মেট্রোর সঙ্গে জুড়ে আছে ইন্দিরা আর গনিখান চৌধুরীর অনন্য অবদান। দুর্ভাগ্য হল ওই অক্টোবরেই দিন সাতেকের মাথায় নিজের দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হন ইন্দিরা।
কলকাতায় মেট্রো নির্মাণে সময় আমি স্কুলে-কলেজে পড়ি। সেই দিনগুলির কথা মনে পড়লে অনুমান করতে পারি ঢাকার মানুষকে মেট্রো রেল পেতে কী পরিমান দুর্ভোগ পোহাতে হছে।
ঢাকা, কলকাতার মতো পুরনো শহরে মেট্রো রেল, উড়ালপুল, এলিভেটেড রোড ইত্যাদি চালুর প্রসব বেদনা তীব্র। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় নানাভাবে ব্যাঘাত ঘটে। কলকাতায় মাটির নিচ দিয়ে মেট্রো তৈরির দিনগুলিতে শহরের ব্যস্ততম রাস্তাগুলি বছরের পর বছর বন্ধ রাখতে হয়েছিল। খোঁড়াখুঁড়ির ফলে মাটির নিচে জল, টেলিফোন, বিদ্যুৎ, পয়ঃপ্রণালি, গ্যাসের লাইন চৌপাট হয়ে গিয়েছিল। পাশের বাড়ির ফোনের লাইন পর্যন্ত পাওয়া যেত না। দিনের পর দিন শহরকে নির্জলা থাকতে হয়েছে মেট্রোর কাজে পাইপ লাইনে ফাটল ধরাতে। মাঝমধ্যে স্থানীয় মানুষ দুর্ভোগের প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধ করে বাকিদের যন্ত্রণা বাড়িয়ে তুলতেন।
মেট্রোর কাজের ঢিলেমি নিয়ে অনেকেই তখন মুখ খুলেছেন। তাঁদের অন্যতম প্রবাদপ্রতীম চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। তাঁর ফেলুদা সিরিজের জনপ্রিয় চরিত্র লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর মুখে ‘হেল রেল’ কথাটি ছিল মেট্রো রেলের কাজ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ। কারণ যানজটে আটকে প্রায়ই সত্যজিৎবাবুর সিনেমার কাজে ব্যাঘাত ঘটত। সেই সত্যজিৎবাবু একদিন মেট্রো চড়ে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন।
আমি জানি না দেশের প্রথম মেট্রো পেতে ঢাকার মানুষকে কলকাতার মতো দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে কিনা। তবে কথায় আছে, কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। ঢাকায় ট্রাফিক জ্যামের চলাচলের অভিজ্ঞতা আমার আছে। এ মাসের গোড়াতেও সে অভিজ্ঞতা হয়েছে। আজ থেকে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে কলকাতায় যানজট ঢাকার আজকের যানজটের থেকে বেশি ছিল। কিন্তু মেট্রো চালু হওয়ার পর ধীরে ধীরে যানজটের সমস্যা অনেকটা কমে এসেছে কলকাতায়। ঢাকাও সেই সুদিনের দিকে এগিয়ে যাবে ধীরে ধীরে।
কলকাতা মেট্রোর নির্মাণ পর্বে সংস্থার চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ বিজেপি নেতা তথা ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায়। তাঁর আদি বাড়ি বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
ঢাকায় মেট্রো চালুর খবরে খুশি তথাগতবাবু বলছিলেন, কলকাতা, ঢাকার মতো শহরে এমন প্রকল্প রূপায়ণ সত্যিই এক চ্যালেঞ্জ। কারণ, এই শহরগুলি প্রাচীন এবং এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে একটি ইট পুঁততে গেলেও হাজার বাধা পেরতে হয়। স্বভাবতই ঢাকায় মেট্রো রেল চালু হচ্ছে জেনে খুশি তথাগতবাবু। তাঁর কথায়, ৩৮ বছর আগে কলকাতায় মেট্রো চালুর দশ বছর আগে শুরু হয়েছিল কাজ। তখন আজকের মতো চাইলেই বিদেশি ইঞ্জিনিয়ারদের ডাকা যেত না। বিদেশি প্রযুক্তিও হাতের মুঠোয় ছিল না।
কলকাতার অনেক বছর পর ভারতে রাজধানী দিল্লিতে মেট্রো চালু করা হয়। এখন অনেকগুলি শহরে মেট্রো চালু হয়ে গিয়েছে। দিল্লিতে মেট্রো নির্মাণের সময় বিদেশি পুঁজি ও প্রযুক্তি দুই-ই ছিল সহজলভ্য। কলকাতা-সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বর্তমানে নির্মীয়মান মেট্রো প্রকল্পগুলিতে যেমন বিনিয়োগ করছে জাপানি সংস্থা জাইকা।
লক্ষণীয় হল, ঢাকার মতো ভারতের বাকি শহরগুলিতেও মেট্রো মূলত এলিভেটেড করিডরের ওপর করা হচ্ছে। দিল্লি মেট্রোর কিছুটা মাটির নিতে, বেশিরভাগটাই মাটির উপরে। কলকাতায় অবশ্য আর কয়েক মাস পরই চালু হবে পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো। এই প্রকল্পের একটা অংশ গঙ্গার নিচ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যেমন মেট্রো আছে লন্ডনের টেমস নদীর নিচে।
কথায় কথায় তথাগতবাবু বলছিলেন, কলকাতাতেও গোড়ায় এলিভেটেড মেট্রো চালু করার চেষ্টা হয়। কিন্তু প্রাচীন এই শহরের রাস্তা তেমন চওড়া না হওয়ায় সেই প্রস্তাব বাতিল করে চালু করা হয়।
১৯৮৪ সালের জুন মাসে কলকাতায় প্রথম মেট্রো চালু করার কথা ছিল। কিন্তু সে বছর জুনেই প্রবল বৃষ্টিতে টানেলে জল ঢুকে কোচ পর্যন্ত ডুবিয়ে দিয়েছিল। ফলে বর্ষা পাড় করে উদ্ধোধনের দিন ঠিক করতে হয়। মূলত ট্রায়াল রানের জন্যই এসপ্ল্যানেড থেকে ভবানীপুর পর্যন্ত স্বল্প দূরত্বের মধ্যে মেট্রো চালানো শুরু হয়েছিল। ঢাকা মেট্রোর সূচনা লগ্নে সীমান্তের এপারে বসে এসব কথা মনে পড়ছে।
বাংলাদেশের মানুষ কাল প্রথম মেট্রো পেতে চলেছে। এই শুভক্ষণে রইল অনেক শুভেচ্ছা। শুভ হোক ঢাকা মেট্রোর যাত্রা। কলকাতা ও ঢাকা দুই শহরই রিকশ থেকে মেট্রো, যানবাহনের বিবর্তনকে বুকে নিয়ে এগিয়ে চলুক।
লেখক: কলকাতার দ্য ওয়্যাল পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক।
এসি