ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

পারিবারিক সুখ কমে যাওয়ার কারণ ও করণীয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:৩৬ পিএম, ১১ জানুয়ারি ২০২৩ বুধবার

প্রতিবেদনের শুরুতেই দুটি পরিবারের চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি মধ্য বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার। কর্মস্থল থেকে ক্লান্ত-শ্রান্ত গৃহকর্তা ঘরে ফিরে সংযুক্ত হচ্ছে বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে। ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েরা ছুটোছুটি করছে, কানামাছি লুকোচুরি খেলেছে। বড় ভাই-বোনেরা অনুজদের পড়া শিখতে সাহায্য করছে। অবসর সময়ে একসাথে বসে গল্প করছে পরিবারের সবাই।

দ্বিতীয় চিত্রটিতে রয়েছে- সিরিয়ালের ফাঁকে ফাঁকে ঘরের কাজ করছে গৃহকর্ত্রী। ছেলে-মেয়েরা স্কুল থেকে বাসায় ফিরেই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে কার্টুন-গেমস-টিকটক নিয়ে। সারাদিন অফিস করে বাসায় ফিরে গৃহকর্তা ফের মগ্ন হচ্ছে ফেসবুক টুইটার লিংকড-ইনে।

গৃহকর্ত্রী জানে না আজ কর্তার অফিসে কী হ্যাপা গেল। কর্তা জানে না সন্তানের সামনে কোন ক্লাস টেস্ট। সন্তান জানে না তাদের বেড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মায়ের মেহনত।

চিত্র দুটি বলে দিচ্ছে এর সময়কাল। আজ থেকে ২/৩ দশক আগেও বাংলার অনেক পরিবারের চিত্র ছিল প্রথমটি, যেখানে একেকটি পরিবার ছিল মায়া-মমতায় ঘেরা ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড়, সুস্থ বিনোদনে সুখী পরিবার। কিন্তু প্রযুক্তি যত সহজলভ্য হতে থাকল আর নির্মল বিনোদনের জায়গা নিল সিরিয়াল, ওয়েব সিরিজ, অনলাইন গেমস আর পশ্চিমা ভাবধারার বিনোদন, ততো ঢিলে হতে থাকল আমাদের শক্তির জায়গা ‘পারিবারিক বন্ধন’। আমরা হারাতে থাকলাম পারিবারিক সুখ।

বর্তমানে এমন টিভি সিরিয়াল পাওয়া দুষ্কর যেখানে পারিবারিক অশান্তি নেই। প্রতারণা-পরকীয়া, ঝগড়া-কুটিলতা, সন্দেহ-ঈর্ষা, অশ্লীলতা-অশালীনতায় ভরপুর একেকটি সিরিয়াল দেখতে দেখতে দর্শকের মনও দূষিত হয়ে পড়ে, বদলে যায় মস্তিষ্কের কর্মকাঠামো। ফলশ্রুতিতে তারাও আক্রান্ত হন এইসব কলুষে। স্বামী-স্ত্রী হারাতে থাকে পারস্পারিক সমঝোতা ও সম্মানবোধ, দাম্পত্য সম্পর্ক ভারাক্রান্ত হয় সন্দেহবাতিকতায়।

দাম্পত্য কলহ
স্বামী অফিস শেষে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে অনলাইন সিরিজ কিংবা চ্যাটিংয়ে বুঁদ হয়ে যাচ্ছেন। অথচ স্ত্রী সারাদিন স্বামীর অপেক্ষায় ছিলেন মনের কথাগুলো বলার জন্যে।

সারাদিন পেশাগত অনেক ধকল কাটিয়ে ঘরে ফিরে স্বামী হয়তো চাইছেন স্ত্রীর সাথে দুটো সুখ-দুঃখের কথা ভাগাভাগি করে হালকা হতে। কিন্তু স্ত্রী চাইছেন না ‘অমুক’ সিরিয়াল মিস করতে।

এভাবেই না-বলা কথাগুলো মনের ঝুলিতে জমা হতে থাকে। দাম্পত্য সম্পর্কে সৃষ্টি হয় মান-অভিমান, বাড়ে বোঝাপড়ায় ঘাটতি।

কথার কথা নয়, জরিপের ফলাফল প্রমাণ করছে এই বক্তব্যের সত্যতা!

সোশ্যাল মিডিয়া-ঘটিত মতানৈক্য এখন দায়ী প্রতি তিনটি বিবাহবিচ্ছেদের একটির জন্য- জরিপের ফলাফল এটিই।

সাম্প্রতিক আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, আমাদের দেশে মা-বাবার সঙ্গে তরুণদের দূরত্ব বাড়ছে, যার হার ৭৮.১ শতাংশ। পারিবারিক বন্ধন কমেছে- এমনটা বলেছে জরিপের ৭৮.২ শতাংশ মানুষ।

আসলে পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে যখন ‘দূরত্ব’ ব্যাপারটি ঢুকে যায় তখন আপনাতেই ঢিলে হয়ে যায় সম্পর্কের বন্ধন, হ্রাস পায় মমতা-সমমর্মিতা-মনোযোগ। ফলশ্রুতিতে কমে পারিবারিক সুখ।

পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে জরুরি
পরিবার মানে কেবল একসাথে থাকা নয়, পরিবার হলো ভাগাভাগি বা শেয়ারিং। একজনের খামতি আরেকজন পূরণ করবে, একজনের সমস্যায় আরেকজন দেবে মানসিক আশ্রয়। আর এর সবকিছুর জন্যে প্রয়োজন মনোযোগ।

কিন্তু এখন শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ যতটা মনোযোগ আর সময় অসুস্থ বিনোদনে মজে নষ্ট করে তার কিয়দাংশ দেয় না পরিবারের প্রিয় মানুষটির প্রতি। ফলে হারায় পারিবারিক সুখ।

তাই বর্জন করতে হবে অসুস্থ বিনোদন, পরিবারকে দিতে হবে কোয়ালিটি সময়।

আসলে আধুনিক সময়ের সমস্ত ব্যস্ততার মধ্যেই নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিমিয়ের জন্যে কিছু সময় বের করা জরুরি। আর এক্ষেত্রে ভালো উপায় হলো পরিবারের সবাই একত্রে খাওয়া-দাওয়া করা, একবেলা হলেও। এ সময়টিতে টিভি কম্পিউটার স্মার্টফোনে মনোযোগ দেবেন না। এমনকি পাশে বসে খেতে খেতেও এগুলো দেখবেন না।

বাসায় মেহমান এলে পুরো সময় ও মনোযোগ তাকে দিন। মেহমান হয়ে কারো বাসায় গেলে টিভি-কম্পিউটারে বসবেন না।

ছুটিছাটার দিনগুলোতে কোথাও ঘুরে আসতে পারেন, যেতে পারেন আত্মীয়ের বাসায়। ‘সপ্তাহে একদিনই তো ছুটি পাই’ এই বাহানায় ডিভাইজে মগ্ন হবেন না।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নয়; ঈদ, জন্মদিন বিয়েবার্ষিকী উদযাপন করুন বাস্তবে।

সর্বোপরি, দৃষ্টিভঙ্গি বদলান; বদলে নিন বিনোদনের সংজ্ঞা। অনলাইনে হালকা বিনোদনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করার বদলে প্রিয়জনের সাথে সুখ-দুঃখের দুটি কথা মন খুলে বলেই দেখুন না, কতটা হালকা ও তরতাজা লাগে!
এসএ/