দৃষ্টিনন্দন সাত গম্বুজ মসজিদ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:১৫ এএম, ২১ জানুয়ারি ২০২৩ শনিবার
মোঘল স্থাপত্যের সুনাম-সুখ্যাতি বিশ্ব জুড়ে। তাদের হাতে নির্মিত অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী দেখে বিমোহিত হয় প্রতিটি দর্শক হৃদয়। আগ্রার তাজমহল থেকে শুরু করে মোঘলদের এমন কোনো স্থাপত্য নেই যেখানে পর্যটকরা ভিড় করে না। ভ্রমণপিপাসুরা স্থাপত্যের অপূর্ব নান্দনিকতায় বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন। মুঘলদের হাতে নির্মিত এমনই একটি স্থাপত্য হলো ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত ‘সাত গম্বুজ মসজিদ’।
মসজিদটির নির্মাতা নিয়ে স্থানীয় প্রবীণদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, নবাব শায়েস্তা খাঁয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র বুজুর্গ উদ্দিন উমিদ খাঁ এটি নির্মাণ করেন। তবে নির্মাণশৈলী বিশ্লেষণে ধারণা করা হয়, ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল শাসনামলে নবাব শায়েস্তা খাঁ এটি বিরচন করেছিলেন। সেসময় মসজিদটির তীর ঘেঁষে প্রবাহমান ছিল বুড়িগঙ্গা নদী। তখনকার মানবরা বর্ষা মৌসুমে নদীপথে যাতায়াতের সময় মসজিদের ঘাটে তরী, লঞ্চ কিংবা বজরা ভেড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন। স্যার চার্লস ডি ওয়াইলি ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে সাত গম্বুজ মসজিদকে নিয়ে একটি চিত্রকর্ম একেছেন। শিরোনামে লেখা ছিল ‘গঙ্গার শাখা নদী বুড়িগঙ্গার তীরে সাত মসজিদ’। চিত্রকর্মে শোভা পাচ্ছে মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে, নদীর তীর ঘেঁষে প্রবাহমান জলে চলছে তরী।
তবে সেসময় আর এসময়ের ব্যবধানে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুর। নদী ভরাট করে বর্তমানে শোভা পাচ্ছে সুউচ্চ অট্টালিকা। নির্মাণ করা হয়েছে ছোট-বড় দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা। মসজিদের পশ্চিম পাশে রয়েছে বিশাল এক মাদ্রাসা।
মসজিদের সম্মুখভাগে রয়েছে সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো বৃহদায়তন একটি উদ্যান, যেখানে ফুলের গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় উদ্ভিদ রয়েছে। উদ্যানের অপরুপ সৌন্দর্য নামাজে আসা মুসল্লিদের মুগ্ধ করে। মুসলিমদের বাৎসরিক দুটি উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাসহ বিশেষ কিছু দিনে এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
ওজু করার জন্য মসজিদের পশ্চিমপাশে রয়েছে দুটি ওজুখানা। উত্তর-পশ্চিমকোণে সাধারণ অন্যান্য মসজিদের মতো ওজুখানা থাকলেও দক্ষিণ-পশ্চিমকোণে রয়েছে পৃথক একটি ওজুখানা। একটি চৌবাচ্চাকে ঘিরে রয়েছে সাতাশ আসন বিশিষ্ট চতুষ্কোনাকৃতির একটি ওজুখানা। ওজুর অব্যবহৃত পানি বের হওয়ার জন্য প্রতিটি আসনের অগ্রাভিমুখে রয়েছে খানিক শূন্যগর্ভ জায়গা।
আয়তাকার এই মসজিদের অভ্যন্তরের দৈর্ঘ্য ১৪.৩৩ মিটার এবং প্রস্থ ৪.৮৮ মিটার। এছাড়া নামাজকক্ষের বাহ্যিক দৈর্ঘ্য ১৭.৬৮ মিটার এবং প্রস্থ ৮.২৩ মিটার। পশ্চিমপাশের দেয়ালজুড়ে রয়েছে তিনটি মিহরাব এবং কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশেই রয়েছে পোক্ত একটি মিম্বার। অগ্রভাগের দেয়ালজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট মিহরাব আকৃতির নকশাগুলো নজর কাড়ে যে কারো।
কেন্দ্রীয় নামাজকক্ষে প্রবেশের জন্য উত্তর-দক্ষিণ থেকে একটি করে এবং পূর্বপাশে তিনটি ভাঁজবিশিষ্ট তোরণ রয়েছে। পূর্বপাশের তিনটি তোরণের মাঝ বরাবর রয়েছে মসজিদের কেন্দ্রীয় দুয়ার।
উত্তর-পূর্বকোণে রয়েছে ছোট একটি কবরস্থান। মসজিদের উদ্যানের পাশের সড়ক ধরে একটু এগোলেই চোখে পড়বে এক অজানা সমাধি। সমাধিটি কার এই সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রচলিত আছে, নবাব শায়েস্তা খাঁয়ের মেয়ের সমাধি এটি। সমাধির অভ্যন্তর অষ্টকোণাকৃতির হলেও বাইরে চতুষ্কোণাকৃতির। বিবির মাজার হিসেবেও এর পরিচিতি রয়েছে।
বর্তমানে সাত গম্বুজ মসজিদ এবং অজানা সমাধিটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় রয়েছে। একসময় মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং সমাধিটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়লে প্রত্নতত্ব বিভাগের দায়িত্বে এটি সংস্কার করা হয়।
সাড়ে তিনশ বছর পূর্বের এই মসজিদ বর্তমানে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। প্রতি ওয়াক্তেই এখানে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করা হয়। কেন্দ্রীয় নামাজকক্ষে প্রায় শ’খানেক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। চার কোণায় চারটি মিনার আকৃতির গম্বুজের অভ্যন্তরে সালাত আদায়ের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত জায়গা। তবে পশ্চিমের উত্তর-দক্ষিণ গম্বুজ দুটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পূর্বদিকের গম্বুজ দুটিতে মুসল্লিরা সালাত আদায় করতে পারেন।
মসজিদে পেশ ইমাম রয়েছেন দুজন, মুয়াজ্জিন একজন এবং খাদেম তিনজন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণে থাকলেও স্থানীয় বাসিন্দারাই এর দেখাশোনা করেন। পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি পরিচালনা পর্ষদ।
সাত গম্বুজ মসজিদের সাথে লালবাগ দুর্গের তিন গম্বুজ মসজিদ এবং খাজা আম্বর মসজিদের মিল আছে বলে অনেকে মনে করেন।
এমএম/