যেভাবে এলো কম্পিউটার
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:২৭ এএম, ২০ জানুয়ারি ২০২৩ শুক্রবার
কম্পিউটার শব্দের অর্থ গণনাকারী যন্ত্র। কিন্তু এখন আর কম্পিউটারকে শুধু গণনাকারী যন্ত্র বলা যায় না। কম্পিউটার এমন এক যন্ত্র যা তথ্য গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করে। সভ্যতার বিকাশ এবং বর্তমানে তার দ্রুত অগ্রগতির মূলে রয়েছে গণিত ও কম্পিউটারের প্রবল প্রভাব।
প্রাচীনকালে মানুষ সংখ্যা বোঝাতে ঝিনুক, নুড়ি, দড়ির গিঁট ইত্যাদি ব্যবহার করত। পরে গণনার কাজে বিভিন্ন কৌশল ও যন্ত্র ব্যবহার করে থাকলেও অ্যাবাকাস নামক একটি প্রাচীন গণনা যন্ত্রকেই কম্পিউটারের ইতিহাসে প্রথম যন্ত্র হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ অ্যাবাকাস থেকেই কম্পিউটারের ইতিহাসের শুভযাত্রা। এটি আবিষ্কৃত হয় খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ সালে ব্যাবিলনে। অ্যাবাকাস ফ্রেমে সাজানো গুটির স্থানে পরিবর্তন করে গণনা করার যন্ত্র। খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০-৫০০ অব্দে মিসর-চীনে গণনাযন্ত্র হিসেবে অ্যাবাকাস তৈরি হয়।
১৬১৬ সালে স্কটল্যান্ডের গণিতবিদ জন নেপিয়ার গণনা কাজে ছাপা বা দাগ কাটাকাটির দণ্ড ব্যবহার করেন। এসব দণ্ড নেপিয়ারের অস্থি নামে পরিচিত। ১৬৪২ সালে ১৯ বছর বয়স্ক ফরাসি বিজ্ঞানী ব্লেইজ প্যাসকেল সর্বপ্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন। ১৬৭১ সালে জার্মানি গণিতবিদ হটফ্রাইড ভন লিবনিজ প্যাসকেলের যন্ত্রের ভিত্তিতে চাকা ও দণ্ড ব্যবহার করে গুণ ও ভাগের ক্ষমতাসম্পন্ন আরও উন্নত যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর তৈরি করেন। তিনি যন্ত্রটির নাম দেন রিকোনিং যন্ত্র। যন্ত্রটি তত্ত্বগত দিক দিয়ে ভালো হলেও যান্ত্রিক অসুবিধার জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
পরে ১৮২০ সালে টমাস ডি কোমার রিকোনিং যন্ত্রের অসুবিধা দূর করে লিবনিজের যন্ত্রকে জনপ্রিয় করে তোলেন। ১৮২২ সালে চার্লস ব্যাবেজ প্রথম সফল গণনাযন্ত্র তৈরি করেন, যা তিনি করেছিলেন মূলত গণিতে মানুষের ভ্রান্তি দূর করার জন্য। কিন্তু এটি পরে আধুনিক কম্পিউটারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
সেই থেকে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নানা ধাপ পেরিয়ে কম্পিউটার ও তার প্রযুক্তি অগ্রগতি অব্যাহত। এখন কম্পিউটার বলতে সাধারণ ভাবে যে যন্ত্রটির চেহারা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তা প্রযুক্তিগত বিবর্তনের দীর্ঘ পথ অতিক্রমের ফসল।
কম্পিউটার সংক্রান্ত আলোচনায় ‘প্রজন্ম’ বলতে প্রযুক্তিগত ধাপকে বোঝায়। অর্থাৎ কম্পিউটারের প্রজন্মের ধারাকে বিশ্লেষণ করা হলে কম্পিউটার নামক যন্ত্রের বিকাশের পর্যায়গুলোকে জানা যাবে।
১৯৪২ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে যে সব কম্পিউটার তৈরি হয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার। ঐ সব কম্পিউটারের গঠনতান্ত্রিক কাঠামোর মূল যন্ত্রাংশ ছিল ভ্যাকুয়াম টিউব। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রতীক হিসাবে এই সব কম্পিউটারের নানা সুবিধা থাকলেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এগুলোর কিছু অসুবিধাও ছিল।
