ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা জরুরী: মোস্তাফা জব্বার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:৩০ পিএম, ১০ জানুয়ারি ২০২৩ মঙ্গলবার

রক্তের প্রয়োজনীয়তা এমন একটি বাস্তবতা, যা উপলব্ধি না করলে মনে হবে যে, আমরা আসলে এই পৃথিবীর বাসিন্দা হতে পারিনি।

আমি জানতাম না, আমার বড় মেয়েটি থ্যালাসেমিয়া বাহক! সাধারণ সড়ক দুর্ঘটনা অথবা অন্যান্য দুর্ঘটনায় রক্তের প্রয়োজন হয়। এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু রক্তের প্রয়োজনের ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া রোগীর একটা প্রতিরোধ করার উপায় আছে।

আমি কিছুদিন আগে থ্যালাসেমিয়া সমিতির একটা সভাতে গিয়েছিলাম। সেখানে মনোযোগ সহকারে শুনেছি এবং আমি মিলিয়ে দেখলাম যে, এর সাথে আমার একটা আত্মার সম্পর্ক আছে।

আমি জানতাম না যে, আমার বড় মেয়েটি থ্যালাসেমিয়া বাহক।

জানলাম কেমন করে? ওর যখন ছোট বয়স তখন ওর রক্তশূন্যতা দেখা দিল। স্বাভাবিকভাবেই ডাক্তাররা আয়রন খেতে দিল।

তারপর যখন উল্টা প্রতিক্রিয়া হওয়া শুরু হলো তখন ডাক্তার মহোদয় বললেন, স্যার! টেস্ট করতে হবে।

আমি বললাম, কি টেস্ট? বলে যে, থ্যালাসেমিয়া। টেস্ট করা হলো। ধরা পড়ল, আমার মেয়ে থ্যালাসেমিয়ার বাহক। উত্তরাধিকার সূত্রে আমি-ই আসলে থ্যালাসেমিয়ার বাহক!

তারপর ডাক্তার বলল যে, এই থ্যালাসেমিয়া সে কারো কাছ থেকে জীবাণু হিসেবে পায় নি। সে পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে। তো হতে পারে আপনি অথবা আপনার স্ত্রী দুজনেরই কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক!

আমি বললাম যে, তাহলে কী করতে হবে? বলে, স্যার! আপনারা দুজনই টেস্ট করে নেন। টেস্ট করলাম। টেস্ট করার পরে দেখা গেল, আমি থ্যালাসেমিয়ার বাহক। যদিও আমার রক্তশুন্যতা আমার মেয়ের স্তরের না।

তারপর আমি বললাম, তাহলে আমিও তো কোথাও থেকে বহন করছি। কী করা যায়? আমার বাবা নাই। মা-কে খুঁজলাম। মাকে টেস্ট করালাম। দেখলাম যে, মায়ের কাছ থেকে আমি পেয়েছি। মা কোথা থেকে পেয়েছে এটা আমি জানি না।

তার মানে হচ্ছে, আমাদের কপাল ভালো! আমার মায়ের থ্যালাসেমিয়া ছিল, বাবার ছিল না। আমার আছে, আমার স্ত্রীর নেই।

আমার মেয়ে ডাক্তার। সে বিয়ের আগেই রক্ত পরীক্ষা করে নিয়েছে এবং নিশ্চিত হয়েছে যে, আরেকজন বাহকের সাথে যেন তার বিয়েটা না হয়।

থ্যালাসেমিয়া সমিতির সভাপতি দীদার বখত যিনি এক সময় তথ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিনি আমার খুব প্রিয় মানুষ। তার স্ত্রী আমার সহকর্মী ছিলেন সাংবাদিকতার জীবনে।

সেই সূত্র ধরেই তিনি আমাকে সেই সভাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি এ ব্যাপারে আমাদের টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে এসএমএস পাঠিয়ে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করছি।

এখানে যারা আছে আপনারা কেবলমাত্র শ্রদ্ধেয় না, আমি মনে করি, জাতির সূর্যসন্তান আপনারা। কারণ মানুষ যে স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে পারে আমাদের এই ধারণাই ছিল না।

