অস্ট্রেলিয়া পড়তে যাওয়ার আগে নিবেন যে সব প্রস্তুতি
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১২:০০ এএম, ১২ জানুয়ারি ২০২৩ বৃহস্পতিবার
অস্ট্রেলিয়ার নতুন সরকার ২০২৩ সালে দক্ষ এবং পারিবারিক ভিসার জন্য স্থায়ী মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ১ লাখ ৬০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ ৯৫ হাজার করার ঘোষণা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে দেশটিতে কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা করার ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয়েছে অপার সুযোগ।
আমেরিকা, ইউরোপের মতো ওশেনিয়ার দেশ অস্ট্রেলিয়াতেও সুযোগ আছে নানা বিষয়ে পড়ার, আছে নানা ধরনের বৃত্তিও। যার ফলে দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছেন বাংলাদেশের বহু শিক্ষার্থী। সেখানে পড়ালেখার সুযোগ বা চ্যালেঞ্জগুলো কী?
সাধারণত, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের জন্য আবেদন করা যায়। অস্ট্রেলিয়ার সব বিশ্ববিদ্যালয়েই স্নাতকের সুযোগ আছে, তবে সব বিষয়ে পড়ার সুযোগ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ভর্তির সব তথ্য পাওয়া যাবে। উচ্চ মাধ্যমিকে ৬৫ শতাংশ নম্বর, আইইএলটিএস (IELTS) স্কোর অন্তত ৬.৫ নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রির জন্য আবেদন করতে পারছেন।
অস্ট্রেলিয়ায় পাঠরত বা পাঠ শেষ করা কয়েক শিক্ষার্থী, গবেষক, শিক্ষক ও পেশাজীবীদের অভিজ্ঞতার আলোকে আজ আপনাদের জানানোর চেষ্টা করব সেসব বিষয়।
অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য অনুসরণীয় ধাপ:
উচ্চশিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে ৭টি মূল ধাপ। এগুলো হলো- পড়ার পরিকল্পনা, বৃত্তির সুযোগ কেমন, বিষয় নির্বাচন, ভর্তির আবেদন, ভিসার আবেদন, দেশত্যাগের আগে করণীয় এবং অস্ট্রেলিয়াতে পৌঁছানোর পর করণীয়।
১. পড়ার পরিকল্পনা:
সর্বপ্রথম একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে দেখতে হবে, তার নিজের ক্যারিয়ারের জন্য কোন ধরনের কোর্স বা বিষয়ে সে আগ্রহী। সে কোন বিষয়ে পড়ালেখা করতে চায়, তার বর্তমান যোগ্যতা কতটুকু, সে যে বিষয়ে আগ্রহী তা শেষ করতে কত সময় লাগবে। সর্বোপরি, সে কোথায় এ বিষয়ে পড়তে আগ্রহী তাও ঠিক করা প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, একজন শিক্ষার্থী অস্ট্রেলিয়াতে চার ধরনের পড়ালেখার জন্য আসতে পারেন- বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি, কারিগরি ডিগ্রি, স্কুল-কলেজ এবং ইংরেজি ভাষা শিক্ষা।
প্রতিটি আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীকে পড়াকালীন খরচের কথা আগেভাগে চিন্তাভাবনা করে পরিকল্পনা করতে হয়। টিউশন ফি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিষয়ভেদে বিভিন্ন হয়। থাকা-খাওয়ার খরচও অস্ট্রেলিয়ায় স্থানভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে।
২. বৃত্তির সুযোগ কেমন?
অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে বৃত্তির নানা সুযোগ আছে। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মারডক বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে কীটতত্ত্বে পিএইচডি করছেন শোভন সরকার। তিনি বলেন, মাস্টার্স ও পিএইচডিতে বৃত্তির সুযোগ আছে অনেক। স্নাতক ও মাস্টার্সের ক্ষেত্রে টিউশন ফির ওপর ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃত্তি পাওয়া যায়। ভর্তি ও বৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে আইইএলটিএস স্কোর ও প্রাতিষ্ঠানিক ফল বিশেষ গুরুত্ব পায়।
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পাবলিক পলিসি বিষয়ে মাস্টার্স করছেন অ্যাওয়ার্ডস বৃত্তিধারী জোবায়ের হোসাইন। তিনি জানান, স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য প্রতিবছর অস্ট্রেলিয়া অ্যাওয়ার্ডস দেয় দেশটির সরকার। এ বৃত্তির আওতায় শিক্ষার্থী আসা-যাওয়ার বিমানভাড়া, পড়াশোনার যাবতীয় খরচ, থাকা-খাওয়ার খরচসহ গবেষণা এবং বইপত্রের জন্য অর্থ পান। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আংশিক তহবিল দেয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপসহ বিভিন্ন সরকারি বৃত্তির মাধ্যমেও পড়ার সুযোগ আছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় উচ্চতর শিক্ষায় ফেলোশিপ দেওয়ার জন্য আবেদন আহ্বান করে। বিস্তারিত: pmfellowship.pmo.gov.bd
মনে রাখা প্রয়োজন, ভিসার আবেদনের সময় প্রয়োজনীয় খরচের সামর্থ্য দেখাতে ব্যর্থ হলে সাধারণত ভিসার আবেদন গ্রহণ করা হয় না। এখানে স্নাতকপূর্ব কোর্সের আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের বেশিরভাগ পূর্ণ খরচ দিয়ে পড়ালেখা করে। কারণ স্নাতকপূর্ব কোর্সে আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তির সংখ্যা খুবই সীমিত এবং তাদের জন্য ঋণের ব্যবস্থাও নেই। অনুরূপভাবে ডিপ্লোমা ও অন্য কোর্সগুলোতে বৃত্তি নেই বললেই চলে। তবে স্নাতকোত্তর গবেষণাভিত্তিক কোর্সে বেশ কিছু বৃত্তি আছে, যেমন IPRS, AusAid, গ্র্যাজুয়েট বৃত্তি ইত্যাদি।
৩. বিষয় নির্বাচন:
অস্ট্রেলিয়ার সরকার বাইরের ছাত্রছাত্রীদের তাদের যেসব বিষয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়, সেগুলো থেকে একজন শিক্ষার্থীকে নিজের পড়ার পরিকল্পনা অনুসারে একটিকে বেছে নিতে হয়। সরকারি ওয়েবসাইটে একটি বিষয় বাছাই করার পর, সেই বিষয়টি যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ আছে, সেগুলোর তালিকা পাওয়া যায়। এখান থেকে এক বা একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাছাই করা যেতে পারে। এরপর দেখতে হবে, এসব বাছাইকৃত প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি পড়ার জন্য একজন শিক্ষার্থীর কী কী যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন, খরচ কেমন হবে ইত্যাদি। যোগ্যতার পরিমাপ প্রতিষ্ঠানটির মান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।
অনেক বিষয়ে (যেমন- এমবিএ) ভর্তির জন্য কাজের অভিজ্ঞতা একটি পূর্বশর্ত হতে পারে। এ ছাড়া ভর্তিচ্ছু একজন শিক্ষার্থীর আগের অ্যাকাডেমিক রেকর্ড ও ইংরেজি দক্ষতা (যেমন- IELTS) অস্ট্রেলিয়ার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ন্যুনতম চাহিদার কম হলে সাধারণত ভর্তি, বৃত্তি বা ভিসা কোনোটির আবেদনই বিবেচনা করা হয় না।
উল্লেখ্য, বৃত্তির জন্য আবেদন করলে ইংরেজি ভাষায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা (IELTS স্কোর) ভর্তির আবেদনপত্রের সঙ্গেই পাঠাতে হয়।
৩. ভর্তির আবেদন:
একজন শিক্ষার্থী একাধিক বাছাইকৃত প্রতিষ্ঠানে পৃথকভাবে ভর্তির আবেদন করতে পারেন। ভর্তির আবেদনপত্র সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা যায়। অথবা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি শাখায় যোগাযোগ করলে তারা সাধারণ ‘অ্যাপ্লিকেশন প্যাকেজ’ পোস্ট করে পাঠিয়ে দেয়। পূরণকৃত আবেদনপত্রের সঙ্গে আবেদনকারীকে আগের অ্যাকাডেমিক সনদপত্র সমূহ (মার্কশিট, ট্রান্সক্রিপ্ট), ইংরেজি ভাষার যোগ্যতা (যেমন- IELTS স্কোর) ও অভিজ্ঞতার সনদ সংযুক্ত করতে হয়। এর পর আবেদনকারী তার আবেনদপত্র সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এজেন্ট যেমন- EDUCATION@-এর মাধ্যমে বা সরাসরি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ভর্তি শাখায় পোস্ট করে পাঠাতে পারেন। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবেদনপত্র পাওয়ার পর আবেদনকারীর যোগ্যতা যাচাই করে তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফলাফল জানাবে।
