ভালো থাকার আছে উপায়
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৪:০৭ পিএম, ১১ জানুয়ারি ২০২৩ বুধবার
সুখ-দুঃখ জীবনের এক স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা। কিন্তু দুঃখ তখনই ক্ষতিকর যখন একজন মানুষ দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে যায় অর্থাৎ ডুবে যায়। দুঃখ মানুষকে তিলে তিলে গ্রাস করে। জীবন চলার পথে দুঃখ আসতে পারে, কিন্তু দুঃখ যেন আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে না পারে। এ জন্য দুঃখকে কীভাবে শক্তিতে রূপান্তর করা যায় তা জানা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন ভালো থাকার উপকরণ সম্পর্কেও জানা।
আসলে যারা ভালো থাকতে চায়, নিজেকে বদলাতে চায়, কোনো বাধাই তাদের আটকে রাখতে পারে না। দুঃখ-কষ্টকে যদি শক্তিতে পরিণত করা যায় তা একজন মানুষের অন্তর্গত শক্তিকে জাগ্রত করে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার শিক্ষা দেয়।
অপরদিকে যদি কেউ মনের মধ্যে পুষতে থাকে তাহলে তা মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয়। ফলে এ দুঃখ কষ্টগুলোই একসময় তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করে।
সাধারণ মানুষ দুঃখকে হতাশায় রূপান্তরিত করে। আর একজন ধ্যানী দুঃখকে কল্যাণশক্তি, আধ্যাত্মিক ও সৃজনশীল শক্তিতে রূপান্তরিত করেন। আমাদের মনে রাখতে হবে দুঃখ যত বড় হোক না কেন আমাদের শক্তি তার চেয়েও বড়।
পৃথিবীর সকল মহামানবদের এবং যারা সফল হয়েছেন তাদের জীবনেও দুঃখ ছিল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের অনেকের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণেই ছিলো। কিন্তু তারা প্রত্যেকে তাদের দুঃখকে শক্তিতে পরিণত করে জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেন, শতকরা ৭৫ ভাগ রোগের কারণ মনোদৈহিক।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় বলেছেন- সে সকল দিন, সেও চলে যায়, সে অসহ শোক, চিহ্ন কোথায়! যায়নি তো রেখে, ধরণীর গায় অসীম দগ্ধ রেখা। অর্থাৎ দুঃখের তীব্রতা যত বড় ও ব্যাপক হোক না কেন সময়ের সাথে সাথে তা ফিকে হয়ে যায়।
মানুষ বিভিন্ন কারণে দুঃখ পেতে পারে। আমরা কিছু কারণ দেখতে পাই। যেমন-
কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হলে
মানুষ যখন তার কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পায় তখন তার দুঃখ হয়। যার পরিণতি অনেক সময় ভয়াবহ হতে পারে। যেমন : অনেক ছাত্র আছে যারা পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল করতে না পারলে দুঃখে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে।
প্রিয়জনের মৃত্যু বা বিচ্ছেদ হলে
আসলে মৃত্যু প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক ঘটনা আর প্রিয়জনের মৃত্যুতে কষ্ট হয় না এমন কোনো মানুষ নেই। অনেকে আছেন এ দুঃখ সইতে পারেন না। অনেক সময় তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
শারীরিকভাবে অক্ষম হলে
যারা শারীরিকভাবে অক্ষম তারা সাধারণভাবে নিজের মধ্যে দুঃখ বয়ে বেড়ান যে তারা সুস্থ স্বাভাবিক নন। অথচ শারীরিক অক্ষমতা কোনো মানুষের জীবনে সফল হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক নয়।
কখনো কখনো দুঃখের কারণ যথার্থ হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুঃখ আমাদের নিজেদেরই সৃষ্টি।
মহামতি বুদ্ধ দীর্ঘ সাধনায় জীবনের সহজ সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন। তিনি বলেছেন, জীবনে দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখ দূর করার উপায়ও আছে।
দুঃখের কারণ আসক্তি, আসক্তির কারণ অবিদ্যা। জীবন থেকে অবিদ্যা দূর করতে পারলেই মানুষের জীবনে অধিকাংশ দুঃখ এড়ানো সম্ভব।
সেরকম কিছু উদাহরণ দেখা যেতে পারে- আমাদের দেশের সদ্য প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আহমেদ-এর পিএইচডি করার সময়কালীন ঘটনা। আমেরিকার একটি ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছিলেন। তখন তিনি থিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রি নামে একটি সাবজেক্ট নেন। প্রথম প্রথম তিনি এই বিষয়ে কিছুই বুঝতেন না। টিচার লেকচার দিয়ে যেতেন আর তিনি হা করে তাকিয়ে থাকতেন। প্রথম যে পরীক্ষা হলো ঐ পরীক্ষায় তিনি খাতায় কিছুই লিখতে পারলেন না। পরের দিন রেজাল্ট বের হলো। দেখা গেল একজনমাত্র ছাত্র শূন্য পেয়েছে, আর সেটা তিনি। আর সবচেয়ে বেশি পেয়েছে এক অন্ধ ছাত্র।
এরপর শিক্ষক তাকে ডেকে সাবজেক্ট পরিবর্তন করতে বললেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ বললেন- আমি ছাড়বো না। একটি অন্ধ ছেলে যদি ‘এ’ পেতে পারে, তবে আমি না কেন?
