প্রেক্ষাগৃহ বাঁচাতে ভিনদেশি চলচ্চিত্র, কতটা যৌক্তিক?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:১৯ পিএম, ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ সোমবার
নানান সঙ্কটের মধ্যেও দেশে নির্মিত হচ্ছে মানসম্পন্ন সিনেমা। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এবং দর্শকদের রুচির কথা মাথায় রেখে নির্মাতারা তৈরি করছেন ভিন্ন ধারার গল্প। শুধু প্রেক্ষাগৃহে নয়, আকাশ সংস্কৃতির যুগে এ দেশের নির্মাতারা ভালো ভালো নির্মাণ নিয়ে ঝুঁকছেন ওটিটি প্লাটফর্মেও। তবুও কোথায় যোনো একটা দূরত্ব থেকেই যাচ্ছে? দু’একটি সিনেমা দর্শক পেলেও অধিকাংশই নির্মাণ ব্যয় তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের প্রেক্ষাগৃহে ভিনদেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পরিকল্পনা করছেন কেউ কেউ। যদিও এর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সিনেমা সংশ্লিষ্টরা।
অনেকেই মনে করছেন, দেশে ভিনদেশি সিনেমার মুক্তি মানেই বিপর্যয় ডেকে আনা। বড় বাজেটের সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ম্লান হয়ে যাবে দেশীয় নির্মাণ। পাশাপাশি বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনে হুমকির মুখে পড়বে দেশীয় সংস্কৃতি।
আবার কেউ কেউ বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের বক্তব্য- এর মাধ্যমে ঢালিউডে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচিত হবে। ভিনদেশি সিনেমার সঙ্গে নিয়মিত প্রতিযোগিতায় বাড়বে ঢালিউডের গতি। ভালো সিনেমা নির্মাণে মনোযোগী হবেন প্রযোজক ও পরিচালকরা।
তবে মিশ্র এ প্রতিক্রিয়ার মধ্যে হল মালিকদের অনেকেই আমদানি করা সিনেমা প্রদর্শনে বেশ আগ্রহী। তাদের যুক্তি হচ্ছে, প্রেক্ষাগৃহ বাঁচাতে হলে হিন্দি ও অন্য সিনেমা আমদানি করা জরুরি। তা না হলে, প্রেক্ষাগৃহ বাঁচানো যাবে না।
অন্যদিকে, চলচ্চিত্রের শিল্পী, কলাকুশলী, নির্মাতা ও প্রযোজকদের অনেকে এর তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন। তারা বলছেন, এতে আমাদের চলচ্চিত্র পিছিয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে। শিল্পী, প্রযোজক ও নির্মাতারা পথে বসে যাবেন। এছাড়া, আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে।
শিল্পীদের অনেকে বলছেন, দেশীয় চলচ্চিত্রের অবস্থা এমনিতেই শোচনীয়। এর মধ্যে আবার বিদেশি সিনেমা আমদানি করে চালালে ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে যাবে।
যদিও সরকার বিদেশি সিনেমা আমদানির ক্ষেত্রে নীতিমালা করে দিয়েছে। বিদেশি সিনেমা আমদানি নিয়ে ইতোমধ্যে কলকাতার কিছু সিনেমা আমদানি করে মুক্তিও দেয়া হয়। তবে সেসব সিনেমা খুব একটা চলেনি। তারপরও কেউ কেউ ভারতীয় সিনেমা আমদানির কথা বলছেন। গত কয়েকদিন ধরে হিন্দি সিনেমা আমদানি ও মুক্তি নিয়ে আবারও সিনেমা পাড়া সরব হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য দেয়া হচ্ছে।
বলিউডের সিনেমা আমদানির পক্ষে সম্মতি দিয়েছে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। কিন্তু, সমিতির পক্ষ থেকে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সিনেমা হল থেকে লাভের ১০ শতাংশ দিতে হবে শিল্পী সমিতির ফান্ডে।
