ঢাকা, শুক্রবার   ১১ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ২৬ ১৪৩১

পৌঁছে যাবেন লক্ষ্যপানে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০২:৪৭ পিএম, ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ শনিবার

মানুষ যা ভাবতে পারে যা বিশ্বাস করতে পারে– তা সে অর্জন করতে পারে। যখন ভাবনাটা বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয় এবং বিশ্বাসটা কর্মে রূপান্তরিত হয়, প্রচেষ্টায় রূপান্তরিত হয়। তখন এটা মিসাইলের মতো লক্ষ্যভেদী মনছবিতে রূপান্তরিত হয়।

আসলে অবচেতন মনে লক্ষ্যের ছবি যদি আপনি বসিয়ে দিতে পারেন, অবচেতন স্বয়ংক্রিয়ভাবে দিবানিশি কাজ করবে আপনাকে সেই গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার জন্যে। প্রয়োজনে পথ সংশোধন করবে। দুর্দমনীয় আগ্রহ উদ্যম সৃষ্টি করবে আপনার ভেতরে। সময় যাই-ই লাগুক, আপনি পৌঁছে যাবেন লক্ষ্যপানে। শুধু লেগে থাকতে হবে অবিচলভাবে।

আমরা সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ দিতে পারি। উদাহরণটা একজন চীনা গণিতবিদের। নাম ইতাং ঝাং। ছোটবেলা থেকেই গণিতের প্রতি তার ছিল প্রচন্ড ঝোঁক। বালক ঝাং স্বপ্ন দেখতেন, বড় হয়ে একদিন জটিল একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করবেন।

বয়স যখন তার ১২, চীনে শুরু হলো সাংস্কৃতিক বিপ্লব। সব স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। মায়ের সাথে ঝাংকে পাঠিয়ে দেয়া হল গ্রামে, কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্যে। ১০ বছর তিনি ক্ষেতে-খামারে কাজ করলেন।স্কুল কলেজে যেতে না পারলেও বইপত্র যোগাড় করে গণিত চর্চা করেছেন নিজে নিজেই। সাংস্কৃতিক বিপ্লব শেষ হওয়ার পর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু করলেন।

২৯ বছর বয়সে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে মাস্টার্স করলেন। কৃতি শিক্ষার্থী ছিলেন। ৩৫ বছর বয়সে আমেরিকার পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পেলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে ঢুকতে পারলেন না। গবেষণার সুযোগও তার জুটল না।তার পিএইচডি সুপারভাইজারও তাকে কোনো রিকমেন্ডেশন লেটার দেন নি।

কিন্তু ঝাং হতাশ হন নি। নতুনভাবে সংগ্রাম শুরু করলেন বেঁচে থাকার। এক বন্ধুর রেস্টুরেন্টে ক্যাশিয়ারের চাকরি নিলেন। রাত কাটাতেন প্রাইভেট কারে। কারণ ঘর ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য তার ছিল না। অবসর যখনই পেতেন, গণিত চর্চায় মেতে থাকতেন। নানা ধরনের কাজ করে উপার্জন করতে হতো তাকে। ৭ বছর পার হয়ে গেল আরো। ৪৪ বছর বয়সে তার এক গণিতবিদ বন্ধু ঝাংকে নিউহ্যাম্পশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম লেকচারারের চাকরি পেতে সহায়তা করলেন। ৪৪ বছর বয়সে পার্টটাইম লেকচারার এবং পরবর্তী ১৪ বছরেও কোনো প্রমোশন তাকে দেয়া হলো না। ঝাং হাল ছাড়লেন না। নিরবিচ্ছিন্নভাবে গণিতচর্চা করতে লাগলেন।

৫৮ বছর বয়সে ঝাংয়ের সেই ছোটবেলার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো। জটিল একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করলেন, যেটা বিশ্বের সেরা গণিতবিদরা দীর্ঘদিন ধরে সমাধানের চেষ্টা করছিলেন।

ঝাংয়ের সমাধান ছাপা হলো সবচেয়ে বনেদি জার্নাল এনালস অফ ম্যাথমেটিক্সে। অখ্যাত ঝাং রাতারাতি পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত গণিতবিদদের একজনে পরিণত হলেন। বড় বড় পুরস্কার, ফেলোশিপ, নিউইয়র্ক টাইমসসহ প্রভাবশালী পত্রিকা তার সাক্ষাতকার নেয়ার জন্যে লাইন ধরল।

প্রিন্সটন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে লেকচার দেয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানালো। নিউহ্যাম্পশায়ার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে তাকে প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি দিল। কিছুদিন পরে ঝাং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করলেন। তাকে বলা হয়, এই শতাব্দীর অন্যতম সেরা গণিতবিদ।

