ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

৬ শত বছরে খোকসার কালী

ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়

প্রকাশিত : ০৬:৫৪ পিএম, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ মঙ্গলবার

কোনো সুদূর অতীতে খোকসা এবং খোকসার কালী জন্মলাভ করেছিল এবং একে অপরকে পরিচিত করতে করতে একদিন অভিন্ন হয়ে উঠেছিল, তার থেকে খোকসা  থানা ও উপজেলা। দীর্ঘদিন থেকেই খোকসা ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক ভূখণ্ড। ফলে খোকসা বর্তমানে সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় একটি পীঠস্থান। 

খোকসার কালীর এ যাবৎ কোন ইতিহাস পাওয়া যায়নি। কোনো গ্রন্হের বা কোন বৃদ্ধের পিতা- পিতামহ শ্রুত ইতিহাস ও প্রচলন নেই। যা আছে, তা ইতিহাস নয় কিংবদন্তী। ইতিহাসের আলো যেখানে অপ্রাপ্য সেখানে কিংবদন্তীর অন্ধকারেই পথ চলতে হয়।

খোকসার কালী সম্পর্কে যে সব আরো কিংবদন্তী ও লোক বিশ্বাস প্রচলিত আছে, তা সন্নিবেশিত করার ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। খোকসার কালীর আশির দশকে পূজারী শ্রী নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ ভট্রাচার্যের (দুলাল) ষোড়শ উর্দ্ধস্তন পুরুষ রামদের তর্কলংকার প্রথম এই পূজা আরম্ভ করেন। তিন পুরুষে দেড়শত বছর হিসাবে এই পূজার বয়স প্রায় ৬ শত বছর। রামদেবেরা দুই ভাই। রামদেব তর্কলংকার ও মহাদেব বাচস্পতি। কালক্রমে এর দুই ভাইই নলডাঙ্গা রাজার কালীপূজা করতেন। মহাদেব বাচস্পতি ৩য় অধ:তন পুরুষ বাণী সিদ্ধান্ত ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত। তৎকালীন কাশীর স্বনামখ্যাত বৃদ্ধ পন্ডিত রামধন বাচস্পতির সাথে একবার মাসাধিকাল ধরে বাণী সিদ্ধান্তের শাস্ত্র বিষয়ে তর্কযুদ্ধ চলে। 

বাণী সিদ্ধান্ত ছিলেন তখন যুবক। দীর্ঘ তর্কে যুদ্ধে কেউ কাউকে পরাস্ত করতে না পেরে বাণী সিদ্ধান্ত উত্তেজিত হয়ে রামধন বাচস্পতিকে ব্যাক্তিগত চর্চায় লিপ্ত হয়। ফলে রামধন বাচস্পতি ক্রোধান্ধ হয়ে অভিশাপ দেয় যে, বাণী সিদ্ধান্তের বংশে যে পন্ডিত হবে, সেই মারা যাবে। এই অভিশাপ দারুণভাবে ফলে যায়। বাণী সিদ্ধান্ত কাশী থেকে ফিরতে ফিরতে মহামারী লাগায় ন্যায় তাঁর বংশের অধিকাংশ পন্ডিতমন্ডলী মারা যায়।

এই বংশের, আরেকজন পন্ডিত অত্যান্ত বিখ্যাত হয়েছিলেন যিনি চণ্ডী দিয়ে মহিষ বধ করে ছিলেন। উক্ত পন্ডিতকে একদিন একটি ভীষণাকৃতির ক্ষিপ্ত মহিষ আক্রমণ করে তখন আত্নরক্ষার জন্য ঐ পন্ডিত হাতের চণ্ডীগ্রন্থ খানা ছুঁরে মারে। তাতেই মহিষ বলি হয়ে গেল। এই ঘটনার লক্ষ্য করেছিলেন নলডাঙ্গার রাজা এবং তিনি। এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ব্রাক্ষন বংশের ১০০ লোক সমন্বিত ৪টি শরিকের জন্য ১৪০০বিঘা জমি দেবোত্তর করে দেন। রাজা উক্ত জমি গ্রহণে রাজী ছিলেন না।কেননা দেবোত্তর জমি ভোগ করা যায়, বিক্রি করা যায় না। 

