কীভাবে এলো মেট্রোরেল?
নাজমুশ শাহাদাৎ
প্রকাশিত : ১১:২৭ এএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ বুধবার | আপডেট: ১১:৩৫ এএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ বুধবার
মেট্রোরেল
রাজধানী ঢাকায় নির্মাণাধীন শহরভিত্তিক রেল ব্যবস্থা হচ্ছে ঢাকা মেট্রো, যা আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট বা সংক্ষেপে এমআরটি নামে পরিচিত।
২০১৩ সালে অতি জনবহুল ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা ও পথের দুঃসহ যানজট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। যার অধীনে প্রথমবারের মতো ঢাকায় মেট্রোরেল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়।
মেট্রোরেলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড, যা পরবর্তীতে ২০১৬ সালে প্রণীত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় নির্মিতব্য মেট্রোরেলের লাইনের সংখ্যা ৩টি থেকে বাড়িয়ে ৫টি করা হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন ৬-কে নির্বাচন করা হয়। ২০১৬ সালের ২৬ জুন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এমআরটি লাইন-৬ এর নির্মাণকাজ শুরু হয়।
জাইকা ও ডিএমটিসিএল ২০৩০ সাল নাগাদ ১২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মোট ৬টি মেট্রো লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এই নেটওয়ার্কে ৫১টি এলিভেটেড স্টেশন ও ৫৩টি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থাকবে। ছয়টি লাইন মিলিতভাবে দিনে ৪৭ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।
মেট্রোরেলের সূচনা
জাপানের রাজধানী টোকিওতে মেট্রোরেল ব্যবস্থা চালু হয় ১৯২৭ সালে। জনবহুল শহর টোকিওর বাসিন্দাদের যাতায়াতে প্রচুর সময় বাঁচাচ্ছে মেট্রোরেল। একইসঙ্গে বাড়িয়েছে শহরটির অর্থনৈতিক উপযোগিতাও। বিভিন্ন দেশের বড় শহরগুলোর নাগরিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জাপানের নজর থাকে মূলত মেট্রোরেল ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর। এক্ষেত্রে প্রধানতম অনুঘটক ধরা হয় টোকিও মেট্রোর ইতিবাচক সাফল্যের অভিজ্ঞতাকে।
ওই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বিশ্বের অনেক বড় শহরে মেট্রোরেল নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে জাপান। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় আজ (২৮ ডিসেম্বর) উদ্বোধন হচ্ছে দেশের প্রথম মেট্রোরেলের একাংশ। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সিংহভাগ অর্থায়নে নির্মিত প্রকল্পটিতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।
উত্তরা-মতিঝিল রুটে নির্মীয়মান মেট্রোরেলের অংশটির (এমআরটি-৬) পুরো কাজ এখনো শেষ হয়নি। এজন্য শুরুতে উত্তরা-আগারগাঁওয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে মেট্রোরেলের চলাচল। এ অংশে মেট্রোরেল চলাচল করবে বিদ্যমান সড়কের ওপর নির্মিত উড়াল সড়কে স্থাপিত রেললাইনে।
এদিকে, ঢাকায় শুরু হয়েছে পাতাল মেট্রোরেল স্থাপনের তোড়জোড়ও। বিমানবন্দর-বাড্ডা-কমলাপুর অংশে সড়কের নিচ দিয়ে চলাচল করবে মেট্রোরেল। এমআরটি-১ লাইনের অংশ হিসেবে পাতাল রেলপথটির নির্মাণকাজ শুরুর প্রক্রিয়া এখন চলমান। এ লাইনের বাকি অংশ উড়ালপথে। এমআরটি-১ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাইকার অর্থায়ন ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী ভারতেও বড় শহরগুলোতে মেট্রোরেল ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রধান সহযোগীর ভূমিকা নিয়েছে জাপান। চলতি বছরেই চেন্নাইয়ে মেট্রোরেল প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেজ নির্মাণে জাইকা ও ভারত সরকারের মধ্যে একটি ঋণ বিনিয়োগ চুক্তি সই হয়। এটি নির্মাণ শেষ হলে চেন্নাইয়ে বিদ্যমান মেট্রোরেল নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য বাড়বে আরও ৫১ কিলোমিটার। এজন্য জাইকার মাধ্যমে ভারতকে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি ইয়েন (প্রায় ১১১ কোটি ডলার) ঋণ দিচ্ছে টোকিও। চেন্নাই মেট্রোরেলের প্রথম ফেজের নির্মাণকালেও সিংহভাগ অর্থের জোগান দেয় জাইকা।
ভারতের রাজধানী দিল্লির মেট্রো ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণেও বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে জাইকা। ১৯৯৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত দিল্লির পরিবহন খাতে পৃথক ১৬টি প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে সংস্থাটি, যার ১৫টিই মেট্রোরেলকেন্দ্রিক। গত ২০ বছরে কলকাতার মেট্রোরেলভিত্তিক চারটি প্রকল্পে অর্থায়নের অনুমোদন পেয়েছে জাইকা।
জাপান সরকার মনে করছে, দিল্লির মেট্রো ব্যবস্থায় বিনিয়োগ এরই মধ্যে বড় সাফল্য হিসেবে ধরা দিয়েছে। দেশটিতে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত হিরোশি সুজুকি গত সপ্তাহেই বলেছেন, গত ২০ বছরে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারণ হতে হতে মানে ও ব্যাপ্তিতে টোকিওর মেট্রো ব্যবস্থাকেও ছাড়িয়ে গেছে দিল্লির মেট্রোরেল।
এছাড়াও মুম্বাই, আহমেদাবাদ ও বেঙ্গালুরুর মতো বড় শহরেও মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক নির্মাণ, সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে জাপান।
বাংলাদেশ-ভারতেই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ফিলিপাইনের ম্যানিলায়, ভিয়েতনামের রাজধানী হো চি মিন সিটিতে, ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায়ও মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পে সহায়তা রয়েছে জাপানের।
শুধু এশিয়া নয়, আফ্রিকার দেশ মিসর ও তিউনিসিয়াতেও মেট্রোরেল নির্মাণে বড় বিনিয়োগ রয়েছে জাপানের। ইউরোপের বুলগেরিয়ায়ও মেট্রোর সম্প্রসারণ প্রকল্পে জাইকার মাধ্যমে অর্থায়ন করেছে দেশটি।
ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্প
