ঢাকা, শুক্রবার   ১১ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ২৫ ১৪৩১

বিনয় মানুষকে বড় করে, কিভাবে হবেন বিনয়ী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৩৯ পিএম, ১১ জানুয়ারি ২০২৩ বুধবার | আপডেট: ১২:৪১ পিএম, ১১ জানুয়ারি ২০২৩ বুধবার

বুদ্ধদেব বলতেন, কোথাও গেলে এরকম জায়গায় বসবে যেন উঠতে না হয়। গান্ধী সারাজীবন থার্ড ক্লাস চলতেন। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলতেন, Ther is no fourthclass. যারা বড় মানুষ তারা বিনয়ী, তাদের আমিত্বকে সম্পূর্ণভাবে মিটিয়ে দেয়। তখনই মানুষ সত্যিকার বড় হতে পারে।

বিনয় মানব চরিত্রের অন্যতম ভূষণ, বিনয়ী মানুষের কদর সর্বত্র। বিনয় জীবনে সত্যিকারের সফলতা অর্জন করার অন্যতম হাতিয়ার।

বিনয়ের সমার্থক শব্দ আদব। আর আদব হলো একটা জিনিসকে যথাসময়ে যথাস্থানে রাখা। আমরা জুতা পায়ে পড়ি, টুপি মাথায় দেই। জুতাকে মাথায় আর টুপিকে পায়ে লাগালে আদবের বরখেলাপ হয়। জীবনের সার্থকতা তখনই পূর্ণতা পায় যখন একজন মানুষ পরিপূর্ণভাবে বিনয়কে নিজের চরিত্রে প্রতিভাত করতে পারে।

বিনয় উন্নতির পথে প্রধান সোপান, বিনয়ে মানব হয় মহাময়ীয়ান। মধুর ভাষায় কাজ হইবে সফল, তিক্তভাষী পাবে মনে বেদনা কেবল। মহাজ্ঞানীর মাথা বিনীত সতত, ফলভারে শাখা হয় যতো অবনত।

গ্রেট ফিলসফার, দার্শনিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক উইল ডোরান্ট বলেছেন, কোনো জ্ঞানী মানুষের কাছে যখন বিনয়ের ভূষণ থাকবে সৃষ্টা তাকে মহাজ্ঞানী করবেন। আর পণ্ডিতের কাছে যদি বিনয়ের ভূষণ থাকে তিনি মহাপণ্ডিত হবেন। সুন্দরীদের মধ্যে যদি বিনয় থাকে তাদেরকে মহাসুন্দরী করবেন।

রবীন্দ্রনাথ যে কাব্যের উপর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, সেই গীতাঞ্জলি ইংলিশ ট্রান্সলেট করার পর নোবেল কমিটি তাঁকে বিশ্ব অলঙ্কারে অলোঙ্করিত করেছেন। সেই গীতাঞ্জলির প্রথম কবিতা বিনয়ের উপর।

আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার

                     চরণধুলার তলে।

          সকল অহংকার হে আমার

                     ডুবাও চোখের জলে।

                            নিজেরে করিতে গৌরব দান

                            নিজেরে কেবলই করি অপমান,

                            আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া

                                       ঘুরে মরি পলে পলে ।

                            সকল অহংকার হে আমার

                                       ডুবাও চোখের জলে ।

 

          আমারে না যেন করি প্রচার

                      আমার আপন কাজে ;

          তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ

                      আমার জীবন-মাঝে ।

                            যাচি হে তোমার চরম শান্তি

                            পরানে তোমার পরম কান্তি

                            আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও

                                        হৃদয়পদ্মদলে ।

                            সকল অহংকার হে আমার

                                        ডুবাও চোখের জলে ।

পৃথিবীর ইতিহাসে সাহিত্যের ভান্ডারে বিনয়ের উপর এরকম নিবেদন খুব কমই আছে।

বিখ্যাত কবি শেখ সাদির একটি কবিতা ‘একে কাতরাহে বাল রাজি আবরে সফি’ আকাশের মেঘমালা থেকে এক ফোটা পানি বৃষ্টি হয়ে সাগরে পতিত হলো, সাগরে বিশাল জলধি। আর তার সামনে এক ফোটা পানি। সে নিজেকে অতি বিনীত, অতি অনুগত, বাধিত, একান্ত, সংযত, নিবেদিত, ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র ভাবতে শুরু করলেন।