প্রথমত, এই সব কম্পিউটার ছিল আকারে বড়। দ্বিতীয়ত, এগুলো সব সময় বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে কাজ করতে পারত না। তৃতীয়ত, শীততাপ নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা ছাড়া এগুলোকে ব্যবহার করা যেত না। চতুর্থত, প্রায়ই এ সব কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার ব্যবস্থা বিকল হয়ে পড়ত। যেমন, ভ্যাকুয়াম টিউব প্রায়ই খারাপ বা নষ্ট হয়ে যেত। তখন তা বদলানো ছাড়া উপায় থাকত না। পঞ্চমত, এগুলো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার উপযোগী ছিল না।
দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারে স্বভাবতই আরও উন্নত প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হয়। উন্নততর প্রযুক্তির মাধ্যমে এই পর্যায়ের কম্পিউটারে ভ্যাকুয়াম টিউবের বদলে ট্রানজিস্টর লাগানো হয়। এই কম্পিউটারগুলোর যন্ত্রাংশ ছিল আকারে তুলনামূলক ভাবে ছোট।
বিবর্তনের পথ ধরেই নিরন্তর গবেষণার মধ্য দিয়ে আরও উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটালো তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার। দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারে ব্যবহার করা হয়েছিল ট্রানজিস্টর। তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারে তার জায়গা নিলো ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (আই সি), যা সাধারণত সিলিকনের একটি মাত্র টুকরোর উপরে তৈরি অতি ক্ষুদ্র স্থানে সীমাবদ্ধ বিদ্যুৎ সঞ্চালন চক্র। যে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আই সি-র এই ব্যবহার, তার নাম লার্জ স্কেল ইন্টিগ্রেশন (এল এস আই) টেকনোলজি।
তৃতীয় প্রজন্মের এল এস আই প্রযুক্তির জায়গায় চতুর্থ প্রজন্মের কম্পিউটারে ব্যবহার করা হল ভেরি লার্জ স্কেল ইন্টিগ্রেশন টেকনোলজি বা ভি এস এল আই প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির ভিত্তিতে কম্পিউটারে বসানো হল মাইক্রো প্রসেসর। স্বভাবতই এর ব্যবহারিক সুবিধা বেড়ে গেল অনেক গুণ।
বিজ্ঞানীরা এখন পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটার তৈরির কাজে ব্যস্ত, চলছে আরও উন্নত ও পরিমার্জিত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের গবেষণা। ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে অপটিক ফাইবার প্রযুক্তির প্রয়োগ। মনে রাখতে হবে, মানুষের মেধার যেমন স্বকীয়তা আছে, কম্পিউটারের কিন্তু তা নেই। কম্পিউটারকে মেধাসম্পন্ন করে তুলতে হয়। তাই কম্পিউটারের মেধা কৃত্রিম মেধা। এই মেধা ও তার ব্যবহারকে অপটিকাল ফাইবার ও অন্যান্য প্রযুক্তির সাহায্যে কত তীক্ষ্ণ ও দক্ষ করে তোলা যায়, পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটারে চলছে তারই পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কম্পিউটারের ব্যবহার দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৮৩ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় নীতি তৈরি করতে একটি জাতীয় কম্পিউটার কমিটি গঠন করে। ১৯৮৮ সালে এ কমিটি জাতীয় কম্পিউটার বোর্ডে রূপান্তরিত হয়। পরে ১৯৯০ সালে এদেশে যাবতীয় কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত কর্মকাণ্ড নিরীক্ষণের জন্য গঠিত হয় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। এরপর থেকে এ কাউন্সিল বাংলাদেশে কম্পিউটারের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
এমএম/