অত:পর উক্তজমি দেবোত্তর হিসাবে দেওয়া হয়। দেবোত্তর জমিতে ব্রাক্ষণের সর্বময় ক্ষমতা ন্যস্ত হয়। পূজারী নৃপেন্দ্র ভট্রাচার্য (দুলাল) ১২ বৎসর বয়স থেকে এই পূজা আরম্ভ করেন। পূজারীর মা শিখরবাসিনর কালীপূজার পুত্রকে সম্মতি দেননি। কেননা দুলাল ঠাকুরের এক ভাই অতি অল্প বয়সে মারা যায়। শিখরবাসিনী দেবীর ধারণা পূজায় কোন ত্রুটি হওয়ায় তাঁর পুত্র মারা গেছে। এতকিছুর পরও দুলালের পিতা ফনী ভট্রাচার্য স্ত্রীকে না জানিয়ে পুত্রকে কালীপূজায় নিযুক্ত করেন। ফনী ভট্রাচার্য সংস্কৃতের আদ্য ও মধ্য পাশ করেন- ফলে তিনি চিন্তা করতেন রামধন বাচস্পতির অভিসম্পাতে তিনি সত্বরই মারা যাবেন। ফনী ভট্টাচার্যের আশংকা যথার্থ হোল। পুত্র দুলাল ঠাকুরের ১৩ বৎসর বয়সে তিনি পরলোকগত হয়।

যতীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (তৎকালীন ফরিদপুরের রাজবাড়ীর কালুখালী) কাব্যতীর্থ দুলাল ভট্টাচার্যকে পূর্ণাভিষেক করত: দীক্ষাদেন ধর্মীয় বিশ্বাস যে, পুর্নাভিষেক করে দীক্ষা দিলে পূজায় কোন ক্রটি হলেও মা ক্ষমা করবেন। কেননা, দীক্ষার সময়ে দুলাল ঠাকুরের বয়স খুবই কম ছিল সেক্ষেত্রে মাতৃপূজায় ক্রটি হওয়া অসম্ভব ছিলো না।

‘খোকসার পরিচয়’ গ্রন্হে অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস লিখেছেন তৎকালীন পূজারী ভনী ভট্টাচার্যের সময়ে ভূমি কম্পে মন্দির ভেঙে গেলে উক্ত কালো পাথর সপ্তাহকাল জঙ্গলে ছিলো। স্বপাদেশে খুঁজে পেলেও ভগ্নাবস্থায় মেলে। চার পায়া বিশিষ্ট পাথরখানী এখনও বেদীতে প্রতিষ্ঠিত।

পূর্বে পূজার স্হানটি ছিল বর্তমান পূজামন্দিরের দক্ষিণ- পশ্চিমে। তখন বাৎসরিক উৎসব (মাঘী- আমাবস্যা) মন্দির ছাওয়া হোতো বিচেলি দিয়ে। ১৩৪১ বাং সালে প্রাচীন পূজা মন্দির স্হান্তারিত করা হয়- কুঠিরশ্বর সাহা, ব্রজনাথ ও যদুনাত সিংহ মহাশয়ের জমির উপর। উক্ত মন্দির নদীগর্ভে ভেঙে গেলে ১৩৬২ বাং সালে যদুনাথ সিংহ মহাশয়ের জমির উপর বর্তমান মন্দির গড়ে ওঠে।উক্ত জমি খোকসার কালীর নামে রেকর্ড করে দেন যদুনাথ সিংহের ৩ পুত্র সুধীর সিংহ, নৃপতি সিংহ ও পতি সিংহ। বর্তমান দেড় একর জায়গার উপর মন্দির ও আঙিনা। যদিও এই পূজার জন্য নলডাঙ্গার রাজা পূজা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে জমি চাকরান ভোগ করার সুযোগ  দিয়েছিলেন। ১. বাৎসরিক উৎসবের কাঠাম মিস্ত্রি ১২ বিঘা ২. ধোপা ১২ বিঘা ৩. মালী - মালাকার ১২ বিঘা ৪. নরসুন্দর ১২ বিঘা ৫. ভূঁইমালি ১২ বিঘা ৬. ঢাকি ১২ বিঘা ৭. বলি, নিত্য পূজা ও পরিস্কারের জন্য ১২ বিঘা এবং বাৎসরিক উৎসবে ৭ দিন দীপান্বিতার ১০৮ টি প্রদীপ মহড়ার তৈল এবং ভাদ্রমাসের তালবড়ার বাবদ খরচের জন্য ১৬ বিঘা।

