গুরু নানক ও তিন শিষ্য
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:৫৬ পিএম, ৩ জানুয়ারি ২০২৩ মঙ্গলবার | আপডেট: ১২:২৪ পিএম, ৪ জানুয়ারি ২০২৩ বুধবার
এক শিক্ষকের গল্প দিয়েই শুরু করি। যাত্রাপথ কঠিন! শিক্ষক, গুরু, টিচার- একই শব্দ। ওস্তাদ সমার্থক শব্দ।
তো গল্পটি হচ্ছে গুরু নানকের। আমরা জানি যে, গুরু নানক শিখ ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন এবং একেশ্বরবাদী ছিলেন। তো গুরু নানক যখন তার ধর্ম প্রচার করতে যাচ্ছেন তখনকার সময়ের কথা। আসলে এখনকার মতো এত সহজ ছিল না তখন যে রাত্রিবেলা এসি বাসে উঠলেন আর সকালবেলা পৌঁছে গেলেন।
আবার কেউ বিমানে উঠলেন, পৌঁছে গেলেন! তখনকার দিনে যাত্রা কঠিন ছিল, পথ কঠিন ছিল। খাবার-দাবার দুর্লভ ছিল। তো গুরু নানক তার শিষ্য মানে ছাত্রদের নিয়ে ধর্ম প্রচারের জন্যে যাচ্ছেন।
তো এক এক জায়গায় যান, গিয়ে তাঁবু গাড়েন। শিষ্যদের উপদেশ দেন। তাদের পরিশুদ্ধ করার জন্যে সাধনার পথ বাতলে দেন। এবং আশেপাশে গ্রামে যান। নতুন মানুষজনকে তার ধর্মের বাণী পৌঁছে দেন। তো একবার হলো, এক জায়গায় গিয়ে তাঁবু গেড়েছেন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। রাতে পথ চলাটা তখন খুব কঠিন ছিল। অন্ধকার! শীতের সন্ধ্যা! এই সন্ধ্যাতেই কুয়াশা নেমে গেছে। প্রচন্ড শীত।
যারা পাঞ্জাবের হরিয়ানা রাজস্থান এই সমস্ত জায়গায় গিয়েছেন শীতের সময়ে, তারা বোঝেন যে ওখানে শীত কত প্রবল হয়! তো গুরু নানক, কয়েকজন শিষ্যকে কিছু উপদেশ দিচ্ছেন। তারপরে তার মনে হলো, তার যে চাদরটা তিনি জড়িয়ে ছিলেন, চাদরটা ময়লা হয়ে গেছে। তো চাদরটা গা থেকে খুলে দিয়ে একজনকে বললেন যে, যাও এটা ধুয়ে একদম শুকিয়ে নিয়ে আসো। যাতে করে আমি আবার গায়ে দিতে পারি, শীত নিবারণ করতে পারি। তো সে তাঁবু থেকে বেরোলো। বেরোনোর পরেই দেখে যে কুয়াশা। খুব কিছু একটা দেখা যাচ্ছে না। ঠান্ডায় কাঁপছে, এদিক ঐদিক যাচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সে ফিরে এলো। তো গুরু নানক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এটা ধোও নি? ধুয়ে আনো নি?
বলে যে, কিচ্ছু দেখা যায় না। এদিক ওদিক তাকালাম, শীত ঠান্ডা, পানি কোথায়? শুকাবো কোথায়? কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। আরেকজনকে দিলেন। সেও ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে এসে একই কথা যে, কুয়াশা তীব্র। বেশিদূর দেখা যায় না। তাই ফিরে এসছি। এরপরে গুরু তৃতীয়জনকে দিলেন যে, তুমি যাও। দেখো তুমি পারো কিনা! এটা ধুয়ে পরিষ্কার করে শুকিয়ে আনলেই আমি ব্যবহার করব। তো সে গেল। অনেকক্ষণ পার হয়ে গেল।
একেবারে মধ্যরাত! সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত হয়ে গেছে। সে ফিরে এসছে। চাদর ফকফকা। খরখরে শুকনা। তো আরো যারা শিষ্য ছিল চাদরের এই অবস্থা দেখে তারা তো বিস্মিত। বলে যে, জাদু জানে নাকি? এ তো জাদু! তো গুরু নানক নিলেন চাদর। গায়ে পরলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এটাকে ধুয়ে পরিষ্কার করে আবার খরখরে করে শুকিয়ে কীভাবে নিয়ে এলে?
