রোগের ধারণা এলো যেভাবে
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৪:৩৩ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ মঙ্গলবার
প্রাচীনকাল থেকেই রোগব্যাধির ধারণার জটিলতা মানুষকে ভুগিয়ে আসছে। একসময় মানুষ অশুভ শক্তিকে রোগের কারণ হিসেবে ভাবতে শুরু করল। ঈশ্বরের অভিশাপ, দেহের নির্দিষ্ট কোনো তরল, দূষিত বায়ু- এসবকে মনে করা হতো রোগব্যাধির কারণ। তখনও জীবাণুর ধারণা মানুষের কল্পনাতেও আসেনি। পরবর্তীতে জীবাণুর ধারণা যখন সামনে এলো তখন দেখা গেল- শুধু জীবাণুই না, একটি রোগের পেছনে আরো নানা বিষয়ও কারণ হিসেবে কাজ করে। এভাবে কালের বিবর্তনে রোগের ধারণায় উঠে এসেছে নানা তত্ত্ব।
মানব সভ্যতার শুরুর দিকে তিনটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ধর্ম, দর্শন ও চিকিৎসা। রোগব্যাধির ধারণাতেও তাই এর স্পষ্ট প্রভাব পড়েছে। অনেকে মনে করত- অশুভ শক্তি সরাসরি দেহে প্রবেশ করে অসুখের সৃষ্টি করে। আবার কেউ কেউ অসুখকে মানুষের খারাপ কাজের কর্মফল হিসেবে মনে করত। সৃষ্টিকর্তার শাস্তিস্বরুপ এসব রোগব্যাধিকে বরণ করে নিতেন তারা।
এভাবে প্রায় ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোগ সম্পর্কে মানুষের ধারণায় মিশে ছিল কুসংস্কার, ধর্ম, জাদু ও অশুভ শক্তির ছোঁয়া। এগুলোকে বলা হয় রোগের সুপারন্যাচারাল থিওরি।
গ্রিকরা রোগের এ সুপারন্যাচারাল থিওরিকে মেনে নিতে পারলেন না। বরং হিপোক্রেটিস, গ্যালেনদের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা রোগকে প্রাকৃতিক উপায়েই ব্যাখ্যা করতে চাইলেন। তাদের ধারণা ছিল- মানুষের শরীরের সাথে পরিবেশের মাটি, বায়ু, আগুন ও পানির ওতপ্রোত সম্পর্ক বিদ্যমান। পরিবেশের এসব উপাদানের যথাক্রমে ঠাণ্ডা, শুষ্ক, গরম ও আর্দ্র হওয়ার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর এসব বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করে দেহের চার ধরনের তরল- শ্লেষা, হলুদ পিত্ত, রক্ত ও কালো পিত্ত।
তাদের অনুমান ছিল- দেহের চার ধরনের এসব তরলের সাম্যাবস্থাই হচ্ছে সুস্থ থাকা। আর এ চার তরলের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা হলেই দেহে বাসা বাধবে রোগ। দেহে রক্তের আধিক্যের কারণে অসুস্থতা ঘটছে- এমনটি মনে হলে কিছু রক্ত দেহ থেকে বের করে দিয়ে সাম্যাবস্থায় আনার চেষ্টা করা হতো! যদিও হিউমর থিওরি অনেকাংশেই বিজ্ঞানসম্মত ছিল না, তবুও ভারত, চীন ও মিশরেও গ্রিকদের মতো এমন ধারণার প্রচলন ছিল।
পরবর্তীতে রোগের কারণ হিসেবে উঠে আসে মিয়াজমা থিওরি। এখানে নিচু বদ্ধ জলাভূমিতে জৈব বস্তুর পচনে তৈরি একপ্রকার বাষ্পকে রোগ সৃষ্টির কারণ হিসেবে দেখা হতো। অদৃশ্য, অস্পৃশ্য এ বাষ্পকে বলা হতো ‘Miasm’। ১৮৮০ সালের দিকে জীবাণু তত্ত্ব আবিষ্কারের পূর্বে এ মিয়াজমা তত্ত্বই ছিল ব্যাপক প্রচলিত একটি ভুল ধারণা। তখন ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগও দূষিত বায়ুর মাধ্যমে ছড়ায় বলে মনে করা হতো। ‘Malaria’ শব্দটিই মূলত একটি ইতালিয়ান শব্দ, যার অর্থ ‘দূষিত বায়ু’।
