খেলাধুলায় শেখ কামালের কল্পনাশক্তি
রফিকুল বাহার
প্রকাশিত : ০৮:২২ পিএম, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ মঙ্গলবার
শেখ কামালকে আমাদের প্রজন্ম খুব ভালোভাবে জানে না। চেনেও না অনেকে। আমাদের থেকে বয়সে অন্তত ৪/৫ বছরের বড় যারা তারাও শেখ কামাল সম্পর্কে সঠিক সুস্পষ্ট কোন তথ্য জানাতে পারে না। তবে ক্রীড়া সংগঠন ‘আবাহনী’ নাম দিয়েই শেখ কামালকে চেনার জানার বোঝার অনেকটাই সহজ। ঢাকার অভিজাত পাড়া হিসেবে পরিচিত ধানমন্ডিতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এই আবাহনী ক্লাব। স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত বাংলাদেশে এরকম একটি আধুনিক ক্লাব ঘর নির্মাণের মাধ্যমে শেখ কামালের আধুনিক ক্রীড়া মনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। ৪৭ বছর আগে লাল সিরামিকের ইটের তৈরি সুন্দর নজরকাড়া এক ভবন।
মাত্র ২৬ বছর বয়সেই তিনি সপরিবারে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন তার ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে। স্বাধীনতার ঘোষক ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে ছিলেন শেখ কামাল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আধুনিক একটি ক্লাব নির্মাণ করেছেন। সেই ক্লাবের জন্য ইংল্যান্ড থেকে ফুটবল কোচ এনে প্রথম আধুনিক ফুটবলের ধারণা প্রবর্তন করেছেন বাংলাদেশে। সাংগঠনিক সক্ষমতা দিয়ে ওই ক্লাবকে জনপ্রিয় করারও অনেক কৌশল করেছিলেন তিনি। কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন শেখ কামাল দেখতে কেমন ছিলেন তার দূরদর্শিতা কেমন সৃজনশীলতায় তিনি কতটা এগিয়েছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের যেতে হবে তার সহকর্মী তার সহপাঠী এবং ওই সময় তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠজনদের কাছে।
চট্টগ্রামে বসে শেখ কামাল সম্পর্কে সবকিছু জানা একটু কঠিনই বটে। তারপরও আবাহনী ক্লাবের খেলা ও কার্যক্রম দেখে আমরা তার গুণের কিছুটা ছোঁয়া পাই। আমি তখন স্কুলে পড়ি। চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে খেলা দেখতাম নিয়মিত। আশির দশকে এই স্টেডিয়ামে উপচেপড়া দর্শকদের ভিড় দেখা গেছে। চট্টগ্রামে তখনো আবাহনী নামে কোন ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে মোহামেডান ক্লাব ছিল। সেই ক্লাব বরাবরই চট্টগ্রামে শীর্ষস্থানীয় দল। চট্টগ্রামে মোহামেডানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত স্টিল মিল, ওয়াপদা মানে পিডিবি, কাস্টমস, রেলওয়ের মত শক্তিশালী দলগুলো। মোহামেডান বাদে বাকি ক্লাবগুলোতে খেলতে আসতো ঢাকা আবাহনীর সালাউদ্দিন, চুন্নু, অমলেশ, নান্নু, টুটুল। সেকি উত্তেজনা। এসব খেলোয়াড়ের সেই কি স্টাইল! তাদের খেলার স্টাইল দেখবার জন্য গ্যালারি উপচেপড়া দর্শকরা এসে বসতেন মাঠের সাইড লাইনের পাশেও। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে উপচেপড়া মানুষের ভিড়ে খেলা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত শেষ হতে পারেনি। বাংলাদেশের বর্তমানে মৃতপ্রায় ফুটবলের অবস্থা চিন্তা করলে আর আশির দশকের সেইসব দৃশ্য মনে ভেসে উঠলে সত্যিই দ্বন্দ্বে পড়ে যেতে হয়। আমাদের ফুটবল আসলেই এত গৌরবময় ছিল? হ্যাঁ ছিলই। আর এখানেই শেখ কামালের নামটা অবধারিতভাবে চলে আসে। তিনি একটি আধুনিক ক্লাবের জন্ম দিয়েছেন একই সঙ্গে বেশকিছু ফুটবলারকে স্মার্ট বানিয়েছেন।
শেখ কামালকে নিয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতায় তেমন কোন উল্লেখযোগ্য গবেষণা কিংবা অনুসন্ধানী রিপোর্ট হয়েছে বলে মনে পড়ে না। সামান্য কিছু কাজ হয়েছে হয়তো। চট্টগ্রামেরই ছেলে ক্রীড়া সাংবাদিক সনৎ বাবলা লিখেছেন, ‘শেখ কামাল: ক্রীড়াঙ্গনের ধুমকেতু’ নামে একটি বই যেটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালে। অর্থাৎ শেখ কামাল মারা যাওয়ার প্রায় ৪৫ বছর পর। শেখ কামাল একাধারে ক্রিকেটার, খেলতেন বাস্কেটবল, ক্রীড়া সংগঠক, রাষ্ট্রপতির ছেলে-এরকম নানামুখী পরিচয় ছাপিয়ে তিনি ক্রীড়া সংগঠকের পরিচয়ে সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল।