দিন-রাত পরিশ্রম করতে লাগলেন। একসময় তার মনে হলো, এখন আর কোনো পরীক্ষায় তাকে আটকানো সম্ভব নয়। পরীক্ষা দিলেন, যথারীতি রেজাল্ট হলো এবং দেখা গেল এবার ঐ সাবজেক্টে ‘০’ নয়, তিনি ১০০-তে ১০০ পেয়েছেন। যে টিচার তাকে সাবজেক্টটি ছাড়তে বলেছিলেন তিনি তাকে চিঠি লিখলেন যে-তুমি চাইলে আমার সাথে এই বিষয়ে কাজ করতে পারো। আমি তোমাকে ফেলোশিপের ব্যবস্থা করে দেবো। তোমাকে কষ্ট করে আর টিচিং এসিসটেন্টশিপ করতে হবে না।
অমর সুরস্রষ্টা বিটোভেন। তাকে ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড সংগ্রামে বড় হতে হয়েছে। তারপরও সবকিছুর মধ্য দিয়েই চলছিলো সুরসৃষ্টির কাজ। কিন্তু বিটোভেনের জীবনে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডির সূচনা হয় যখন মাত্র ২৬ বছর বয়সে, তিনি হারাতে শুরু করেন তার শ্রবণশক্তি। মৃত্যুর আগে ১৫টি বছর তিনি পুরোপুরি বধির ছিলেন। ভাবা যায় একজন মানুষ সংগীত সৃষ্টি করে চলেছেন, অথচ শুনছেন না কিছুই!
বাজানোর সময় বিটোভেন একটা লম্বা লোহার রড কামড়ে থাকতেন যার আরেক মাথা লাগানো থাকতো পিয়ানোর সাউন্ডবোর্ডে। লোহার রডের মধ্য দিয়ে বাজনার কম্পন নিজের চোয়ালে অনুভব করে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন সুরের বৈচিত্র্যকে। তার অমর সৃষ্টি নাইনথ্ সিমফোনির প্রথম প্রদর্শনীর দিন বাজনা শেষে মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকরা যখন তুমুল হৈচৈ করছে, তখন বিটোভেন শুনছিলেন না কিছুই। মনে করলেন, শ্রোতারা বোধ হয় তার বাজনা পছন্দ করে নি। ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
মানব ইতিহাসে যিনি সবচেয়ে বেশি দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন- তিনি হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ সাঃ। নবীজীর জীবন সাফল্যমণ্ডিত জীবন। অবশ্য এ সাফল্যের অনেকগুলো রহস্য রয়েছে। তার মধ্যে একটি রহস্য হচ্ছে তাঁর জীবনের কষ্ট ও দুঃখ।
কষ্ট এবং দুঃখ অনুভব করা ছাড়া মানুষ কখনো মহৎ হতে পারে না। কারণ যিনি নিজে দুঃখ পান নি তিনি অন্যের দুঃখকে কখনো উপলব্ধি করতে পারেন না।
মানুষের জীবনে যত ধরনের কষ্ট হতে পারে প্রতিটি কষ্ট তিনি তাঁর জীবনে পেয়েছেন। জন্মগ্রহণ করার ৬ মাস আগে তাঁর বাবা মারা যান। তিনি জীবনে কখনো কাউকে বাবা বলে ডাকতে পারেন নি। ৬ বছর বয়সে তাঁর মা মারা যান। ছোটবেলাতেই তিনি মেষ চরাতে যেতেন এবং ১২ বছর বয়সে তিনি মরুভূমির সেই কষ্টকর বাণিজ্যযাত্রা শুরু করলেন চাচার সাথে। অর্থাৎ তিনি কখনোই কারো ওপর নির্ভরশীল থাকতে চান নি। সবসময় স্বাবলম্বী হতে চেয়েছিলেন।
যখন তিনি সত্যকে অনুভব করলেন, সত্যের সন্ধান পেলেন, শুরু হলো তার কষ্টের পালা। এমন কোনো নির্যাতন নেই যার সম্মুখীন তিনি হন নি। তাকে একঘরে করে রাখা হয়েছে, পাথর নিক্ষেপ করে রক্তাক্ত করা হয়েছে। তার এবং তার অনুসারীদের ওপর নির্যাতন আর মানসিক যন্ত্রণার তো কোনো শেষ ছিলো না। শেষ পর্যন্ত তিনি দেশত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন।
