শিকাগো মহাসভার ভাষণে যে বার্তা দেন স্বামী বিবেকানন্দ!
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:৩৪ এএম, ১৮ জানুয়ারি ২০২৩ বুধবার
শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউটে বসেছে ‘দ্য পার্লামেন্ট অব ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়নস’। ভারত থেকে এক তরুণ সন্ন্যাসী এসেছেন, হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি হয়ে। তাঁর বক্তৃতা করার পালা আসে প্রায় বিকেলের দিকে। কিছুটা যেন নার্ভাস তিনি। জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীকে প্রণাম করে শরীরে-মনে যেন একটা নতুন উদ্যম পেলেন। মনে হল তাঁর শরীরে কে যেন ভর করেছেন। বক্তৃতা শুরু করলেন ‘সিস্টারস অ্যান্ড ব্রাদার্স অব আমেরিকা’ সম্বোধন করে। সাত হাজার দর্শক-শ্রোতা দাঁড়িয়ে উঠে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানালেন সেই তরুণ সন্ন্যাসীকে। দু’ মিনিট ধরে চলল হাততালি। ফলে সেই সন্ন্যাসীর জন্য বরাদ্দ সময় বাড়াতে বাধ্য হলেন উদ্যোক্তারা। আমেরিকা-সহ বিদেশ জয় শুরু হল স্বামী বিবেকানন্দের।
স্বামীজির বিশ্বজয়ের সেই সূত্রপাত হয় ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউটে বসেছিল ‘দ্য পার্লামেন্ট অব ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়নস’। সে দিন আমেরিকাবাসীর মন কেড়ে নেওয়ার ফলস্বরূপ ১১ সেপ্টেম্বরের পরে আরও পাঁচ দিন বক্তৃতা করতে হয়েছিল স্বামীজিকে। ১৫, ১৯, ২০, ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর। ধর্ম, সংস্কৃতি, সভ্যতা নিয়ে অনেক কিছু বলেছিলেন তিনি। কিন্তু সব চেয়ে বড় কথা হল, সে দিন তিনি এমন কিছু বলেছিলেন, যা আজও বর্তমান পৃথিবীতে সমান প্রাসঙ্গিক।
বিবেকানন্দের সবচেয়ে স্মরণীয় বক্তৃতা এটিই। যার মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে হিন্দু ধর্মকে তিনি নতুন সম্মানে প্রতিষ্ঠা করেন।
সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতার বাংলা অর্থ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
বক্তৃতায় তিনি বলেন, “হে আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ, আজ আপনারা আমাদের যে আন্তরিক ও সাদর অভ্যর্থনা করেছেন, তার উত্তর দেওয়ার জন্য উঠতে গিয়া আমার হৃদয় অনিবর্চনীয় আনন্দে পরিপূর্ণ হয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন সন্ন্যাসী-সমাজের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।”
“সর্বধর্মের যিনি প্রসূতি-স্বরূপ,তাঁর নামে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের অন্তর্গত কোটি কোটি হিন্দু নরনারীর তরফে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।”
এরপর তিনি বলেন, “এই সভামঞ্চে সেই কয়েকজন বক্তাকেও আমি ধন্যবাদ জানাই, যাঁরা প্রাচ্যদেশীয় প্রতিনিধিদের সম্বন্ধে এরূপ মন্তব্য প্রকাশ করলেন যে, অতি দূরদেশবাসী জাতিসমূহের মধ্য থেকে যাঁরা এখানে এসেছেন, তাঁরাও বিভিন্ন দেশে পরধর্মসহিষ্ণুতার ভাব প্রচারের গৌরব দাবি করতে পারেন। যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্বাধিক মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকেই সহ্য করিনা, সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলে বিশ্বাস করি। যে ধর্মের পবিত্র সংস্কৃত ভষায় ইংরেজী ‘এক্সক্লুশন’ (ভবার্থঃ বহিষ্হকরণ, পরিবর্জন) শব্দটি অনুবাদ করা যায় না, অমি সেই ধর্মভুক্ত বলে গর্ব অনুভব করি । যে জাতি পৃথিবীর সকল ধর্মের ও সকল জাতির নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থী জনগণকে চিরকাল আশ্রয় দিয়ে আসছে, আমি সেই জাতির অর্ন্তভুক্ত বলে নিজেকে গর্বিত মনে করি।”
বক্তব্যে স্বামীজি জানান, কোটি কোটি নরনারী যে-স্তোত্রটি প্রতিদিন পাঠ করেন, যে স্তবটি আমি শৈশব থেকে আবৃত্তি করে আসছি, তাঁরই কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করে আমি আপনাদের বলছি -বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে, কিন্তু তারা সকলে যেমন এক সমুদ্রে তাদের জলরাশি ঢেলে মিলিয়ে দেয়, তেমনি হে ভগবান্, নিজ নিজ রুচির বৈচিত্র্যবশতঃ সরল ও কুটিল নানা পথে যারা চলছে, তুমিই তাঁদের সকলের একমাত্র লক্ষ্য। পৃথিবীতে এযাবৎ অনুষ্ঠিত সন্মেলনগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাসন্মেলন এই ধর্ম-মহাসভা গীতা-প্রচারিত সেই অপূর্ব মতেরেই সত্যতা প্রতিপন্ন করছি, সেই বাণীই ঘোষণা করছি -যে যে-ভাব আশ্রয় করে আসুক না কেন, আমি তাহাকে সেই ভাবেই অনুগ্রহ করিয়া থাকি। হে মনুষ্যগণ সর্বতোভাবে আমার পথেই চলিয়া থাকে।
উপসংহারে তিনি বলেন, “সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলির ভয়াবহ ফলস্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল অধিকার করে রেখেছে। এরা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করেছে, বরাবার একে নরশোণিতে সিক্ত করিয়াছে, সভ্যতা ধ্বংস করেছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করেছে। এই-সকল ভীষণ পিশাচগুলি যদি না থাকত, তাহা হইলে মানবসমাজ আজ পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হত। তবে ইহাদের মৃত্যুকাল উপস্থিত; এবং আমি সর্বতোভাবে আশা করি, এই ধর্ম-মহাসমিতির সন্মানার্থ আজ যে ঘন্টাধ্বনি নিনাদিত হয়েছে, তাইই সর্ববিধ ধর্মোন্মত্ততা, তরবারি অথবা লিখনীমুখে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রকার নির্যাতন এবং একই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর ব্যক্তিগণের মধ্যে সর্ববিধ অসদ্ভাবের সম্পূর্ণ অবসানের বার্তা ঘোষণা করুক।”
এসএ/