সনৎ বাবলার বইতে তিনি শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজনদের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, একবার এক বড় ব্যবসায়ী এসে তাকে অর্থাৎ শেখ কামালকে একটি চেক দিয়ে যায়। চেক হাতে তুলে দিয়ে ওই ব্যবসায়ী বলেন, আপনি ক্লাব চালান, ক্লাব চালাতে অনেক টাকা লাগে তাই দিলাম। চেকটি নিজের কাছে রেখেছেন ঠিকই কিন্তু পরক্ষণেই জানতে পারেন যে ওই ব্যবসায়ীর ব্যবসায়িক সুনাম নিয়ে প্রশ্ন আছে। পরদিন শেখ কামাল ওই ব্যবসায়ীকে তার চেক ফেরত দিয়ে দেন।
স্বাধীনতার পরে আবাহনী ক্লাব যখন সংগঠিত হতে থাকে তখন মাঠে নামার সময় দর্শকরা তাদের ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে চিৎকার করত। এমনকি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করার ঘটনাও ঘটেছে। সমর্থক ছিল না। প্রতিক‚ল অবস্থা। সেটি সামাল দেয়ার জন্য অদ্ভুত এক কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন শেখ কামাল। বাস্কেটবল খেলার জন্য তখনকার সবচেয়ে নামি দল ওয়ান্ডারর্সে এক বাস্কেটবল প্লেয়ারের কাছে গিয়েছিলেন। তার নাম এ কে সরকার। তিনি জাতীয় দলের খেলোয়াড়। শেখ কামাল ওয়ান্ডার্সে খেলতে আসবেন শুনে কিছুটা বিব্রত ক্লাবের সবাই। তখন ওই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন বীর বিক্রম কাজী কামাল উদ্দিন। শেখ কামাল তার কাছেও গিয়েছিলেন তাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। কৌতুহলী বাস্কেটবল খেলোয়াড় এ কে সরকার একদিন শেখ কামালকে জিজ্ঞেস করে বসলেন কেন আপনি রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়ে ওয়ান্ডার্সে খেলতে আসলেন। জবাবে শেখ কামাল বলেছিলেন পরে বলব। ঠিকই এক বছর পর শেখ কামাল এ কে সরকারকে জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি কেন ওয়ান্ডার্সে বাস্কেটবল খেলতে গিয়েছিলেন। মূলত ওয়ান্ডার্স ক্লাবের তখন প্রচুর সমর্থক ছিল। বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে শেখ কামালের দল আবাহনী কিছুটা সমর্থন পাবে এই ভরসায় তিনি বাস্কেটবল খেলতে গিয়েছিলেন ওয়ান্ডার্সে। কতটা মিশনারি হলে কতটা দূরদর্শী হলে একজন মানুষ এভাবে চিন্তা করতে পারে।
আবাহনী ক্লাবকে একটি আধুনিক ক্লাবে পরিণত করতে হবে এর জন্য দরকার প্রচুর টাকা। রাজাকার আলবদররাও ক্লাব গড়বার জন্য টাকা দিতে চেয়েছিল। সে টাকা তিনি গ্রহণ করেননি। টাকা কোত্থেকে আসবে সেই পরিকল্পনাও শেখ কামাল করে রেখেছিলেন। শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নামকরা সার্কাস দলের চৌকষ সদস্যদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন। সেখান থেকে টাকা সংগ্রহ করেই একটি আধুনিক ক্লাব বানানোর কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সার্কাস শো থেকে তখন আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৪৪ টাকা।
এই ক্লাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবাহনীতে দীর্ঘদিন ধরে খেলে আসা চট্টগ্রামের ছেলে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আশীষ ভদ্র বলেন, আবাহনী এমন একটি ক্লাব যেখানে তখনকার সময়ের সমস্ত আধুনিক ব্যবস্থাপনা ছিল প্লেয়ারদের জন্য। হাই কমোডের এসি বেডরুম, টয়লেট, কিচেন-ডাইনিং রুম সবকিছুই আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল। তখনকার বিখ্যাত সব ক্রিকেটার ও ফুটবলার সবাই ক্লাবের ব্যবস্থাপনা দেখে অভিভূত হয়ে যেতেন। ভারতের বিখ্যাত ক্রিকেটার অরুন লাল শ্রীলংকার সামারা শেখেরা শ্রীলংকার ফুটবলার পাকির আলীর মত খেলোয়াড়রা এই ক্লাবে অবস্থান করে এর আধুনিক ব্যবস্থাপনা দেখে প্রশংসা করেছেন। ক্লাবের জার্সি নিয়ে আসা হতো সুদূর ইংল্যান্ড থেকে, মোজাও বাদ যেত না। চিন্তা চেতনায় শেখ কামাল এতটাই আধুনিক আর বিনয়ী ছিলেন যে, ক্লাব বয় যারা ছিলেন তাদেরকে তিনি ‘আপনি’ করেই সম্বোধন করতেন। সবাইকে সুন্দর ড্রেস পরে ফিটফাট থাকার জন্য পরামর্শ দিতেন।