সম্প্রতি দেশে শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ মুক্তি দেওয়া ইস্যুতে শিল্পী সমিতির পক্ষে এমন শর্তের কথা জানিয়েছেন সমিতির নেতা চিত্রনায়িকা নিপুণ। নিপুণের এমন শর্ত দেওয়াকে রীতিমত চাঁদাবাজি বলে মন্তব্য করেছেন চিত্রনায়ক জায়েদ খান। তার এমন মন্তব্যের বিপরীতেই কথা বলেছেন নিপুণ।
নিপুণ বলেন, ‘এই টাকা যদি আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিতাম তাহলে সেটা চাঁদাবাজি বলতে পারতেন। টাকা থাকবে শিল্পী সমিতির ফান্ডে। আর আমি শিল্পী সমিতি থেকে কিছু নিতে আসিনি। এসেছি কিছু দিতে। ইতোমধ্যে শিল্পীরা সে প্রমাণ পাচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পরিবেশক ও হল মালিকেরা হিন্দিসহ সব ধরনের ছবি এখানে চালাতে চাচ্ছেন। জ্যেষ্ঠ অনেকে উপস্থিত থাকলেও সোহেল রানা স্যার, সুচন্দা আপারা আসতে পারেননি। তবে তাঁদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি, তারা মতামত দিয়েছেন। এখন শর্তগুলো নিয়ে বাকি ১৮ সংগঠনের সঙ্গে বসব আমরা। এরপর সবার মতামত মন্ত্রী মহোদয়কে জানানো হবে। বর্তমান সিনেমা, সিনেমা হলের পরিস্থিতি বিবেচনা করে কিছু শর্তের বিনিময়ে হিন্দি ছবি আমদানির পক্ষে আমরা।’
তবে শর্তগুলো কী তা গণমাধ্যমকে জানানো হয়নি। শর্তগুলো নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে আরও ১৮ সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে সবাইকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে বলে জানান নিপুণ।
এদিকে নিপুনের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কথা বলেছেন অভিনেতা ও প্রযোজক মনোয়ার হোসেন ডিপজল। তিনি বলেন, “দেশে হিন্দি সিনেমা ঢুকলে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলে কিছুই থাকবে না।”
তিনি বলেন, “হিন্দি সিনেমা মুক্তি দেওয়ার ফলে নেপালের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশটির সমৃদ্ধ সিনেমা হিন্দি সিনেমার কবলে পড়ে বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের দেশেও যদি একের পর এক হিন্দি সিনেমা চালানো হয়, তাহলে আমাদের চলচ্চিত্রও নেপালের মতো ধ্বংস হয়ে যাবে।”
অনেকে ২০১৫ সালের আলোচিত আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে আনছেন। সে বছর হিন্দি সিনেমা তথা ভারতীয় সিনেমা আমদানি ঠেকাতে মাঠে নেমেছিলেন ঢালিউডের প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী ও কলাকুশলীরা। শাকিব খান, পরীমনি, রুবেল, ওমর সানিরা কাফনের কাপড় পরে রাস্তায় নেমেছিলেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবে মানববন্ধনও করেছিলেন তারা। সেই আন্দোলনের মুখে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েও থেমে গিয়েছিল হিন্দি সিনেমার মুক্তি।