যারা নিজেকে ছোট মনে করে আল্লাহ তাদেরকে বড় করেন। ছোট্ট পানির ফোটা যখন সে নিজেকে অতি ছোট থেকে মহাছোট ভাবতে শুরু করলো, আল্লাহর দয়ার সাগরে ঢেউ আসলো। আল্লাহ একটা ঝিনুক পাঠালেন, ঝিনুক বললো পানির ফোটা তুমি  নিজেকে দুর্বল ভেবো না। আমরা তোমার সঙ্গে আছি। আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন, তুমি আমার বুকে আশ্রয় গ্রহণ করো।

বিনীত পানির ফোটা ঝিনুকের বুকে আশ্রয় নিলো। আল্লাহ খুশি হয়ে মহা মূল্যবান মণিমুক্তা বানিয়ে দিলেন। এখন সে রাজমুকুটে শোভা পাচ্ছে।

এই বিনিময়ের উপর শেখ সাদি বলেছেন, এই পৃথিবীতে প্রতিবছর একটা বসন্তকাল আসে। এরকম শত শত বসন্তকাল পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলে গেছে। বলছেন, শত শত ঋতুরাজ বসন্তের দ্বারা কখনও তুমি কঠিন পাথরে সুজলা সুফলা বাগান, ফলমূল জন্ম লাভ করতে দেখেছো। মাটি হয়ে যাও, তাহলে নানা রঙের ফুল এতে জন্ম নেবে।

ফুলের বাগান কেবল মাটিতেই জন্মে থাকে, পাথরে নয়। দীর্ঘদিন অন্তর বিধারক পাথর হয়ে রয়েছো, পরীক্ষামূলকভাবে হলেও অল্প সময়ের জন্য মাটি হয়ে যাও। দেখতে পাবে তোমার ভেতর কতো সুন্দর সুন্দর ফুলেফলে পরিপূর্ণ উদ্যান জন্ম লাভ করেছে।

পাষণ হৃদয়ে আল্লাহর মারেফাতের উদ্যাগ কোনোদিন জন্মে না। এতে ফুলও ফোটে না ফলও ধরে না। তাই মানুষকে সর্বাঙ্গীন নিরীহ, নির্লোভ, বিনীত, নির্মোহ ও প্রেমিক হতে হবে।

আল্লাহর সৃষ্টিকে ভালোবাসলে আল্লাহকে ভালোবাসা হবে। ভালোবাসার মাধ্যমে কেবল আমরা বিশ্বকে জয় করতে পারি।

কবি এসটি কলরেস বলেছেন, He prayth best who loveth best, graters small.

জালালুদ্দিন রুমি, যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে পৃথিবী স্বীকৃত। উনি ১২০৭ সালে জন্ম নেন বালকে। জালালুদ্দিন রুমি বলেছেন, তোমরা জীবনে যদি বড় হতে চাও, বিনয়ের ভূষণে নিজেদের জীবনকে সাজাতে থাকো।

বিনয়ের ব্যাপারে দুটি সহি হাদিস- মা আয়েশা সিদ্দিকী (রা,) বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই রসুল (সা.) বলেছেন- আল্লাহ স্বয়ং নম্র, তাই তিনি নম্রতাকেই ভালোবাসেন। তিনি কঠোরতার জন্য যা দান করেন না তা নম্রতার জন্য দান করেন। নম্রতা ছাড়া অন্য কিছুতেই তা দান করেন না।

আরেকটি হাদিস হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, নিশ্চয়েই রাসুলে (সা.) বলেছেন- দানের দ্বারা সম্পদ কমে না, ক্ষমার দ্বারা আল্লাহর বান্দার ইজ্জত ও সম্মান বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কিছুই করেননা। আর যে মানুষ কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সে বিনীত হয়, বিনয় ও নম্রতা নীতি অবলম্বন করে আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।

শ্রীমত ভগবত গীতা প্রথম কথাটা বলেছেন বিনয়ের উপর। তোমার ঔদ্ধত্য, তোমার অহঙ্কার দূরিভূত করে দাও, বিধাতার করুণার বারি তোমার উপর বর্ষিত হবে।

(বক্তৃতা থেকে অনূদিত)

এএইচ