তখনকার সময় একজন ফুটবলার কিংবা ক্রিকেটের এর কাছে একটি মোটরসাইকেল স্বপ্নের মতই ছিল। ১৯৭৫ সালে মারা যাওয়ার আগে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধিদপ্তরে যেসব মোটরসাইকেল দেওয়া হতো সেখান থেকে কম নামে ৯টি মোটরসাইকেল কেনার জন্য ৭৫ হাজার টাকা একটি ফান্ড দিয়ে রেখেছিলেন ক্লাবের তৎকালীন ম্যানেজারের কাছে। ৯ জন নামী ফুটবলারকে চুক্তিবদ্ধ করার জন্য এই ফান্ড জোগাড় করে রাখার কথা জানতেন না সেই সময়ের ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদও। ২৬ বছর বয়সী এক যুবকের চিন্তার জগৎ কতটা বিস্তৃত আর বুদ্ধি কৌশলের দিক থেকে কতটা এগিয়ে ছিলেন তিনি তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায়। ভাবা যায়!
এমন প্রশ্ন কেউ তোলেন যে নৃশংসভাবে যদি সপরিবারে শেখ কামাল মারা না যেতেন তাহলে কি হত বা কি হতে পারত? বাংলাদেশের একজন নামকরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে পরিচিত আশীষ ভদ্র। তিনি বললেন যে, ফুটবল বাংলাদেশ কোন অবস্থানে পৌঁছাতো সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু ফুটবল নয়, সব ধরনের খেলাধুলায় বাংলাদেশ এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে যেত এতদিনে। কারণ তার ভিতরে যে দূরদর্শিতা ছিল অর্থাৎ শেখ শেখ কামালের ভেতরে যে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল তার সবকিছুই তিনি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রকাশ করে দেখিয়েছেন। প্রমাণ করেছেন। তার কল্পনা শক্তি ছিল অসাধারণ।
ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়েই শেষ করব এই লেখা। শেখ কামাল মারা যাওয়ার পর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আবাহনী ক্লাব বেশ দুঃসময়ে ছিল। সেই দুঃসময় ক্লাবকে সুসংগঠিত করার কাজে নিবেদিত ছিলেন বেশ কয়েকজন। এদেরই একজন হারুনুর রশিদ। শেখ কামাল বেঁচে থাকা অবস্থায় ক্লাবের আর্থিক টানাপোড়নের সময় হারুনুর রশিদ রাগ করে ক্লাবে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বেশ কয়েকদিন তিনি আসেননি। তখন হারুনুর রশিদকে খুঁজবার জন্য শেখ কামাল তার বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে হাজির হলেন এবং সেখানে গিয়ে তার ভাবীকে মজা করে বললেন যে, ‘নোয়াখাইল্লাটা’ কই? (হারুনুর রশিদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়, এটি তখন নোয়াখালী ছিল) আর সেই ঘরে বসেই গলায় সুর তুললেন এই গান দিয়ে, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’। মান ভাঙ্গিয়ে হারুনুর রশিদকে আবার সঙ্গে নিয়ে ক্লাবে আসেন শেখ কামাল।
ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, সংস্কৃতিমনা, রসবোধসম্পন্ন এই মানুষটিকে আমরা আর কখনোই পাব না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে শেখ কামাল থাকবে চিরঞ্জীব হয়ে। ৫০ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশের দশ লাইনের সংক্ষিপ্ত ক্রীড়া ইতিহাস যদি লিখতে হয় সেখানে যৌক্তিকভাবে দুটি লাইন বরাদ্দ রাখতে হবে শেখ কামালের আধুনিক ক্রীড়া ভাবনার জন্য। তাঁকে স্মরণ করার জন্য ‘শেখ কামাল দ্বিতীয় বাংলাদেশ যুব গেমস’ এর যারা উদ্যোক্তা তাদের জন্য এক পংক্তি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
লেখক: রফিকুল বাহার, আবাসিক সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন, চট্টগ্রাম।rafiqul_bahar@yahoo.com