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন ধারণা ছিল এই যে, পেশাদার রক্তদাতার কাছ থেকেই এই রক্ত কিনতে হয়! এবং দাম খুব বেশি তা না কিন্তু কিনতে হয় এটা হচ্ছে বড় জিনিস।

এই যে রক্ত কেনাবেচার বিষয় ছিল, পেশাদার ছিল আবার দালালও ছিল। এই অবস্থা থেকে কিন্তু আমরা প্রথম জানতে পারলাম যে, কোয়ান্টাম-ই একমাত্র স্বেচ্ছায় রক্ত বিতরণ করে।

এরকম ফুটফুটে একটি মেয়ে বেঁচে থাকতে পারত না। চিন্তা করে দেখেন তো! একটু আগে যে ফুটফুটে মেয়েটা অনুভূতি বলল, আমি শুনলাম, মাসে বোধ হয় তিন-চার বার তার রক্ত লাগে।

এরকম একটি মেয়ে বেঁচে থাকতে পারত না নিঃসন্দেহে। রক্ত কেনাটা না হয় কিছু টাকার প্রশ্ন! পাওয়াটা তো হচ্ছে তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করব, আপনারা এই স্লোগানটা দেবেন যে, থ্যালাসেমিয়ার বাহকে বাহকে যেন বিয়ে না হয়!

এবং আমাদের নতুন প্রজন্ম এখানে যারা আছেন যারা বিয়ে করবেন, অনুগ্রহ করে আপনারা যদি নিজেরা নিজেদেরকে একটু সতর্ক করেন তাহলেই দেখতে পাবেন যে, ইচ্ছা করলেই এই দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যেতে পারবেন।

মেয়েটির দুর্ভাগ্য হয়তো তার বাবা অথবা মা দুজনই হয়তো বাহক। দুই বাহক হলে কিন্তু সন্তান নিঃসন্দেহে থ্যালাসেমিয়া রোগী হবেই। এই যে বিষয়টা অধিকাংশ মানুষই জানেন না। এটার ফলে থ্যালাসেমিয়া দিনে দিনে বাড়ছে।

দুর্ঘটনায় সবাই নিহত হয়েছে শুধু সেই রক্তদাতা ছাড়া!

আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে, আমরা রক্ত বেঁচে তো জীবনযাপন করি না। রক্ত বেঁচে জীবনযাপন করার বিষয় না। আমাদের জীবনযাপন নির্ভর করে মেধা, শক্তি সৃজনশীলতার ওপর।

তাহলে আল্লাহ যে সম্পদটা দিয়েছেন ‘রক্ত’, সেই রক্তটা যদি আমি অন্যের জন্য দিতে পারি তাহলে আমারই কল্যাণ হবে।

এ বিষয়টি বুঝতে হবে যে, আসলে আমরা যখন মানুষের জন্যে কিছু করি, আল্লাহ আমার জন্য তার চাইতে হাজার হাজার গুণ বেশি করে ।

এই মেয়েটির মতো মুহূর্ত গুণতে না হয়, কখন তার রক্ত যোগাড় হবে এবং সেই রক্ত সে ট্রান্সমিশন করবে! এবং এটি দলমত নির্বিশেষে যেকোন বিষয়ের ক্ষেত্রে যদি আমরা এটিকে মনে ধারণ করি, হৃদয়ে লালন করি, তাহলে কিন্তু আমরা কত লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে পারি এটি একটু চোখ বুজে চিন্তা করলেই বোঝা যেতে পারে।

মানুষ তার নিজের কর্মের জন্যে শ্রদ্ধেয় হয়। স্বেচ্ছাকার্যক্রমের জন্যে সমগ্রজাতি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ আপনারা কেবলমাত্র এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে দিচ্ছেন তা না, এই রক্তের সাথে কিন্তু জীবন জড়িত আছে। এবং এই জীবন জড়িত থাকা মানে হচ্ছে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীবকে আপনি রক্ষা করছেন। এর চাইতে ভালো কাজ আর কী হতে পারে!

এমএম/

একটি রক্তদান অনুষ্ঠানের বক্তৃতা থেকে নেওয়া।