এমনকি প্লেগ মহামারির কারণ হিসেবেও এ দূষিত বায়ুকে দায়ী করা হতো। প্লেগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় দুর্গন্ধ এড়াতে ডাক্তাররা অদ্ভুত একপ্রকার মুখোশ ব্যবহার করত। মুখোশের মধ্যে আবার ফুল, লতাপাতা, মধু দিয়ে ভর্তি করা থাকত! ইতিহাসে তারা প্লেগ ডাক্তার নামে পরিচিত। একসময়ে কলেরাকেও এ দূষিত বায়ুর ফল হিসেবে দেখা হতো। ১৮৫০ সালের দিকে জন স্নো দেখান যে- বায়ু না, বরং দূষিত পানির মাধ্যমেই ছড়ায় কলেরা।
হিউমর ও মিয়াজমা থিওরির পাশাপাশি রোগ সম্পর্কে আরও একধরনের ধারণার প্রচলন ছিল- গুটি বসন্তের মতো রোগগুলো একজন থেকে আরেকজনের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। ইতালিয়ান চিকিৎসক ফ্রাকাসটরো এ তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু তখনও অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার না হওয়ায় এরূপ সংক্রমণের পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ তুলে ধরা সক্ষম হয়নি।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে আশীর্বাদ হিসেবে ধরা দেয় এ জীবাণু তত্ত্ব বা জার্ম থিওরি। কেননা, কোনো রোগের চিকিৎসা করতে হলে আগে তার কারণ জানা আবশ্যক। জীবাণু তত্ত্ব বলে- প্রত্যেক রোগের পেছনে রয়েছে কোনো না কোনো নির্দিষ্ট জীবাণু। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাকসহ যেকোনো জীবাণুই হতে পারে এটি। রোগের এ জীবাণু তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন লুই পাস্তুর ও রবার্ট কখ। ১৮৬০ সাল পরবর্তী সময়ে একে একে আবিষ্কার হয় অ্যানথ্রাক্স, যক্ষা, কলেরা, ডিপথেরিয়া প্রভৃতি রোগের জীবাণু। এ যেন অণুজীব বিজ্ঞানের এক স্বর্ণালী যুগ। আর রোগের কারণ চিহ্নিত করা মানেই তার চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারের অর্ধেক কাজের সমাপ্তি! সেসময় একের পর এক ওষুধ ও ভ্যাক্সিনের উদ্ভাবন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অকল্পনীয় অগ্রগতি সাধন করে।
জীবাণু তত্ত্বের আবিষ্কারে রোগব্যাধির ধারণা আধুনিক যুগে প্রবেশ করলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন: যক্ষা রোগের জীবাণু দ্বারা যক্ষা রোগ হলেও এ জীবাণুর সংস্পর্শে আসা সকলেরই কিন্তু যক্ষা হয় না। কেননা, এখানে জীবাণুর (Agent) পাশাপাশি জীবাণুর আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করা ব্যক্তির দেহ ও পরিবেশের বিভিন্ন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অপুষ্টি, পরিবেশ দূষণ, মাদকাসক্তি, দারিদ্র্য প্রভৃতি যক্ষা রোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। জীবাণু ,ব্যক্তি ও পরিবেশের এই ত্রিভুজ সম্পর্কই এপিডেমিওলজিকাল ট্রায়াড। পরবর্তীতে অবশ্য এখানে সময়ের ভূমিকাও রয়েছে বলে মত দেন গবেষকরা।
এমএম/