তিনি নির্যাতনের কষ্টকে ভোগ করেছেন, মজলুমের বন্দি হওয়ার কষ্টকে ভোগ করেছেন, আহত হওয়ার কষ্টকে ভোগ করেছেন, আপনজন হারানোর কষ্টকে ভোগ করেছেন। যার ফলে তিনি সবার দুঃখ কষ্টকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন গভীরভাবে।
আসলে মানুষের প্রতি তার এ মমত্ববোধের একটি উৎস হলো এই দুঃখ এবং কষ্ট। দুঃখকে জয় করে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হলে যত দুঃখই আসুক কৃতজ্ঞতা বোধ থাকতে হবে। সবসময় মনে রাখুন যে, আপনার চেয়েও দুঃখে কেউ আছে।
মহীয়সী নারী হেলেন কেলার বলেছিলেন যে, ‘যখন সুখের একটি দুয়ার বন্ধ হয়ে যায় তখন আরেকটি খুলে যায়।’ আমরা দুঃখিত হই তখনই যখন বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে থাকি। দৃষ্টিটাকে সরিয়ে অন্যদিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করলেই কিন্তু নতুন সম্ভাবনার দুয়ার, নতুন সুখের দিকে নজর পড়ে।
দুঃখকে জয় করতে হলে সবচেয়ে ভালো হলো কাজের মধ্যে ডুবে থাকা। তাই দুঃখবোধ হলেই কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিন। কারণ যত ব্যস্ততা তত আনন্দ।
দুঃখে পড়লেই অস্থির হয়ে উঠবেন না। সবর করুন। পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্যে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করুন, প্রার্থনা করুন।
সবসময় মনে রাখবেন আকাশে রংধনু ওঠার আগে সবসময়ই বৃষ্টি হয়। প্রকাশ যত তীব্র হবে দুঃখ তত লাঘব হবে। সন্তানের মৃত্যুতে মা হরিণ হৃদয় বিদারক কান্নায় চিৎকার করে উঠে। দুঃখের এই সুতীব্র প্রকাশের পর পরই সে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।
যারা কাঁদতে পারেন তাদের দুঃখ কখনো স্থায়ী হয় না। দুঃখ যখন কান্না আকারে বেরিয়ে যায় তখন শরীরের ভেতর থেকে কিছু বিষাক্ত কেমিকেল চোখের পানির সাথে বেরিয়ে যায়। চোখে বালু পড়লে যে পানি বেরোয়, সে পানির কেমিকেল কম্পোজিশন আর দুঃখজনিত চোখের পানির কেমিকেল কম্পোজিশন সম্পূর্ণ আলাদা। এভাবেই দুঃখের নেতিবাচক প্রভাব শরীর থেকে বেরিয়ে যায় কান্নার মাধ্যমে। মানসিক চাপ ভারসাম্য নষ্ট করে আর কান্না ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করে।
আমরা অনেক সময় কান্নাকে লজ্জার ভাবি বা মেয়েলি ভাবি। অথচ কান্না এক সম্পূর্ণ মানবীয় ব্যাপার। কান্না সহানুভূতি ও মমত্বকে আকর্ষণ করে। অশ্রু মমত্ব বাড়ায়।
ধম্মপদের শুরুতেই আছে ‘যদি একজন ব্যক্তি প্রসন্ন মনে কথা বলে অথবা কাজ করে, আনন্দ তাকে অনুসরণ করে তার আপন ছায়ার মতো’। এখানেই ধ্যান বা মেডিটেশনের প্রয়োজনীয়তা। মেডিটেশন আপনাকে প্রশান্ত করবে, আপনার অন্তর্গত শক্তির উৎসের সাথে আপনাকে সংযুক্ত করবে। আপনার মস্তিষ্কে সেরেটোনিনের প্রবাহ বাড়িয়ে দেবে। আপনি দুঃখ ভুলে আনন্দ অনুভব করবেন, আপনার দুঃখকে আপনি মেডিটেশনের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারবেন, মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারবেন।
এসএ/