মনছবি পূরণ হতে ঝাংয়ের কত বছর লাগল? ৪৬বছর! তিনি কেন পারলেন? কোনো প্রতিকূলতা তাকে ভাঙতে পারে নি। তার যা সম্বল ছিল সেটা নিয়েই আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, “আই ওয়াজ বর্ন ফর ম্যাথ। ফর মেনি ইয়ার্স দ্যা সিচুয়েশন ওয়াজ নট ইজি। বাট আই ডিড নট গিভ আপ। আই জাস্ট কেপ্ট গোয়িং, কেপ্ট পুশিং”।

অন্ধকার যত আসুক, পথ চলতে থাকুন। অন্ধকার পার হয়ে আলোর দিগন্তে আপনি পৌঁছবেনই। আমরা অধিকাংশ মানুষ ভুল করি। আমরা থেমে যাই। হতাশ হয়ে যাই। অথচ আমাদের ধর্মের শিক্ষাই হচ্ছে - হতাশ হয়ো না। বিশ্বাস কর। বিশ্বাস করলেই তুমি বিজয়ী হবে।

অনন্য উদহারণ বেগম রোকেয়া

৯ই ডিসেম্বর রংপুরে তার জন্ম। আজ থেকে ১৪০ বছর আগে।

যে সময়ে ধর্মীয় অনুশাসনের নামে গৃহে অনেকটা বন্দীর জীবনযাপন করা ছিল নারীর ললাট লিখন। সেই সময়ে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন জ্ঞানী হওয়ার। বিশ্বাস করতেন তিনি জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন।

বাবার বাড়িতে খুব একটা সুযোগ পাননি। বিয়ের পর উদারমনা স্বামী সাখাওয়াত হোসেন তাকে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ করে দেন। স্বামীর উৎসাহে জ্ঞানচর্চায় তিনি এগিয়ে গেলেন।

১৯০৮ সালে, আজ থেকে ১১২ বছর আগে নিজের ভাবনাকে, নিজের স্বপ্নকে নিজের মনছবিকে, নিজের চাওয়াকে উপস্থাপন করলেন ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাসে। চাওয়াটা সময়ের এত আগে ছিল যে উপন্যাসকেও তার নামকরণ করতে হয়েছে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ হিসেবে।

আসলে একজন দূরদর্শী মানুষ চিন্তা-চেতনায় কতটা এগিয়ে থাকলে সেইসময় পরাধীন দেশে পর-অধীন নারী যাদের ভোটাধিকার, স্বাধীন পেশা নির্বাচনের অধিকার, এমন কি উচ্চশিক্ষা অর্জনের পথও ছিল রুদ্ধ, সেইসময়ে বেগম রোকেয়া এমন একটি দেশের কল্পনা করলেন যেখানে রাজা নেই, আছে রানি। আর তার নেতৃত্বে দক্ষ হাতে রাজ্যের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে নারীরা।

শুধু তাই নয়, রাজ্যের নারী-বিজ্ঞানীদের পরামর্শে সে রাজ্যে রান্না-বান্না, যুদ্ধবিমান সব চলছে সৌরশক্তিতে। কৃষিকাজে ব্যবহার করছে বৈদ্যুতিক শক্তি। রোকেয়ার চিন্তা সময়ের যে কত আগে ছিল এটাই তার প্রমাণ!

কত প্রতিকূলতা! ২৯বছর বয়সে তিনি বিধবা হলেন। নারীশিক্ষার প্রসারকে তিনি তার জীবনের মিশন হিসেবে স্থির করলেন। লক্ষ্য স্থির হলো। স্বামীর নামে ভাগলপুরে গার্লস স্কুল খুললেন। সম্বল পাঁচজন ছাত্রী ও একটি বেঞ্চ। টিকতে পারলেন না সেখানে। চলে এলেন কলকাতায়। আবার খুললেন একটি স্কুল। এবার দুটি বেঞ্চ। আটজন ছাত্রী। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করতেন। এর মধ্যে স্কুল চালানোর জন্যে যে ব্যাংকে টাকা জমা রাখা ছিল, সেটি দেউলিয়া হয়ে গেল। আস্তে আস্তে তার স্কুল প্রাইমারি, তারপর হাইস্কুলে পরিণত হলো। এক সময় তিনি উপলব্ধি করলেন একা বড় কাজ করা যায় না। সঙ্ঘ গড়তে হবে। নারীদের সংগঠিত না করলে তার স্কুল টিকিয়ে রাখা যাবে না। কলকাতায় গড়ে তুললেন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে মুসলিম নারীদের সংগঠন। পরবর্তী পর্যায়ে এই সংগঠনই ‘মহিলা সমিতি’র রূপ নেয়। বেগম রোকেয়া আক্ষরিক অর্থেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত নারী মুক্তির কাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। যে রাতে তিনি মারা গেলেন, সেদিনও রুটিন মাফিক কর্মব্যস্ত দিনের শেষে যথারীতি লিখছিলেন। কলম হাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
এসএ/