এ নিয়ে চিত্রনায়ক রিয়াজ বলেন, “ভারতীয় সিনেমা মুক্তি নিয়ে আমার ব্যক্তিগতভাবে কোনো অসুবিধা নেই। আমি চাই হলে দর্শক ফিরে আসুক। আমাদের হলগুলো দর্শকের অভাবে দিনদিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বছরজুড়ে হল মালিকদের ব্যবসা করার মতো ১০/১২টি সিনেমাও এখন আর আমরা মুক্তি দিতে পারছি না। বছরে দু-তিনটি হিট সিনেমা উপহার দিয়ে দর্শক ধরে রাখা যায় না। তাই মাথায় রাখতে হবে হলে দর্শক ফেরানো জরুরি। হল মালিকদের বাঁচাতে না পারলে সিনেমা বাঁচবে না। মিনিমাম বছরে ১২টি দর্শকপ্রিয় সিনেমা উপহার দিতে হবে। আর বাজার চাঙ্গা করতে দেশের প্রেক্ষাগৃহে হিন্দি সিনেমা মুক্তি পেলে আমি তার বিপক্ষে যাব না। তবে আমি বলব যেসব সিনেমা মুক্তি পাবে সেগুলোর মানের দিকে যেন নজর দেওয়া হয়।”
প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু বলেন, “আমি ‘পাঠান’- এর মুক্তিকে নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখছি। হিন্দি ভাষায় নির্মিত সিনেমার বড় একটি মার্কেট কিন্তু বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই তৈরি। নানা উপায়ে এখানকার দর্শক ভারতীয় সিনেমা উপভোগ করে। আমাদের ড্রয়িংরুম দীর্ঘদিন ধরেই তাদের সিনেমার দখলে রয়েছে। টেলিভিশন খুললেই হিন্দি সিনেমা দেখতে বসে যায় দেশের সিনেমাপ্রেমী দর্শক। তাহলে দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে হিন্দি সিনেমা মুক্তি দিতে সমস্যা কী? আমি কোনো ক্ষতি দেখি না। বরং আমাদের হলগুলোর জন্য আরও ভালো হবে। আমারা চাই আমাদের হলগুলো আগের সময়ে ফিরে আসুক।”
পরিচালক সমিতির মহাসচিব শাহীন সুমন বলেন, “দেশে হিন্দি সিনেমা মুক্তির বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তাই আমি এ বিষয়ে কিছু বলব না। যখন সিদ্ধান্ত আসে তখন দেখা যাবে। এ বিষয়ে আমাদেরও কিছু মতামত রয়েছে, কিছু দাবি রয়েছে। সেসব বিষয়ে একটা ফয়সালা আসলে তখনই বলতে পারব ‘পাঠান’ মুক্তি আমাদের জন্য লাভ না ক্ষতির। তবে আমার বিশ্বাস, এমনটা হবে না। বিদেশি সিনেমা এদেশে আসবে না।”
এখন কথা হচ্ছে ঢালিউডকে বাঁচাতে কি কি করতে হবে- তা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। এখানে নানান বিষয় জড়িত। তবে দেশের এ অঙ্গনকে টিকিয়ে রাখতে ভালো সিনেমার বিকল্প নেই। ঠিক তেমনি প্রেক্ষাগৃহ যাতে ক্ষতির সম্মুখিন না হয়, তাও মাথা রাখতে হবে। এ জন্য করণিয় কি তা নিদ্ধারণ করতে হবে সরকার সহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকেই।
প্রসঙ্গত, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক অনন্য মামুনের প্রযোজনা সংস্থা অ্যাকশন কার্ট এন্টারটেইনমেন্ট থেকে ‘পাঠান’ সিনেমাটি বাংলাদেশে আমদানির কার্যক্রম চলছে। প্রযোজনা সংস্থাটি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছে সিনেমাটি আমদানির অনুমতি চেয়ে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সেই চিঠি পেয়েছে বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে। এনিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠকও হয়েছে।
অনন্য মামুন জানিয়েছেন, বৈঠকে সিনেমাটি বাংলাদেশে মুক্তির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি নিয়মনীতি মেনে যদি ‘পাঠান’ নিয়ে আসা যায় তাহলে কোনো সমস্যা নেই। আজকালের মধ্যেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। ‘পাঠান’ সিনেমা বাংলাদেশে মুক্তির অনুমতি মিললে সাফটা চুক্তির নীতিমালা অনুসারে প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন করা হবে।
এসএ/