বলল যে, গুরুদেব! আপনি যখন বললেন এটাকে ধুয়ে শুকিয়ে আনলে আপনি ব্যবহার করতে পারবেন এবং ধুয়ে না শুকানো পর্যন্ত আপনি এটা আর ব্যবহার করবেন না, তখন আমার মনে হলো যে, আমাকে এই কাজটা করতে হবে। আমি যতক্ষণ পর্যন্ত এটাকে ধুয়ে খরখরে না করছি, আপনি তো শীত নিবারণ করতে পারবেন না। আমাকে এই কাজটা করতে হবে।
প্রভুকে স্মরণ করে পানি ও আগুনের সন্ধ্যান শুরু করলাম! তো আমি হাঁটতে শুরু করলাম। প্রথম আমার প্রয়োজন হচ্ছে, পানি। ধুতে হবে। পানি ছাড়া তো ধোয়া যাবে না। হঠাৎ খেয়াল হলো, আমরা যে পথ দিয়ে এসছি, সেই পথে একটা কুয়া ছিল।
আমি অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আমি প্রভুকে স্মরণ করছি যে, প্রভু! আমাকে কুয়ার পথটা দেখিয়ে দাও। আমার তো মনে হচ্ছে একটা কুয়ো দেখেছি। হাঁটতে হাঁটতে আমি ঠিক কুয়োর কাছে উপস্থিত হলাম। কুয়োর পানিতে খুব ভালো করে এটাকে ধুলাম। ভিজে ঠান্ডা। কারণ শাল- থেকে পানি সহজে বের হয় না।
এখন ভাবছি যে, এটাকে শুকাবো কীভাবে ঠান্ডা তো! ধুলাম তো ঠিক আছে, শুকাব কীভাবে? মনে হল, ধুতে যখন পেরেছি, শুকানোর উপায়ও একটা বেরিয়ে আসবে। উপায় খুঁজতে হবে। আমি হাঁটতে লাগলাম আরও। ক্লান্তি আসছে। হাঁটার শক্তি পাচ্ছি না আর, তারপরও হাঁটছি। হঠাৎ দেখি দূরে আলো দেখা যাচ্ছে। ভালো করে খেয়াল করলাম। মনে হলো এটা আগুন।
ঐদিকে এগুতে লাগলাম। যত কাছে যাচ্ছি আগুন বড় হচ্ছে। আগুন বড় হচ্ছে! প্রথম যেটা মনে হচ্ছিল যে, এটা চেরাগের আগুন কাছে গিয়ে দেখালাম না! আগুন! ঘরের বাইরে দু-তিনজন মানুষ আগুন পোহাচ্ছে। চলে গেলাম ওখানে। ঘরে যে চালা ছিল, চালার যে কাঠ ছিল, ঐ কাঠের সাথে চাদরের দুই কোণা বাঁধলাম। এতটা উঁচু করে ধরলাম যাতে আগুনে পুড়ে না যায়। তারপরে আমি দুই কোণা ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
আস্তে আস্তে পানি শুকোতে লাগল। আস্তে আস্তে এটা শুকিয়ে একেবারে খরখরা হয়ে গেল। তারপরে আমি ভাঁজ করে নিয়ে আমি এলাম। একজন কেন পেরেছে? তো আসলে, মনছবি, লক্ষ্যে পৌঁছা। তিনজনকেই কিন্তু শিক্ষক লক্ষ্য দিয়েছিলেন। দুজন পারে নি। একজন পেরেছে।
দুজন কেন পারে নি? প্রথমজন বেরিয়েই কিছুক্ষণ পরে তার মধ্যে নেতিবাচকতা চলে এসছে যে, কুয়াশা, অন্ধকার, কিছু দেখা যাচ্ছে না। কোথায় পানি পাবো, এই শীতের রাতে ঠান্ডার মধ্যে কোথায় এটাকে গরম করতে পারব, শুকাব! কিছুক্ষণ এদিক ওদিক উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরাঘুরি করে সে চলে এসছে।
দ্বিতীয়জনও কেন পারল না? একই কারণে। তার ভেতরেও নেতিবাচকতা। সে বিশ্বাস করতে পারল না যে, এই কাজটা করা যাবে। সে ব্যর্থ হলো।