পূর্বে এই পূজার বলির সংখ্যাও ছিলো অনেক। বাৎসরিক পূজার দিনে সকালের দিকে চন্ডী পাঠ শেষ করে চন্ডীর জন্য একটা পাঁঠা বলি দেয়া হোত। পড়ন্ত বেলা ৪ টার দিকে দেবীকে আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হোত। তৎপর নলডাঙ্গার রাজার পন্ডনি নড়াইলের জমিদার রতন বাবুদের। পাঁচ শরীকের জন্য পাঁচটি পাঁঠা বলি দেয়া হোত। তৎপর নলডাঙার রাজ্য প্রেরিত মহিষ বলি হোত। যথাক্রমে পার্শ্ববর্তী দুই জমিদার (পাংশার জমিদার ভৈরবী বাবু ও শিলাইদহের ঠাকুর বাবু) এর সম্মান স্বরুপ তাদের প্রেরিত জোড়া পাঁঠা বলি দেওয়া হতো। তখন অবশ্য উভয় জমিদারের সম্মানের বাড়াবাড়ি নিয়ে দারুন প্রতিযোগিতা হোতো।

বর্তমানের নির্ধারিত বলি হয়- প্রথমে জোড়া পাঁঠা তারপর মহিষ। তৎপর বিভিন্ন দিক থেকে আগত মানসার পাঁঠা শতাধিক বলি হয়। বর্তমানে কালীর মাপ (কাঠাম ও শিববাদে ৭.৫ হাত কীরিটসহ ১২. ৫ হাত)। একমাস পূর্বে অমাবস্যায় গাছ কাটা হয় আর তার পরবর্তী আমাবস্যায় পূজা হয়। কদম কাঠ ছাড়া কাঠাম হয়না। পূর্বে এখানে মাসাধিকাল মেলা হতো, এখন পক্ষকাল ব্যাপ্তি। এখন সেই রাজ্য- জমিদারের পূজা আর নেই। নিয়মিত মন্দির সংস্কারের ফলে গড়াই এর পেট চিড়ে দৃষ্টি নন্দন প্রবেশদ্বার, সবুজে ঘেরা মাঠ, নিরাপওা বেষ্টিত প্রাচীর ও ঐতিহ্যবাহী মন্দির, ভক্ত পূজারীদের প্রার্থনা স্থান, বলিস্থান, স্থায়ী সম্পদ ভান্ডার, পানিও জল, নারী- পুরুষের আলাদা টয়লেট ও অফিস কক্ষ। খোকসার কিছু দীন ভক্ত মন্ডলীর উদ্যোগে চতুর্দিকে সহৃদয় ভক্ত মন্ডলীর চাঁদার উপর নির্ভর করেই পূজা হয়। ২১ জানুয়ারী শনিবার দিবাগত রাতে বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হবে সেই সাথে প্রায় পাঁচ শতাধিক পাঁঠা ও একটা মহিষ বলি হবে সাথে সহস্রাধিক কবুতর উড়িয়ে মানত কার্য্য সম্পাদন করবে সনাতন ধর্মাবলম্বী সহ মানতকারীরা।

লেখক: চিকিৎসক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

এসি