২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট তথা মেট্রো রেল প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন লাভ করে।
এমআরটি লাইন-১ (বিমানবন্দর যাত্রাপথ)
২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর এমআরটি-১ নামক লাইনটির নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এমআরটি-১ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ও নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মোট ৩১.২৪ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এ প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকার দেবে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, বাকি ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা আসবে সরকারি তহবিল থেকে।
এমআরটি-১ প্রকল্পে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ২১ কিলোমিটার হবে পাতাল পথে এবং কুড়িল থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে। নতুন বাজার থেকে কুড়িল পর্যন্ত ৩ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রানজিশন লাইনসহ ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এই মেট্রোরেলের ১২টি স্টেশন থাকবে মাটির নিচে এবং ৭টি থাকবে উড়াল সেতুর ওপর। এমআরটি লাইন-১ হবে দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেল।
এমআরটি লাইন-১ (পূর্বাচল যাত্রাপথ)
নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে। যার কাজ ২০২৮ সাল নাগাদ শেষ হতে পারে। এর ফলে খুব দ্রুত সময়ে প্রায় ২০ মিনিটে নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ যাওয়া যাবে।
এমআরটি লাইন-২
২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত উড়াল ও পাতাল সমন্বয়ে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ জি২জি ভিত্তিতে পিপিপি পদ্ধতিতে এমআরটি লাইন-২ নির্মাণ করা হবে। এরই মধ্যে জাপান ও বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে।
এমআরটি লাইন-৪
পিপিপি পদ্ধতিতে কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে ট্রাকের পাশ দিয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল মেট্রোরেল হিসেবে এমআরটি লাইন-৪ নির্মাণের উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন, যা শেষ করা হবে ২০৩০ সালের মধ্যে।
এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর)
এমআরটি-৫ নির্মাণ প্রকল্পে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পের ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার মধ্যে ২৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা দেবে জাপান আর বাকি ১২ হাজার ১২১ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের মোট ২০ কিলোমিটারের মধ্যে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার হবে পাতাল পথে আর বাকি সাড়ে ৬ কিলোমিটার হবে উড়াল পথে। এ রুটে মোট ১৪টি স্টেশন হবে, যার মধ্যে ৯টি হবে পাতাল আর ৫টি হবে উড়ালপথে।
এমআরটি লাইন-৫ (দক্ষিণ)
২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ১৭ দশমিক ৪০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। তার মধ্যে পাতাল ১২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এবং উড়াল ৪ দশমিক ৬০ কিলোমিটার।
এমআরটি লাইন-৬ (প্রথম পর্যায়)
প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য এমআরটি-৬ নামক ২০.১০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথকে নির্ধারণ করা হয়। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে জাইকা দেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেল চালু হলে দু'দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে।
এমআরটি-৬ এর চূড়ান্ত রুট অ্যালাইনমেন্ট হলো- উত্তরা তৃতীয় ধাপ-পল্লবী-রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে (চন্দ্রিমা উদ্যান-সংসদ ভবন) খামারবাড়ী হয়ে ফার্মগেট-সোনারগাঁও হোটেল-শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বর-তোপখানা রোড থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত।
এ রুটের ১৬টি স্টেশন হচ্ছে- উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, মতিঝিল ও কমলাপুর।
ট্রেন চালানোর জন্য ঘণ্টায় দরকার হবে ১৩.৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, যা নেওয়া হবে জাতীয় গ্রিড থেকে। এর জন্য উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁ ও বাংলা একাডেমি এলাকায় পাঁচটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থাকবে।
২০১৬ সালের ২৬ জুন এমআরটি-৬ প্রকল্পের নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে শুরু হয় ঢাকা মেট্রোর নির্মাণকাজের সূচনা। এমআরটি-৬ এর স্টেশন ও উড়ালপথ নির্মাণের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় ২০১৭ সালের ২ আগস্ট।
এদিন উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটারের উড়ালপথ ও স্টেশন নির্মাণ শুরু হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের স্টেশন ও উড়ালপথ নির্মাণ শুরু হয়। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই প্রকল্পের উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে, যা পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
অবশেষে, এমআরটি-৬ লাইনের প্রথম পর্যায়ের দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও অংশ জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হলো আজ (২৮ ডিসেম্বর)। বেলা ১১টায় এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটিই বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল।
দ্বিতীয় পর্যায়
এমআরটি-৬ লাইনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল ২০২৩ সালের শেষ দিকে চালুর কথা রয়েছে এবং ২০২৫ সাল নাগাদ এটি কমলাপুর পর্যন্ত চালু হতে পারে।
এনএস//