৪. ভিসার জন্য আবেদন:
একজন আবেদনকারী কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অফার লেটার পেলে, স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়। আবেদনের জন্য নির্ধারিত ফরম পূরণ করে ভিসা আবেদন ফি-সহ জমা দিতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিসার জন্য আবেদনের আগে এক সেমিস্টারের টিউশন ফি পরিশোধ এবং অস্ট্রেলিয়ার সরকার অনুমোদিত যেকোনো কোম্পানির সঙ্গে এক বছরের মেডিক্যাল ইন্স্যুরেন্স করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তির নিশ্চয়তা সনদ (ECOE-Electronic Conformation of Enrolment) ইস্যু করে। যা ভিসার আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়। তারপর আবেদনকারীকে পড়াশোনার সময় খরচের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ টাকা ব্যাংকে আছে কি-না, তার ব্যাংক হিসাব ভিসার আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়।
উল্লেখ্য, বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় খরচের জোগান তাদের বৃত্তি থেকে দেখাতে পারে। প্রাপ্ত বৃত্তি কোন খাতে এবং বছরে কত দেবে, তা স্পষ্টভাবে অফার লেটারে উল্লেখ থাকে। খাত সমূহ হলো- টিউশন ফি, মেডিক্যাল ইন্স্যুরেন্স, থাকা, খাওয়া ইত্যাদি।
স্টুডেন্ট ভিসার সব যোগ্যতা পূর্ণ হলে অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশন সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীর জন্য প্রি-ভিসা (Pre-visa) ইস্যু করে। এ সময় নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে একজন অনুমোদিত ডাক্তারের কাছে মেডিক্যাল টেস্ট করাতে হয়। এর পর অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশন স্টুডেন্ট ভিসা ইস্যু করে। প্রাপ্ত স্টুডেন্ট ভিসায় পার্টটাইম কাজের অনুমতি না থাকলে, অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে এজন্য আবেদন করলে সাধারণত অনুমতি পাওয়া যায়।
৫. দেশত্যাগের আগে:
ভিসা পাওয়ার পর তারিখ নির্ধারণ করে বিমানের টিকিট কিনতে হয়। সাধারণত কোর্স শুরু হওয়ার ১-২ দিন আগে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছতে হয়। দেশত্যাগ করে নতুন জায়গায় যাওয়ার আগে একজন শিক্ষার্থীকে আরেও কিছু বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন- অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়ার উপযুক্ত পোশাক সংগ্রহ করা এবং প্রাথমিকভাবে থাকা-খাওয়ার জন্য অন্য কারেও সঙ্গে আগে থেকে যোগাযোগ করা ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সব বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (যেমন- মোনাশ, মেলবোর্ন, সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে) আন্তর্জাতিক অফিস ছাড়াও বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বা মুসলিম স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন আছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কোনো সাহায্যকারী বন্ধু পাওয়া যেতে পারে।
এ ছাড়া অনেক সময় সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীকে বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানকে আগেই জানিয়ে রাখতে হয়।
৬. পৌঁছানোর পর করণীয়:
কাগজে-কলমে ভর্তির শেষ ফরমালিটি সম্পন্ন হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে পৌছানোর পর। অনেক সময় কোর্স শুরুর আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের আয়োজন করে। সেখানে কোর্স সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। নতুন শিক্ষার্থীদের এরকম প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকা আবশ্যক।
এ ছাড়া থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ঠিকমতো না হলে প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
এনএস//