তৃতীয়জনের কাছে বড় হয়ে দেখা দিল যে, এই চাদরটা ধুয়ে শুকাতে পারলেই আমার শিক্ষক এটা গায়ে দিয়ে শীত নিবারণ করতে পারবেন। অতএব কাজটা আমাকে করতেই হবে। এবং শিক্ষক যখন চেয়েছেন নিশ্চয়ই আমি আমার কাজ করে যাব। আমি চেষ্টা করব। নিশ্চয়ই প্রভু আমাকে পথ করে দেবেন।
তখন তার ব্রেন কাজ করতে শুরু করল। সে যখন ডিটারমাইন্ড হলো, দৃঢ় আস্থা আনল যে না, এই কাজটা আমাকে করতে হবে, এই লক্ষ্য আমাকে অর্জন করতে হবে তখনই সে পারল।
নেতিবাচক চিন্তা করার জন্যে বিশ্বাসের প্রয়োজন হয় না! সে কিন্তু এটা না করলেও তার ব্যক্তিগত কোনো ক্ষতি হতো না। কিন্তু সে এই কাজটা কেন করতে চাইল? যে এই কাজটা করার মধ্য দিয়ে তার চেয়ে যিনি বড়, তার যিনি পথপ্রদর্শক, তিনি কী পাবেন? তিনি একটু কমফোর্ট পাবেন, একটু আরাম পাবেন, তিনি একটু শীত নিবারণ করতে পারবেন। তার কল্যাণ হবে তার উপকার হবে। অতএব আমাকে কাজটা করতে হবে।
এবং এই কাজ করার মধ্য দিয়ে তার ব্রেনটা খুলে গেল। সে কাজটাকে ভাগ করে ফেলল যে, প্রথম কী করতে হবে? আগে এটাকে ধুতে হবে। দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে শুকানো। আগে ধুয়ে নেই। তারপরে শুকানোর চিন্তা করব যে, এই শীতে কীভাবে শুকানো যাবে। সে ধোয়া শুরু করল। তখনই তার ব্রেন কাজ করা শুরু করল।
যখন কেউ ইতিবাচক হয়, যখন সে বিশ্বাসে প্রবল হয়, তখন ব্রেন কাজ করতে শুরু করে। আর তা না হলে যখন সে গতানুগতিকতায় গা ভাসিয়ে দেয়, নেতিবাচকতায় গা ভাসিয়ে দেয়, তখন ব্রেনও অটোমেশনে দিয়ে দেয়। নেতিবাচক চিন্তা করাটা খুব সহজ। কারণ ওটার জন্যে কোনো বিশ্বাসের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ইতিবাচক চিন্তা করার জন্যে বিশ্বাসের প্রয়োজন হয়।
তো আমরা দেখছি সে প্রথম পরিষ্কার করল। এরপর দ্বিতীয় ধাপ যে, এখন এটা শুকোতে হবে, আমাকে আরো পথ চলতে হবে। আরও খুঁজে বের করতে হবে। এবং সে শুকোনোর জন্যে যে আগুন দরকার, আগুন সে পেয়ে গেল। এবং শুকিয়ে নিয়ে ফিরে এলো।
সাফল্যের জন্যে প্রয়োজন একজন মেন্টর! তো জীবনে সাফল্যের জন্যে কী প্রয়োজন? ইউ নিড আ টিচার। একজন শিক্ষক। একজন গাইড। একজন মেন্টর। যে কেউ হতে পারেন তিনি। এবং সেই মেন্টরের প্রতি, সেই গাইডের প্রতি, সেই শিক্ষকের প্রতি আস্থা।
এবং নেতিবাচকতাকে কোনোভাবে প্রশ্রয় না দেয়া। বিশ্বাসে প্রবল থাকা, ইতিবাচক বিশ্বাসে নিজেকে প্লাবিত করা। তখন আপনি যেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান, সেই লক্ষ্যে ব্রেন কাজ করতে শুরু করে এবং একের পর এক, একের পর এক বাধাগুলো দূর হয়ে যাবে। এবং আপনি সাফল্যের শীর্ষে, অর্থাৎ যে লক্ষ্য আপনি স্থির করেছেন, সে অর্জনের শীর্ষে আপনি পৌঁছাতে পারবেন।
এসি/